Apan Desh | আপন দেশ

‘খুন’ কিন্তু ‘মরদেহ নেই’: যা জানা গেল

নিজস্ব প্রতিবেদক

প্রকাশিত: ১৯:০৫, ২২ মে ২০২৪

‘খুন’ কিন্তু ‘মরদেহ নেই’: যা জানা গেল

ফাইল ছবি

ভারতে গিয়ে ‘খুন’ হয়েছেন এমপি আনোয়ারুল আজীম আনার। তবে এখনো তার মরদেহ উদ্ধার হয়নি বলে জানিয়েছে পশ্চিমবঙ্গ পুলিশ। সংস্থাটি জানিয়েছে, বিষয়টি আরও খতিয়ে দেখতে তদন্ত চলছে। রাজ্যের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) তদন্তের দায়িত্ব নিয়েছে। হত্যা করা হয়ে থাকলে এর পেছনে কারণ কী তাও এখনও পর্যন্ত অজানা। ফলে নানা প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে বিষয়টি ঘিরে।

তিন বারের এমপি আনারের মৃত্যুতে গভীর শোক ও দুঃখ প্রকাশ করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেছেন, ‘এটি পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড’। এ ঘটনা ‘বাংলাদেশ ও ভারতের দ্বিপক্ষীয় কোনও ইস্যু নয়’ বলে মন্তব্য করেছেন তিনি ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ।

নিখোঁজ
চিকিৎসার কথা বলে গত ১২ মে ঝিনাইদহ থেকে সড়কপথে ভারতে যান আনোয়ারুল আজীম আনার। কলকাতায় গিয়ে তার কথিত বন্ধু স্বর্ণ ব্যবসায়ী গোপাল বিশ্বাসের বাড়িতে উঠেছিলেন। কলকাতার অদূরে ব্যারাকপুর কমিশনারেট এলাকার বরাহনগর থানার মণ্ডলপাড়া লেনে গোপাল বিশ্বাসের বাড়ি। 

গণমাধ্যমে জানা গেছে, এ ব্যবসায়ীর সঙ্গে তার দুই দশকের বেশি সময় ধরে সখ্য ছিল। পরদিন ১৩ মে দুপুরে ‘বিশেষ প্রয়োজনের’ কথা বলে আজিম বেরিয়ে যান। দুপুরের দিকে বিধান পার্ক এলাকা থেকে ভাড়া করা গাড়িতে উঠে চলে যান আনার। সন্ধ্যায় ফিরে আসার কথা থাকলেও আর ফেরেননি তিনি।

পরে ওই দিনই আজিমের হোয়াটসঅ্যাপ নম্বর থেকে গোপালের নম্বরে মেসেজ আসে, ‘বিশেষ কাজে দিল্লি চলে যাচ্ছি। পৌঁছে ফোন করবো, তোমাদের ফোন করার দরকার নেই।’

১৪ মে থেকে পরিবার ও দলীয় নেতাকর্মীদের সঙ্গে আজীমের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন ছিল। তার ব্যবহৃত হোয়াটসঅ্যাপ নম্বরটিও বন্ধ ছিল। এদিকে ১৮ মে কলকাতার বরাহনগর থানায় লিখিত ‘মিসিং ডায়েরি’ করেন গোপাল বিশ্বাস। বুধবার (২২ মে) সকালে গোপাল বিশ্বাস স্থানীয় গণমাধ্যমকে জানান, এমপি আনারকে হত্যা করা হয়েছে বলে কলকাতা পুলিশ তাকে জানিয়েছে।

মরদেহ কোথায়
গণমাধ্যমে তথ্যে এসেছে, কলকাতার নিউ টাউনের ‘সঞ্জিভা গার্ডেনে’ এমপি আনার হত্যার শিকার হন। তবে সেখানে তার মরদেহ পাওয়া যায়নি। আজ বুধবার দুপুরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এক অনুষ্ঠান শেষে এ তথ্য জানিয়েছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ।

এদিকে মরদেহ কোথায় আছে সে ব্যাপারে কলকাতা পুলিশ এখনও কোনও তথ্য জানায়নি বাংলাদেশকে। কলকাতায় বাংলাদেশ উপ-দূতাবাস গণমাধ্যমকে জানিয়েছে, এমপি আনারের মরদেহ উদ্ধারের বিষয়ে অফিশিয়ালি কোনও তথ্য তাদের জানানো হয়নি। তিনি নিখোঁজ হওয়ার পর তারা (উপ-দূতাবাসের কর্মকর্তা) দুই দেশের পুলিশ ও তদন্তকারীদের মধ্যে যোগাযোগ করিয়ে দেন। তদন্তকারীরা নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ রেখে কাজ করছিলেন।

