ছবি: সংগৃহীত
ঢাকা-চট্টগ্রাম রুটে দ্রুতগতির রেলপথ নির্মাণে এর সম্ভাব্যতা সমীক্ষায় ১১০ কোটি টাকা ব্যয় করা হয়। প্রাক্কলিত নির্মাণ ব্যয় ১ হাজার ১৪০ কোটি ডলার। যা টাকার অঙ্কে ১ লাখ ৩৩ হাজার ২৫৮ কোটি। সাত বছর আগে সমীক্ষা হয়। তবে এখন রেলপথ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলছেন, প্রকল্পটি আপাতত বাস্তবায়ন করা হবে না।
বাংলাদেশ রেলওয়ের আরেক প্রকল্প ঢাকায় সার্কুলার রেল নির্মাণ। প্রায় ৯৭ হাজার কোটি টাকার এ প্রকল্পের ক্ষেত্রেও একই নীতি গ্রহণ করেছে সংস্থাটি। অন্যদিকে ৮ লাখ ৭১ হাজার ২৭৩ কোটি টাকার ঢাকা সাবওয়ে নির্মাণ প্রকল্পে ‘ধীরে চলো’ নীতি গ্রহণ করেছে বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষ। সম্প্রতি ৬১ হাজার ৭৩৮ কোটি টাকার ঢাকা-লাকসাম কর্ড লাইন রেলপথ নির্মাণের একটি প্রকল্পও স্থগিত করা হয়েছে।
সমীক্ষা সম্পন্ন করেও দেশের যোগাযোগ অবকাঠামো খাতের সম্ভাব্য এমন বড় অনেক প্রকল্প থেকেই সরে আসছে সরকার। বলা হচ্ছে, এসব প্রকল্প পরবর্তী সময়ে বাস্তবায়ন করা হবে। বড় প্রকল্প থেকে সরে আসার কারণ হিসেবে বর্তমান অর্থনৈতিক পরিস্থিতির বিষয়টিও আলোচনায় আসছে। যদিও প্রকল্পগুলোর সমীক্ষার পেছনে এরই মধ্যে খরচ হয়েছে বিপুল পরিমাণ অর্থ। সমীক্ষা বাবদ ব্যয়ের এ অর্থকে অপচয় হিসেবে দেখছেন যোগাযোগ অবকাঠামো বিশেষজ্ঞরা।
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ড. হাদিউজ্জামান এ প্রসঙ্গে বলেন, যোগাযোগ অবকাঠামো উন্নয়নে সড়ক ও জনপথ (সওজ) অধিদফতরের নিজস্ব মহাপরিকল্পনা রয়েছে। ঢাকা শহরে প্রকল্প নেয়ার ক্ষেত্রে ডিটিসিএর (ঢাকা পরিবহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষ) মহাপরিকল্পনা রয়েছে, যা প্রয়োজনের তাগিদে সময়ে সময়ে হালনাগাদও করা হচ্ছে।
আরও পড়ুন>> পরিবেশবান্ধব সাশ্রয়ী পরিকল্পনা করুন: প্রধানমন্ত্রী
তিনি বলেন, ঢাকার জন্য কোন প্রকল্পগুলো উপযোগী বা প্রয়োজনীয় তা এ মহাপরিকল্পনায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। কিন্তু আমরা দেখছি, এ পরিকল্পনার বাইরে গিয়ে সেতু কর্তৃপক্ষ সাবওয়ের সমীক্ষা করে ফেলেছে। রেলওয়ে সার্কুলার রেলের সমীক্ষা করে ফেলেছে। কোনো সংস্থা যদি নিজেই সম্ভাব্যতা সমীক্ষা করে, এটা একটা প্রশ্নবিদ্ধ বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। এসব সমীক্ষা প্রকল্পেও বাস্তবে তাই হয়েছে। সমীক্ষার পেছনে শত শত কোটি টাকা খরচ হলেও প্রকল্পগুলো আলোর মুখ দেখছে না।
