ফাইল ছবি
সোমালিয়ায় জলদস্যুদের হাতে জিম্মি বাংলাদেশি জাহাজ এমভি আবদুল্লাহকে মুক্ত করার কোনো প্রক্রিয়া এখনো শুরু হয়নি বলে জানিয়েছে জাহাজটির মালিক প্রতিষ্ঠান কেএসআরএম।
ভারতীয় নৌবাহিনীর অভিযানে এমভি আবদুল্লাহ মুক্ত হয়েছে বলে যে অসত্য খবর প্রচার করা হচ্ছে, তাতে জিম্মি ২৩ নাবিকের জীবন আরও শঙ্কায় পড়ছে বলে মনে করছে জাহাজটির মালিক প্রতিষ্ঠান কেএসআরএম।
প্রতিষ্ঠানটির মিডিয়া উপদেষ্টা মিজানুল ইসলাম শনিবার (১৬ মার্চ) রাতে বলেন, ‘আটক জাহাজ মুক্ত করতে নানাভাবে চেষ্টা চলছে। তবে নানা জটিলতায় এখনো সেই প্রক্রিয়া শুরু করা যায়নি। এমভি আবদুল্লাহকে ভারতীয় নৌবাহিনীর সহায়তায় মুক্ত করা গেছে বলে প্রকাশিত সংবাদটি গুজব।’
এদিকে বাংলাদেশ মার্চেন্ট মেরিন অফিসার্স অ্যাসোসিয়েশনও জানিয়েছে, ভারতীয় নৌবাহিনীর অভিযানে এমভি আবদুল্লাহ মুক্ত হয়েছে বলে ভারতীয় কিছু গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এখন ঘুরে বেড়াচ্ছে। এই খবর ভিত্তিহীন।
জিম্মি নাবিকদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখা নির্ভরশীল একটি সূত্র জানায়, শনিবার মধ্যরাতে নাবিকরা জানিয়েছেন, মিডিয়ায় জিম্মি জাহাজ মুক্তির খবর দেখে তারা বেশ দুশ্চিন্তায় পড়েছেন।
নাবিকরা জানিয়েছেন, শুক্রবার সোমালিয়ার উপকূলের দিকে অগ্রসর হওয়ার সময় ইউরোপ আর ভারতীয় দুই যুদ্ধজাহাজ সোমালিয়ার জলদস্যুদের থামতে বলে। ওদের ডেকে আনা হয়েছে এমন ধারণা থেকে জলদস্যুরা ক্ষিপ্ত হয়ে এমভি আবদুল্লাহর নাবিকদের ব্রিজে জড়ো করে তাদের দিকে বন্দুক তাক করে রাখে বেশ কিছু সময়। এ সময় জলদস্যুরা অস্ত্রের মুখে এমভি আবদুল্লাহর ক্যাপ্টেনকে ভারতীয় নৌবাহিনীর জাহাজকে দূরে সরে যাওয়ার বেতার বার্তা পাঠাতে বাধ্য করে। ফলে নৌবাহিনীর জাহাজ দুটোও পিছু হটে। এর পরই এমভি আবদুল্লাহকে আরও উত্তর দিকে নিয়ে যায় জলদস্যুরা। যাচাই-বাছাই ছাড়া কোনো ধরনের খবর প্রকাশ না করার জন্য নাবিকদের পক্ষ থেকে বারবার অনুরোধ জানানো হয়েছে।
মুক্তিপণের আলোচনা তিন ধাপে, অর্থ হস্তান্তর পাঁচ ভাগে: এদিকে আনুষ্ঠানিক কিছু না জানালেও মুক্তিপণের পথেই হাঁটছে সোমালিয়ার জলদস্যুরা। তারা শনিবার প্রথমবারের মতো জাহাজ এমভি আবদুল্লাহর জিম্মি ২৩ নাবিকের সঙ্গে বাইরের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন রেখেছে। মালিকপক্ষ ও স্বজনকে চাপে রাখতেই এমনটি করা হয়েছে– ধরে নিয়ে বীমা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যোগাযোগ করেছে জাহাজটির মালিকপক্ষ এবং তারা পুরনো অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে মধ্যস্থতাকারী খুঁজছে।
আরও পড়ুন <> জিম্মি জাহাজের চার জলদস্যুর ছবি প্রকাশ
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এ ধরনের জিম্মি ঘটনায় মুক্তিপণের বিষয় তিন ধাপে আলোচনা হয়। জাহাজের মালিকপক্ষ যোগাযোগ করে বীমা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে। বীমা প্রতিষ্ঠান আন্তর্জাতিক মধ্যস্থতাকারী ঠিক করে। তারা যোগাযোগ করে জলদস্যুর প্রতিনিধির সঙ্গে। তিন পক্ষ আলোচনা করে মুক্তিপণের অঙ্ক ও প্রদানের প্রক্রিয়া চূড়ান্ত করে। এরপর মুক্তিপণের অর্থ পাঁচ ভাগে ভাগ হয়। জলদস্যুরা নিজেদের মধ্যে তিন স্তরে ভাগ করে। এক ভাগ যায় মধ্যস্থতাকারী ও মুক্তিপণের অর্থ পরিবহনকারী গ্রুপের কাছেও। ১৪ বছর আগে এ প্রক্রিয়াতেই ‘এমভি জাহান মণি’ জাহাজের নাবিকরা মুক্ত হয়েছিলেন।
এমভি জাহান মণির মুক্তিপণ প্রক্রিয়ায় যুক্ত ছিলেন কেএসআরএম গ্রুপের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মেহেরুল করিম। এবারো তিনি জাহাজ মালিকের হয়ে বীমা কোম্পানির সঙ্গে যোগাযোগ রাখছেন বলে জানা গেছে। অবশ্য এ নিয়ে মালিকদের কেউ খোলামেলা কথা বলছেন না। তবে গতবার প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত কেএসআরএমের এক নীতিনির্ধারক জানান, গতবারের অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে তারা এগোচ্ছেন। জলদস্যুদের থেকে এখনো মুক্তিপণের দাবি আসেনি। ঘটনার পরম্পরা বিশ্লেষণে অনেকটাই নিশ্চিত, নাবিকদের মুক্ত করতে মুক্তিপণই লাগবে। এ জন্য বীমা কোম্পানির সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়েছে। তারা লন্ডনভিত্তিক মধ্যস্থতাকারী প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যোগাযোগ করছে। এসব মধ্যস্থতাকারীর সঙ্গে জলদস্যুদের যোগাযোগ রয়েছে। সোমালিয়ায় একাধিক জলদস্যু গ্রুপ রয়েছে। ঠিক কারা এমভি আবদুল্লাহ কব্জায় নিয়েছে, তা নিশ্চিত হওয়া যায়নি। এরপরও সময়ক্ষেপণ এড়াতে সব ধরনের যোগাযোগ করা হচ্ছে বলে জানান তিনি।
কেএসআরএমের মুখপাত্র ও মিডিয়া উপদেষ্টা মিজানুল ইসলাম বলেন, ‘মুক্তিপণের অর্থ আদায় ও বণ্টনে একটি ছক রয়েছে। অতীত অভিজ্ঞতা থেকে আমরা এ ছকেই হাঁটছি। নাবিকদের সুস্থভাবে ফিরিয়ে আনাতেই আমাদের পূর্ণ মনোযোগ।’ তিনি আরও বলেন, ‘কৌশলগত চাপ তৈরিতেই শনিবার দিনভর নাবিকদের কাউকে আমাদের সঙ্গে কথা বলতে দেয়নি দস্যুরা। আগেও তারা এ পথই অনুসরণ করেছিল।’
সংশ্লিষ্টরা জানান, জিম্মিদের কাছ থেকে জলদস্যুরা ইউএস ডলারের মাধ্যমে মুক্তিপণ আদায় করে। এসব মুক্তিপণের অর্থ পরিশোধের জন্য দুটি পদ্ধতি পছন্দ তাদের। বস্তায় ভরে হেলিকপ্টার থেকে নির্ধারিত স্থানে ফেলে দেয়া। অথবা ছোট নৌকায় করে ওয়াটার প্রুফ ব্যাগে বুঝে নেয়। মাঝেমধ্যে প্যারাসুটের মাধ্যমেও মুক্তিপণ জলদস্যুদের কাছে পৌঁছে দিতে হয়। গোটা প্রক্রিয়া হয় আন্তর্জাতিক মধ্যস্থতাকারী সংস্থার মাধ্যমে। এদের বেশির ভাগই যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যভিত্তিক প্রতিষ্ঠান।
ইইউ ন্যাভ ফর আটালান্টা বলছে, তারা জলদস্যুদের নিয়ন্ত্রণে কাজ করছে। কিন্তু নাবিক জিম্মি করে মুক্তিপণ আদায়ের কৌশলের কাছে পরাস্ত হচ্ছে। এ জন্য জলদস্যুদের সঙ্গে সমঝোতা করতে বাধ্য হন জাহাজ মালিকরা। জাহাজের সাবেক ক্যাপ্টেন ও বাংলাদেশ মার্চেন্ট মেরিন অফিসার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি ক্যাপ্টেন আনাম চৌধুরী বলেন, ‘জাহাজ জলদস্যুদের কব্জায় পড়ার পর গভীরভাবে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে প্রথমে দ্বারস্থ হতে হয় বীমা কোম্পানির। তারাই আন্তর্জাতিক মধ্যস্থতাকারীর মাধ্যমে জলদস্যুদের সঙ্গে যোগাযোগ করে। সেখান থেকে আসা বার্তা বীমা কোম্পানির মাধ্যমে জাহাজ মালিক জানতে পারেন। এভাবে তিন পক্ষ মুক্তিপণের অর্থ চূড়ান্ত করে।’
বাংলাদেশ মার্চেন্ট মেরিন অফিসার্স অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক সাখাওয়াত হোসেন বলেন, ‘জলদস্যুরা ঝুঁকি নিয়ে মুক্তিপণ আদায় করলেও ভোগ করে কয়েকটি পক্ষ। মধ্যস্থতাকারী ও মুক্তিপণের অর্থ পৌঁছে দেয়ার কাজে নিয়োজিত পরিবহন সংস্থাও একটি অংশ পায়। মূলত অর্থ তিন ধাপে ভাগ করে জলদস্যুরা। প্রথমে যারা জাহাজে ওঠে, তাদের নির্ধারিত অংশ বোনাস হিসেবে দেয়া হয়। এ দল ৩০ থেকে ৩৫ শতাংশ পায়। বাকি অর্থ দ্বিতীয় ধাপে যারা জাহাজটি পাহারা দেয়, তাদের দেয়। জাহাজের জ্বালানি, খাওয়া-দাওয়াসহ পরিচালনাগত খরচ আলাদাভাবে হিসাব করে জলদস্যুরা। এমভি জাহাজ মণির ক্ষেত্রে আমরা এমন ভাগবাটোয়ারা জেনেছি।’
জানা গেছে, লুটের টাকা দিয়ে সোমালিয়ার জলদস্যুরা পরিচালনা করে নিজস্ব স্টক এক্সচেঞ্জও। অর্থ বা অস্ত্র দিয়ে এ স্টক এক্সচেঞ্জে বিনিয়োগ করা যায়, অভিযান সফল হলে পাওয়া যায় লভ্যাংশ! বার্তা সংস্থা রয়টার্সের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, এক বিনিয়োগকারী এ স্টক এক্সচেঞ্জ থেকে এক মাসে ৭৫ হাজার ডলারও উপার্জন করেছেন।
গত ৪ মার্চ বাংলাদেশের এসআর শিপিংয়ের ১৩ মিটার গভীরতার জাহাজ এমভি আবদুল্লাহ মোজাম্বিকের মাপুতু বন্দর থেকে কয়লা নিয়ে সংযুক্ত আরব আমিরাতের উদ্দেশে রওনা দেয়। এর পর গত মঙ্গলবার দুপুর দেড়টার দিকে খবর আসে, ভারত মহাসাগরে জাহাজটি ছিনতাই হয়েছে।
জলদস্যুদের উৎপাতের কারণে ঝুঁকিপূর্ণ ভারত মহাসাগরে অস্ত্রধারী নিরাপত্তারক্ষীসহ জাহাজ চলাচলের নিয়ম রয়েছে। এ ছাড়া জাহাজের চারপাশে তারকাঁটার বেষ্টনী, হাইস্পিড ওয়াটারগানসহ বিভিন্ন নিরাপত্তাব্যবস্থা নেয়া হয়। কিন্তু দস্যুদের কবলে পড়া এমভি আবদুল্লাহতে এসব ব্যবস্থার কোনোটিই নেয়া হয়নি।
বিশ্লেষকরা বলছেন, কয়লাবোঝাই জাহাজটির পানির ওপরের অংশের উচ্চতা কম হওয়ায় খুব সহজেই এটিতে চড়ে বসে দস্যুরা। যার ফলে অনেকটা বিনা বাধায় জাহাজের নিয়ন্ত্রণ নেয় তারা।
আপন দেশ/এমআর
মন্তব্য করুন ।। খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত,আপন দেশ ডটকম- এর দায়ভার নেবে না।