বাংলাদেশ পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন সাংবাদিকদের বলেছেন, ভারতে নিখোঁজ এমপি আনারের মরদেহ উদ্ধারের খবর গণমাধ্যম সূত্রে পেয়েছি। তবে ভারতের পুলিশ আনুষ্ঠানিকভাবে আমাদের এখনও কিছু নিশ্চিত করেনি। তিনি জীবিত নাকি মৃত, তা এখনও অফিশিয়ালি নিশ্চিত নই। আমরা যৌথভাবে কাজ করছি।

আজ বুধবার সকালে কলকাতার উপকণ্ঠে বিধাননগর পুলিশ কমিশনারেটের ডেপুটি পুলিশ কমিশনার মানব শ্রিংলা জানান, এমপি আনার শেষ যে ভাড়া গাড়িটি কলকাতায় ব্যবহার করেছিলেন, সেই ক্যাবটির চালক জেরার মুখে স্বীকার করেছে যে, ওই যাত্রীকে খুন করে তার মরদেহ টুকরো টুকরো করে ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল।

তবে মরদেহ কোথায় ছড়িয়ে দেয়া হয় সে ব্যাপারে তিনি কিছু বলেননি।

গ্রেফতার
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল জানিয়েছেন, এমপি আনার খুনের ঘটনায় দেশে তিনজনকে আটক করা হয়েছে। তাদের মধ্যে দুইজন সম্প্রতি কলকাতা থেকে বাংলাদেশে এসেছেন।

এদিকে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ জানিয়েছেন, হত্যাকাণ্ডের ‘মূলহোতা’সহ কয়েকজনকে গ্রেফতার করেছে ডিবি পুলিশ। কলকাতা পুলিশও সন্দেহভাজন দুজনকে গ্রেফতার করেছে।

কী কারণে হত্যা
এমপি আজিমকে হত্যার কারণ সম্পর্কে তার পরিবার, রাজনৈতিক দল, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বা সরকারের পক্ষ থেকে এখনও পর্যন্ত কিছু জানা যায়নি। তবে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) প্রধান ও অতিরিক্ত কমিশনার মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ সাংবাদিকদের বলেন, বিভিন্ন ধরনের ভুল তথ্য ছড়ানো হচ্ছে। আসলে এটা কী কারণে ঘটেছে জানতে আমাদের তদন্ত চলছে। এটা পারিবারিক নাকি আর্থিক, অথবা এলাকায় কোনও দুর্বৃত্ত দমন করার কারণে এমন ঘটনা ঘটেছে কিনা, সবকিছু আমরা তদন্তের আওতায় আনবো।

তিনি বলেন, এটি নিষ্ঠুর হত্যাকাণ্ড— এটা মনে করেই তদন্তকারী কর্মকর্তারা কাজ করছেন। নিবিড়ভাবে ভারতীয় পুলিশের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছি। কয়েকজন আমাদের কাছে আছে, তাদের কাছ থেকে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাচ্ছি। তদন্তের স্বার্থে আমরা সবকিছু বলতে পারছি না।

ঘিরে রাখা হয়েছে সেই বাড়িটি
স্বর্ণ ব্যবসায়ী গোপাল বিশ্বাস সংবাদমাধ্যমে যে বাড়িতে এমপি আনার খুন হয়েছেন বলে জানিয়েছেন, সেই বাড়িটি ঘিরে রেখেছে স্থানীয় পুলিশ। সঞ্জিভা গার্ডেনস নামে একটি আবাসিক আবাসিক ভবনের বিইউ ৫৬ নম্বর রুমে আনোয়ারুল আজীমকে ‘হত্যা’ করা হয়েছে। ঘরের ভেতর পাওয়া গেছে রক্তের ছাপ। সেখানে কাউকে এখন ঢুকতে দেওয়া হচ্ছে না।

