
প্রতীকী ছবি
দেশের পরিবহন খাতে চাঁদাবাজির দৌরাত্ম্য থামার নাম নেই। সরকার পরিবর্তনের পর লোক বদলালেও এ অনৈতিক অর্থ আদায়ের প্রক্রিয়া অব্যাহত রয়েছে। ঈদযাত্রার সময় মহাখালী বাস টার্মিনালে গিয়ে দেখা গেছে, প্রতিটি দূরপাল্লার বাসকে টার্মিনাল থেকে বের হওয়ার আগে চাঁদা হিসেবে গুনতে হচ্ছে ৫২০ টাকা।
সোমবার (২৪ মার্চ) সকাল দশটায় মহাখালী বাস টার্মিনাল থেকে ময়মনসিংহগামী এক বাসের চালক জানান, ‘এডিরে কয় জিপি (গেট পাস)। জিপি না দিলে গাড়িই বাইরাতে পারবো না। যাত্রী থাকুক বা না থাকুক, জিপি আমাগো দিতে হয়।’
এ সময় যে ব্যক্তি চাঁদার টাকা তুলছিলেন, তার সঙ্গেও কথা হয়। প্রশ্ন করা হলে তিনি স্পষ্ট জানান, এইডাই এখানকার সিস্টেম। মালিক সমিতির নির্দেশেই এ টাকা তোলা হয়।
পরিবহন খাতে চাঁদাবাজির তথ্য খতিয়ে দেখে জানা গেছে, নতুন সরকারের আমলে বিএনপিপন্থী মালিক ও শ্রমিক সংগঠনগুলো এখন এ খাতের নিয়ন্ত্রক। আওয়ামী লীগের দীর্ঘ ১৫ বছরের শাসনকালে দলটির নেতাদের হাতে থাকা পরিবহন খাতের সিন্ডিকেটের স্থান দখল করেছে বর্তমান ক্ষমতাসীনরা। তবে চাঁদাবাজির ধরন অপরিবর্তিতই রয়েছে।
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)-এর নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, চাঁদাবাজির এ বিশাল অঙ্কের অর্থের প্রভাব পড়ছে পরিবহন ভাড়া ও সেবার মানের ওপর। শুধু ঢাকা শহরের বিভিন্ন টার্মিনাল ও স্ট্যান্ড থেকে প্রতিদিন গড়ে দুই কোটির বেশি টাকা আদায় করা হচ্ছে।
এদিকে, পরিবহন মালিক ও শ্রমিক সংগঠনের বর্তমান নেতারা চাঁদাবাজির অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। তারা দাবি করেন, সংগঠন পরিচালনার জন্য প্রয়োজনীয় খরচের অর্থ হিসেবে এ টাকা নেয়া হচ্ছে। তবে পরিবহন শ্রমিকরা বলছেন ভিন্ন কথা।
এক শ্রমিক জানান, যাত্রী কম থাকলেও মালিক আমাদের কাছ থেকে নির্দিষ্ট অঙ্কের টাকা চান। কারণ তারা নিজেরাই এ চাঁদা দিয়ে থাকেন। ফলে আমাদের বাড়তি আয় না থাকলে নিজেদের পকেট থেকেই টাকা দিতে হয়।
পরিবহন শ্রমিক ও মালিক সংগঠনগুলোর বাইরেও স্থানীয় প্রভাবশালী ব্যক্তি ও রাজনৈতিক দলের নেতাদের পরিবহন চাঁদাবাজির সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগ রয়েছে। পরিবহন শ্রমিকরা জানান, একেক এলাকায় একেক গোষ্ঠী চাঁদা তোলে। এ টাকার বড় অংশ রাজনৈতিক নেতাদের পকেটে যায়।
মেট্রো স্টেশনে হকারদের উৎপাত, মাসে ১০ লাখ টাকা চাঁদাবাজি
সরকার বলছে, পরিবহন খাতে চাঁদাবাজি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা চালাচ্ছে তারা। ‘আমরা ইতোমধ্যেই বিষয়টি নিয়ে বসেছি...পুলিশকে ব্যবস্থা নেয়ার নির্দেশ দিয়েছি। বিআরটিএও কঠোর হচ্ছে,’ বলেন সড়ক পরিবহন ও সেতু উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফওজুল কবির খান। মালিক সংগঠনের কারো বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণিত হলে তার পরিবহনের লাইসেন্স বাতিল করা হবে বলেও জানিয়েছেন উপদেষ্টা।
নেতৃত্বে পালাবদল
আওয়ামী লীগ সরকারের পতন ঘটার কিছু দিনের মধ্যেই দেশের পরিবহন খাতের শীর্ষ নেতৃত্বে বড় ধরনের পরিবর্তন ঘটে গেছে। গত ১৫ বছর ধরে পরিবহন খাত নিয়ন্ত্রিত হতো মূলত মালিক ও শ্রমিকদের তিনটি সংগঠনের মাধ্যমে। সেগুলো হলো: বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতি, ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতি এবং বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশন। এগুলোর মধ্যে ঢাকাসহ সারাদেশের মালিক সমিতির নিয়ন্ত্রণ করতেন ঢাকা মহানগর দক্ষিণ আওয়ামী লীগের নেতা খন্দকার এনায়েত উল্লাহ। তিনি টানা চারবার বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির মহাসচিব পদে ছিলেন। এর মধ্যে তিন দফায় তার সঙ্গে সভাপতি হিসেবে ছিলেন জাতীয় পার্টির নেতা মসিউর রহমান। ৫ আগস্টের পর থেকে মসিউর রহমানকে সেভাবে প্রকাশ্যে দেখা যায়নি। অনেকেরই ধারণা তিনি আত্মগোপনে রয়েছেন।
অন্যদিকে, জুলাই গণঅভ্যুত্থানের আগেই দেশ ছেড়েছেন এনায়েত উল্লাহ। শেখ হাসিনার পতনের পর তিনিও আর দেশে ফেরেননি। এ অবস্থায় ঢাকার ইস্কাটনে অবস্থিত বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির কার্যালয়ের নিয়ন্ত্রণ নেন বিএনপিপন্থী পরিবহন নেতারা।
এরপর মালিকদের জরুরি সভায় সমিতির সভাপতি নির্বাচিত করা হয় ব্যবসায়ীদের সংগঠন এফবিসিসিআইয়ের পরিচালক হাজী আলাউদ্দিনকে। আর মহাসচিব পদে খন্দকার এনায়েত উল্লাহর স্থলাভিসিক্ত হন কুমিল্লা উত্তর বিএনপির আহ্বায়ক সাইফুল ইসলাম।
সাইফুল ইসলাম সম্প্রতি ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতিরও সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হয়েছেন। তার সঙ্গে নতুন সভাপতি হয়েছেন বিএনপিপন্থী নেতা এমএ বাতেন।
একইভাবে, পরিবহন শ্রমিকদের সবচেয়ে শক্তিশালী সংগঠন 'বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনে'র নেতৃত্বেও বড় পরিবর্তন লক্ষ্য করা গেছে। এ ফেডারেশনের অধীনেই রয়েছে দেশটির প্রায় আড়াইশ নিবন্ধিত পরিবহন শ্রমিক সংগঠন।
আওয়ামী লীগ শাসনামলের বেশিরভাগ সময়জুড়েই সংগঠনটির নেতৃত্বে ছিলেন দলটির প্রেসিডিয়াম সদস্য ও সাবেক নৌমন্ত্রী শাজাহান খান। একাধিক মামলায় আসামি হয়ে তিনি এখন কারাগারে রয়েছেন। তার জায়গায় ভারপ্রাপ্ত সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন বিএনপিপন্থী আব্দুর রহিম বক্স। এছাড়া সংগঠনটির সাধারণ সম্পাদক পদে ওসমান আলীর স্থলাভিষিক্ত হয়েছেন আরেক বিএনপি নেতা হুমায়ুন কবির খান।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে হুমায়ুন কবির খান লিখেছেন যে, তিনি বিএনপি'র শ্রম বিষয়ক সহকারী সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। একইভাবে, বাংলাদেশ ট্রাক ও কাভার্ডভ্যান মালিক ও শ্রমিকদের সংগঠনের শীর্ষ নেতৃত্বেও রদবদল হয়ে এখন বিএনপিপন্থীদের আধিপত্য লক্ষ্য করা যাচ্ছে।
৫ আগস্টের আগে বাংলাদেশ ট্রাক ও কাভার্ডভ্যান ড্রাইভার্স ইউনিয়নের সভাপতি ছিলেন আওয়ামী লীগপন্থী শ্রমিক নেতা তালুকদার মোহাম্মদ মনির। সরকার পতনের পর হত্যা মামলার আসামি হয়ে তিনি এখন কারাগারে আছেন।
সংগঠনটির সাধারণ সম্পাদক আবুল কাশেম পাটোয়ারীও গত সাত মাস ধরে আত্মগোপনে রয়েছেন। এ অবস্থায় সংগঠনের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন বর্তমান কমিটির সহ-সভাপতি বশির হাওলাদার। অন্যদিকে, ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক পদে রয়েছেন মোহাম্মদ আলমগীর। তারা দু'জনই বিএনপিপন্থী নেতা বলে সংগঠনের সদস্যরা জানিয়েছেন।
বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির সাবেক মহাসচিব ও আওয়ামী লীগ নেতা খন্দকার এনায়েত উল্লাহর মালিকানাধীন বাসগুলো 'এনা পরিবহন' নামে পরিচিত। ৫ আগস্টের পর ঢাকাসহ অনেক জায়গায় এ পরিবহনের টিকিট কাউন্টার দখল হয়ে গেছে বলে অভিযোগ করেছেন কোম্পানিটির কর্মকর্তারা।
‘আওয়ামী লীগের সময় এনা ছিল সেই দাপট। আর সরকার পড়ে যাওয়ার পরে এখন নামই নেই। সেখানে এখন ইউনাইটেডের কাউন্টার খোলা হইছে,’ বলছিলেন ইউনাইটেডের পাশের কাউন্টারের একজন কর্মচারী।
ইউনাইটেড ট্রান্সপোর্টের কাউন্টারে খোঁজ নিয়ে জানা গেল যে, প্রতিষ্ঠানটি পরিচালনার সঙ্গে ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির নব নির্বাচিত সভাপতি বিএনপিপন্থী নেতা এমএ বাতেন যুক্ত রয়েছেন। তিনি নিজেও বিষয়টি স্বীকার করেছেন। তবে টিকিট কাউন্টার দখলের অভিযোগ অবশ্য অস্বীকার করেছেন তিনি।
বিএনপি সরকারের আমলেই ইউনাইটেড ট্রান্সপোর্ট ছিল ও এ কাউন্টার ইউনাইটেডের নামেই সিটি করপোরেশন থেকে বরাদ্দ দেয়া হয়েছিল, বলেন বাতেন। তিনি আরও বলেন, কিন্তু আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় যাওয়ার পর এনাই এটা জোর করে দখল করেছিল। তখন আমরা প্রশাসনেরও সাহায্য পাইনি। ৫ আগস্টের পরে আমরা আবার এটা বরাদ্দ নিছি।
আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর ঢাকা-ময়মনসিংহ রুটে এনা পরিবহনের বাস চলাচল বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। ওই রুটে এখন ইউনাইটেডের বাস বেশি চলছে বলে জানা গেছে। এ অবস্থায় এনা পরিবহনের দুই শতাধিক বাসের মধ্যে বড় একটি অংশ অলস বসে ছিল। ফলে বাধ্য হয়ে সেগুলো অন্য কোম্পানির নামে রাস্তায় নামানো হয়েছে বলে জানিয়েছেন পরিবহন কোম্পানির কর্মকর্তা-কর্মচারীরা।
ঢাকার তেজগাঁও এলাকায় অবস্থিত ট্রাক স্ট্যান্ডেও প্রতিটি গাড়ি থেকে ১৪০ টাকা করে চাঁদা নিচ্ছেন। আদায়কৃত চাঁদার মধ্যে টার্মিনাল মাঠের নির্মাণ ও উন্নয়ন ফি বাবদ ১০০ টাকা করে নিচ্ছে বাংলাদেশ ট্রাক-কাভার্ডভ্যান মালিক সমিতি। এর বাইরে, শ্রমিক কল্যাণের নামে গাড়িপ্রতি ২০ টাকা নিচ্ছে বাংলাদেশ ট্রাক ও কাভার্ডভ্যান ড্রাইভার্স ইউনিয়ন। এছাড়া স্ট্যান্ডের নিরাপত্তা প্রহরীদের বেতন বাবদ নেওয়া হচ্ছে আরও ২০ টাকা। এভাবে স্ট্যান্ডটি থেকে প্রতিদিন গড়ে চারশ' গাড়ি থেকে চাঁদা নেওয়া হয় বলে কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে।
অন্যদিকে, ঢাকার মহাখালী, গাবতলী ও সায়েদাবাদ বাস টার্মিনাল ঘুরে দেখা গেছে যে, সেখানে গাড়ি ঢোকানো এবং বের করা, উভয়ক্ষেত্রে চাঁদা দিতে হচ্ছে। এর মধ্যে মহাখালী টার্মিনালে গাড়ি ঢোকানোর সময় বাসচালকদের কাছ থেকে ১১০ টাকা করে নিচ্ছেন। ‘এর মধ্যে ৪০ টাকা সিটি করপোরেশনের, ২০ টাকা ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির, কমিউনিটি পুলিশের ২০ টাকা, টার্মিনাল মসজিদের ২০ টাকা ও ১০ টাকা বুকিং মাস্টারের,’ বলছিলেন চাঁদার অর্থ আদায়কারী শহিদুল ইসলাম। তিনি অবশ্য কোনো ধরনের রশিদ ছাড়াই টাকা আদায় করছিলেন।
পরিচয় জানতে চাইলে শহিদুল ইসলাম বলেন, আমি কমিউনিটি পুলিশ হিসেবে কাজ করছি। কর্তৃপক্ষই আমাকে এই (টাকা তোলার) দায়িত্ব দিয়েছে। একইভাবে, টার্মিনাল থেকে বের হওয়ার সময় দূরপাল্লার পরিবহনগুলোকে ছাড়পত্র (জিপি) বাবদ ৫২০ টাকা করে চাঁদা দিতে দেখা গেছে। মহাখালী টার্মিনালে প্রতিদিন গড়ে আটশ'র মতো পরিবহন ঢোকে এবং বের হয় বলে জানিয়েছে কর্তৃপক্ষ।
টার্মিনাল কর্তৃপক্ষের ফি, কাউন্টারের ব্যয়, পরিবহনের শ্রমিক-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা, পরিচ্ছন্নতাকর্মী ও নিরাপত্তারক্ষীদের বেতন, শ্রমিক কল্যাণ তহবিল, মসজিদের খরচসহ নানান খাত দেখিয়ে পরিবহনখাতে প্রতিদিন বিপুল অঙ্কের চাঁদা তোলা হচ্ছে।
এক্ষেত্রে টোকেন, রশিদ, স্টিকার ইত্যাদি ব্যবহার করেই মালিক ও শ্রমিকদের বিভিন্ন সংগঠনের নামে টাকা নেওয়া হচ্ছে। তবে রশিদ ছাড়াও অনেক ক্ষেত্রে চাঁদা তোলা হচ্ছে। এছাড়া সংগঠনের নির্ধারিত চাঁদার পরিমাণের চেয়েও কারো কারো কাছ থেকে বেশি টাকা নেওয়ার অভিযোগও রয়েছে।
‘আমাগো কাছতে এমনে কইরা দশ টাকা, বিশ টাকা বেশি নেয়। আমরা যে এহন বিপদে আছি, হেল্লাইগা,’ বলছিলেন এনা পরিবহনের একজন শ্রমিক। ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার ভয়ে তিনি নিজের নাম প্রকাশ করতে চাননি।
পরিবহনখাতে চাঁদাবাজি নিয়ে সম্প্রতি সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিয়েছে সরকারের একটি গোয়েন্দা সংস্থা। সেখানে চাঁদার অর্থ আদায়ে বিকাশ, নগদের মতো ডিজিটাল ব্যাংকিংয়ের সিস্টেম ব্যবহার হচ্ছে বলে উল্লেখ করা হয়েছে।
চাঁদা তোলা হয় কত?
পরিবহন খাতে কী পরিমাণ চাঁদাবাজি হয়, সেটার একটি ধারণা পাওয়া যায় দুর্নীতিবিরোধী বেসরকারি সংস্থা ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) একটি গবেষণা প্রতিবেদন থেকে। গত বছরের মার্চে প্রকাশিত ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে যে, বাংলাদেশে শুধুমাত্র ব্যক্তিমালিকানাধীন বাস ও মিনিবাস থেকে বছরে প্রায় এক হাজার ৫৯ কোটি টাকা চাঁদাবাজি হয়। তবে বাস্তবে যে চাঁদাবাজির পরিমাণ আরও বেশি, গবেষণায় সেটাও উল্লেখ করেন তারা।
অন্যদিকে, গোয়েন্দা সংস্থার পক্ষ থেকে সম্প্রতি সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ে যে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেয়া হয়েছে, সেখানে বলা হয়েছে যে, কেবল ঢাকা শহরের অবস্থিত অর্ধশতাধিক পরিবহন টার্মিনাল ও স্ট্যান্ড থেকে প্রতিদিন গড়ে প্রায় দুই কোটি ২১ লাখ টাকা চাঁদাবাজি হয়।
মাস শেষে সে চাঁদার টাকার পরিমাণ ৬৬ কোটি থেকে বেড়ে মাঝে মধ্যে ৮০ কোটি পর্যন্ত পৌঁছায় বলেও তদন্ত প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।
কারা এ চাঁদাবাজির সঙ্গে জড়িত, সে ব্যাপারে টিআইবি'র প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল যে, মালিক-শ্রমিক সংগঠন, রাজনৈতিক পরিচয়ধারী ব্যক্তি বা গোষ্ঠী, ট্রাফিক ও হাইওয়ে পুলিশ, বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) কর্মকর্তা-কর্মচারী এবং পৌরসভা ও সিটি কর্পোরেশনের প্রতিনিধিরা পরিবহনখাতের চাঁদার ভাগ পান।
গবেষণায় এটাও উঠে এসেছিল যে, দেশের বড় বাস কোম্পানিগুলোর মধ্যে প্রায় ৯২ শতাংশের পরিচালনার সঙ্গেই রাজনীতিবিদরা সম্পