ফাইল ছবি
প্রায় ১৫ বছর আগে ২০০৯ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশ রাইফেলস-বিডিআর (বর্তমানে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ-বিজিবি) সদর দফতর পিলখানাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে ঘটে যায় দেশের ইতিহাসের মর্মান্তিক এক ঘটনা। বিপথগামী কিছু সদস্যের নির্মম হত্যাযজ্ঞের শিকার হন বিডিআরের তৎকালীন মহাপরিচালক মেজর জেনারেল শাকিল আহমেদসহ ৫৭ সেনা কর্মকর্তা।
দুদিন ধরে (২৫ ও ২৬ ফেব্রুয়ারি) চলা নিষ্ঠুর আচরণ ও পাশবিক নির্যাতনের শিকার হন তৎকালীন বিডিআরের বিভিন্ন পর্যায়ে দায়িত্ব পালনরত সেনা কর্মকর্তারা। তাদের বাসায় গিয়ে পরিবারের সদস্যদের আটক ও নির্যাতন করা হয়। এ সময় নারী ও শিশুসহ আরও ১৭ জনকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। সূচনা হয় ‘বিডিআর বিদ্রোহ’ নামে বাংলাদেশের ইতিহাসের এক কলঙ্কজনক অধ্যায়ের।
আজ রোববার (২৫ ফেব্রুয়ারি) পিলখানা হত্যাযজ্ঞ দিবস। এদিন তাদের স্মরণে শাহাদাতবার্ষিকী পালন করবে সেনাবাহিনী ও বিজিবি। সকাল ৯টায় বনানী সামরিক কবরস্থানে শহীদদের কবরে পুস্পস্তবক অর্পণ করা হয় দিনের কর্মসূচি শুরু হয়।
পিলখানায় বিদ্রোহ ও নৃশংস হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় তখন দুটি মামলা করা হয়। এর একটি হত্যা মামলা নিম্ন আদালতে রায়ের পর এখন আপিল বিভাগে ডেথ রেফারেন্সের শুনানি চলছে। অন্যটি বিস্ফোরক দ্রব্য মামলার বিচার এখনো শেষ হয়নি।
২০১০ সালের ১২ জুলাই হত্যা মামলায় এবং ২৭ জুলাই বিস্ফোরক আইনের মামলায় চার্জশিট দাখিল করে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)। ২০১১ সালের ১০ আগস্ট হত্যা মামলায় চার্জ গঠন করে বিচার শুরু হলেও বিস্ফোরক আইনের মামলার বিচার স্থগিত ছিল। হত্যা মামলায় সাক্ষ্য গ্রহণের শেষ পর্যায়ে ২০১৩ সালের ১৩ মে বিস্ফোরক আইনের মামলায় চার্জ গঠনের মাধ্যমে বিচার শুরু করা হয়। হত্যা মামলায় চার বছর ৮ মাসে ২৩২ কার্যদিবসের পর ২০১৩ সালের ৫ নভেম্বর রায় ঘোষণা হয়। রায়ে ঢাকার নিম্ন আদালত ১৫২ জনের মৃত্যুদণ্ড দেন।
পরে ২০১৭ সালের ২৭ নভেম্বর হাইকোর্টে আপিলের রায়ে ১৩৯ জনের মৃত্যুদণ্ড বহাল রাখা হয়। আট জনের মৃত্যুদণ্ডের সাজা কমিয়ে যাবজ্জীবন ও চার জনকে খালাস দেয়া হয়। নিম্ন আদালতে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের আদেশ পাওয়া ১৬০ জনের মধ্যে ১৪৬ জনের সাজা বহাল রাখা হয়। বর্তমানে মামলাটির শুনানি চলছে আপিল বিভাগে।
অন্যদিকে বিস্ফোরক মামলায় এখনো সাক্ষ্য গ্রহণ চলছে নিম্ন আদালতে। গত ১৫ বছরে এ মামলায় সাক্ষ্য গ্রহণ করা হয়েছে ২৭৩ জনের। এ মামলায় এক হাজার ১৬৪ সাক্ষীর মধ্যে ১৫ বছরে সাক্ষ্য দিয়েছেন মাত্র ২৭৩ জন। আরও প্রায় ১০০ জনের সাক্ষ্য গ্রহণ শেষে মামলার কার্যক্রমের ইতি টানা হবে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।
রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী মোশাররফ হোসেন কাজল বলেন, ‘পিলখানার ঘটনায় করা হত্যা মামলার বিচার নিম্ন আদালতের পর হাইকোর্টেও নিষ্পত্তি হয়েছে। বর্তমানে সেটি আপিল বিভাগে আসামিদের শুনানি চলছে।’তিনি আরও বলেন, ‘বিস্ফোরক আইনের মামলাটিতে সাক্ষ্য গ্রহণ চলছে। নিয়মিত সাক্ষ্য গ্রহণের মাঝে দুই বছর করোনার কারণে বিলম্বিত হয়। বর্তমানে এ মামলায় আবার সাক্ষ্য গ্রহণ চলছে। সাক্ষীরাও আসছেন। ইতোমধ্যে ২৭৩ জনের সাক্ষ্য নিয়েছেন আদালত। তিন থেকে সাড়ে তিনশ সাক্ষীর সাক্ষ্য গ্রহণ শেষ হলে মামলার বিচারিক কার্যক্রম শেষ করে আদালত রায় ঘোষণা করবেন বলে আশা করা যায়।’
আরও পড়ুন <> পবিত্র শবে বরাত আজ
আসামিপক্ষের আইনজীবী ফারুক আহাম্মদ বলেন, ১৫ বছর হয়ে গেল বিস্ফোরক আইনের মামলাটির বিচার শেষ হয়নি। হত্যা মামলায় রায় পাওয়ার পর রাষ্ট্রপক্ষ বিস্ফোরক আইনের মামলা নিয়ে আর গুরুত্ব দিচ্ছে না। হত্যা মামলার খালাসপ্রাপ্ত ২৭৮ আসামি বিস্ফোরক মামলারও আসামি। হত্যা মামলায় খালাস পেলেও বিস্ফোরক মামলার কারণে তারা মুক্তি ও জামিন পাচ্ছেন না। তাই বিস্ফোরক আইনের মামলা দ্রুত নিষ্পত্তি করা দরকার। এ মামলার ৮৩৪ আসামির মধ্যে ৪৪ জন ইতোমধ্যে মারা গেছেন। ১৯ আসামি পলাতক আছেন। ৭৭১ আসামি কারাগারে আছেন বলে জানান তিনি।
এই দিনে যা ঘটেছিল : সকাল ৯টা ২৭ মিনিটের দিকে বিডিআরের বার্ষিক দরবার চলাকালে দরবার হলে ঢুকে পড়েন এক দল বিদ্রোহী সৈনিক। তাদেরই একজন তৎকালীন মহাপরিচালকের (শাকিল আহমেদ) বুকে বন্দুক তাক করেন। সূচনা হয় ইতিহাসের সেই নৃশংসতম ঘটনার। বিদ্রোহী সৈনিকরা সেনা কর্মকর্তাদের উপর আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েন। সেনা কর্মকর্তাদের হত্যা করে পরিবারকে জিম্মি করে ফেলেন জওয়ানরা। পুরো পিলখানায় সৃষ্টি হয় ভীতিকর পরিস্থিতি। চারটি প্রবেশ গেট নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আশপাশের এলাকায় গুলি ছুঁড়তে থাকেন বিদ্রোহীরা।
তারা দরবার হল ও এর আশপাশের এলাকায় সেনা কর্মকর্তাদের উপর গুলি করতে থাকেন। তাদের গুলিতে একে একে লুটিয়ে পড়তে থাকেন সেনা কর্মকর্তারা। ঘটনার ৩৬ ঘণ্টা পর এ বিদ্রোহের অবসান হয়। পিলখানা পরিণত হয় এক রক্তাক্ত প্রান্তরে। পরে পিলখানার ভেতরে আবিষ্কৃত হয় গণকবর। সেখান থেকে উদ্ধার করা হয় সেনা কর্মকর্তাদের মরদেহ।
বিডিআর পুনর্গঠন ও বিজিবি গঠন : পিলখানায় এই বিদ্রোহের ঘটনায় বিডিআরের সাংগঠনিক কাঠামো ভেঙে যায়। শুরু হয় বিডিআর পুনর্গঠনের কাজ। বিডিআরের নাম, পোশাক, লোগো ও সাংগঠনিক কাঠামো পরিবর্তন করা হয়। বিডিআরের নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি)। পরিবর্তন করা হয় তাদের আইন।
আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদফতরের (আইএসপিআর) সহকারী পরিচালক রাশেদুল আলম খান জানান, ২০০৯ সালের ২৫ ও ২৬ ফেব্রুয়ারি পিলখানায় সংঘটিত বর্বরোচিত হত্যাকাণ্ডে সেনাবাহিনী শহীদ সেনাসদস্যদের উদ্দেশ্যে শাহাদাতবার্ষিকী পালন করবে।
বিজিবির জনসংযোগ কর্মকর্তা শরীফুল ইসলাম জানান, বিজিবির পক্ষ থেকে শহীদদের স্মরণে শাহাদাতবার্ষিকী পালন করা হবে। পিলখানাসহ বিজিবির সব রিজিয়ন, সেক্টর, প্রতিষ্ঠান ও ইউনিটের ব্যবস্থাপনায় কোরআন খতম, দোয়া মাহফিল ও নিহতদের মাগফিরাত কামনা করে দোয়া করা হবে।
আপন দেশ/এমআর
মন্তব্য করুন ।। খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত,আপন দেশ ডটকম- এর দায়ভার নেবে না।