পশ্চিমবঙ্গ পুলিশের অ্যান্টি টেরোরিস্ট ইউনিটের কর্মকর্তারা সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, তদন্তে নেমে তারা প্রথমে এমপি আনারকে বহনকারী ক্যাবচালককে আটক করেন। সেই ক্যাবচালক তাদের জানিয়েছেন— এমপি আজিমকে তার গাড়িতে তোলার পর আরও তিনজন গাড়িতে ওঠেন। তাদের মধ্যে দুজন পুরুষ ও একজন নারী। পরে এ চারজন কলকাতা নিউ টাউনের ওই বাড়িতে যান। সিসিটিভি ফুটেজে ওই চারজনকে বাড়িতে প্রবেশ করতে দেখা গেছে। পরে তিনজন বাড়ি থেকে বেরিয়ে এলেও তাদের মধ্যে এমপি আনারকে আর দেখা যায়নি।

ভারতের এটিএফ (অ্যান্টি-টেরোরিজম ফ্রন্ট) কর্মকর্তারা কলকাতার সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, এদের মধ্যে পুরুষ দুজন বাংলাদেশে ফিরে যান। বাংলাদেশের গোয়েন্দা বিভাগকে জানানো হলে তারা সেই দুজনকে গ্রেফতার করে জিজ্ঞাসাবাদ করছে। এ দুইজনের দেয়া তথ্য কলকাতার পুলিশকে জানানো হয়েছে। এরপরই এমপি আনার মৃত্যুর বিষয়ে নিশ্চিত হয় পুলিশ। নিউ টাউনের ফ্ল্যাটের ভেতরে রক্তের দাগ রয়েছে বলেও পুলিশ জানিয়েছে।

ফ্ল্যাটে ঢোকা সেই নারী কে
সিসিটিভি ফুটেজ বিশ্লেষণে দেখা গেছে, সঞ্জিভা গার্ডেন্সের ৫৬ বিইউ ফ্ল্যাটে এমপি আনারের সঙ্গে ঢোকেন পরপর তিনজন। তারমধ্যে একজন নারীও ছিলেন। এ তিনজনকে আবার কিছুক্ষণ পরই কয়েক দফায় বেরিয়েও যেতে দেখা যায়। এছাড়া ওই ফ্ল্যাটে ঢোকার জন্য তড়িঘড়ি করে ৩-৪টি গাড়িও আসা-যাওয়া করে। সেই নারীকে নিয়েও রহস্য দেখা দিয়েছে। আসলে কে তিনি?

জানা গেছে, সেই গাড়ির সূত্র ধরেই এখন তদন্ত চলছে। আরও কিছু অ্যাপ ক্যাবের নেটওয়ার্ক ও তার চালককে এর মধ্যেই আটক করে জিজ্ঞাসাবাদ করছেন গোয়েন্দারা।

দুই দেশের ইস্যু নয়
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী দুজনই বলেছেন, এ হত্যাকাণ্ড দুই রাষ্ট্রের বিষয় নয়। তবে ভারতের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ঘটনা তদন্তে কাজ করছে। কলকাতায় বাংলাদেশ মিশন স্থানীয় পুলিশের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখছে।

স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী জানান, যৌথভাবে দুই দেশের পুলিশ কাজ করছে। তদন্তের স্বার্থে ইন্ডিয়ান পুলিশ আমাদের কাছে যে ধরনের সহযোগিতা চাইছে, তা আমরা দিচ্ছি। এমপি আনার হত্যার ঘটনায় দুই দেশের সম্পর্কের কোনও অবনতি ঘটবে না।

এখনই মন্তব্য করবে না ভারত
বন্ধুপ্রতিম প্রতিবেশী দেশের এমপি ভারতে এসে মারা যাওয়ায় নয়াদিল্লি বেশ অস্বস্তিতে পড়েছেন। তবে এ ব্যাপারে তদন্ত শেষ না হওয়া পর্যন্ত ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এখনই কোনও আনুষ্ঠানিক বিবৃতি দিতে চাইছে না।

এমপি আনার কলকাতায় এসে নিখোঁজ হওয়ার বিষয়টি ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় নিশ্চিত করেছে। তবে আনারকে ঠিক কী পরিস্থিতিতে, কীভাবে, আর কেন হত্যা করা হয়েছে (যদি এটা হত্যাই হয়ে থাকে) তা নিয়ে যেহেতু এখনও অনেক অস্পষ্টতা আছে, তাই সরকারিভাবে ভারত এটা নিয়ে এখনই কোনও মন্তব্য করতে চাইছে না। 

আপন দেশ/এসএমএ

মন্তব্য করুন ।। খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত,আপন দেশ ডটকম- এর দায়ভার নেবে না।

শেয়ার করুনঃ

সর্বশেষ

জনপ্রিয়