ঢাকায় একটি মেট্রোরেল লাইন (উত্তরা-মতিঝিল, এমআরটি লাইন-৬) চালু হয়েছে। আরও দুটির কাজ চলমান। তিনটি মেট্রো লাইন প্রকল্প রয়েছে পাইপলাইনে। সেগুলো বাস্তবায়নের দায়িত্বে রয়েছে সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের অধীনস্থ সংস্থা ঢাকা ম্যাস ট্রানজিট কোম্পানি লিমিটেড (ডিএমটিসিএল)।
একই মন্ত্রণালয়ের অধীনস্থ সংস্থা বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষ মেট্রোরেলের সমজাতীয় যোগাযোগ অবকাঠামো সাবওয়ে নির্মাণের জন্য পৃথকভাবে একটি সমীক্ষা করেছে। ২০২১ সালে করা এ সমীক্ষায় খরচ হয়েছে প্রায় ৩১৮ কোটি টাকা। ২০২১-৫০ সালের মধ্যে তিন ধাপে বাস্তবায়ন হওয়ার কথা এ প্রকল্প। এরমধ্যে ২০২১-২৯ সালের মধ্যে ১০৯ কিলোমিটার সাবওয়ে নির্মাণের পরিকল্পনা রয়েছে। পরিকল্পনা অনুযায়ী, দ্বিতীয় ও তৃতীয় ধাপে যথাক্রমে ১৮৫ ও ২৫৭ কিলোমিটার সাবওয়ে তৈরি হবে। সব মিলিয়ে খরচ হবে ৮ লাখ ৭১ হাজার কোটি টাকার বেশি।
বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষের ২০২২ সালের মে মাসে অনুষ্ঠিত পরিচালনা পর্ষদের সভায় প্রকল্পটি উপস্থাপন করা হয়। তবে সেটির ব্যাপারে তখন ‘ধীরে চলো’ নীতি গ্রহণের নির্দেশনা দেন সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের।
আরও পড়ুন>> আইএমএফের শর্ত পূরণে যেসব প্রভাব পড়ছে অর্থনীতিতে
ঢাকা সাবওয়ে প্রকল্পটি বাতিল বা স্থগিত হয়নি বলে দাবি করেছেন বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষের প্রধান প্রকৌশলী কাজী মো. ফেরদাউস। তিনি বলেন, ঢাকায় সাবওয়ে নির্মাণের জন্য আমরা বিনিয়োগকারীর খোঁজ করছি। প্রাথমিকভাবে চারটি লাইন সরকারি-বেসরকারি অংশীদারত্বের মাধ্যমে বাস্তবায়নের জন্য আলোচনাও শুরু করেছি।
তিনি আরও বলেন, ‘অনেকেই সাবওয়ের সঙ্গে মেট্রোরেলকে গুলিয়ে ফেলেন। ঢাকায় যেখানে মেট্রোরেল সেবা পৌঁছবে না, সেখানে সাবওয়ে গড়ে তোলা হবে। প্রকল্পটি ঢাকার যানজট নিরসনে গুরুত্বপূর্ণ এবং এটি বাস্তবায়নে সেতু কর্তৃপক্ষ কাজ করে যাচ্ছে।’
ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম পর্যন্ত হাইস্পিড ট্রেন নির্মাণের জন্য ‘ঢাকা-চট্টগ্রাম ভায়া কুমিল্লা/লাকসাম দ্রুতগতির রেলপথ নির্মাণের জন্য সম্ভাব্যতা সমীক্ষা ও বিশদ ডিজাইন’ প্রকল্প হাতে নেয় বাংলাদেশ রেলওয়ে। এ প্রকল্পের মাধ্যমে ২০১৭ সালে রেলপথটির সম্ভাব্যতা সমীক্ষা করা হয়েছে। এতে ব্যয় হয় ১১০ কোটি টাকা। সমীক্ষায় এ রেলপথটির সম্ভাব্য নির্মাণ ব্যয় ধরা হয় ১ হাজার ১৪০ কোটি ডলার।
প্রকল্পটি নিয়ে আলোচনার মধ্যেই ২০২২ সালের শুরুর দিকেই তৎকালীন রেলমন্ত্রী নূরুল ইসলাম সুজন জানান, আপাতত সেটি বাস্তবায়ন করা হবে না। কারণ হিসেবে তিনি বলেন, এ প্রকল্পে হাত দেয়ার আগে কিছু স্বল্প ও মধ্যমেয়াদী কাজ শেষ করা প্রয়োজন। সেগুলো শেষ করেই হাইস্পিড রেলপথ নির্মাণ করা হবে।
রাজধানী ঢাকার সঙ্গে বাণিজ্যনগরী চট্টগ্রামের যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নয়নে ২০১৩ সালে ঢাকা-চট্টগ্রাম এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে নামের একটি প্রকল্পের সম্ভাব্যতা সমীক্ষা করে সওজ অধিদফতর। সমীক্ষাটি পরিচালনা করতে ব্যয় হয় প্রায় ৯৮ কোটি টাকা। দীর্ঘদিন প্রকল্পটির অর্থায়ন নিয়ে দেন-দরবারের পর ২০২১ সালে এসে তা বাতিল করে দেয়া হয়।
আরও পড়ুন>> রেল আরও আধুনিক ও সমৃদ্ধ হচ্ছে
ঢাকার চারপাশে ৮১ কিলোমিটার দীর্ঘ বৃত্তাকার একটি রেলপথ নেটওয়ার্ক গড়ে তোলার পরিকল্পনা বাংলাদেশ রেলওয়ের। মূল উদ্দেশ্য রাজধানীতে গণপরিহন হিসেবে ট্রেনের অংশ বাড়ানো এবং যানজট নিরসনে ভূমিকা রাখা। বৃত্তাকার রেলপথটি নির্মাণের সম্ভাব্যতা সমীক্ষায় ব্যয় হয়েছে প্রায় ৩০ কোটি টাকা।
সমীক্ষা অনুযায়ী, রেলপথটির সিংহভাগ অংশ উড়ালপথে ও কিছু অংশ পাতালপথে নির্মাণ করতে খরচ প্রাক্কলন করা হয়েছে প্রায় ৯৭ হাজার কোটি টাকা। বৃত্তাকার রেলপথ নির্মাণের এ প্রকল্পটিও রয়েছে একই দশায়।
মহাপরিকল্পনার বাইরে এভাবে সমীক্ষা প্রকল্প বাস্তবায়ন করা বড় ধরনের প্রক্রিয়াগত ভুল উল্লেখ করে অধ্যাপক ড. হাদিউজ্জামান বলেন, শুরুতেই বড় পরিসরে সম্ভাব্যতা সমীক্ষা করা আরেকটা ভুল পদক্ষেপ হয়েছে। এক্ষেত্রে পূর্ণাঙ্গ সমীক্ষার বদলে প্রাক-সমীক্ষা করে সংস্থাগুলো এ অর্থের অপচয় অনেকটাই কমিয়ে আনতে পারত। প্রাক-সমীক্ষা করা হয় ছোট পরিসরে। এতে খরচও কম হয়।
তিনি আরও বলেন, উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নের দায়িত্বে থাকা সংস্থাগুলোর উচিত মহাপরিকল্পনা অনুযায়ী সমীক্ষা করা। সর্বোপরি এ ধরনের সমীক্ষার আগে আমাদের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের ব্যক্তিদের আরো কৌশলী হতে হবে। আমাদের দেশটা ছোট। এখানে জনসংখ্যা অনেক বেশি। তাই সম্পদের সীমাবদ্ধতা রয়েছে। সীমিত সম্পদের অপচয় কোনোভাবেই ভালো উদাহরণ হতে পারে না বলে জানান এ অধ্যাপক।
আপন দেশ/এসএমএ
মন্তব্য করুন ।। খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত,আপন দেশ ডটকম- এর দায়ভার নেবে না।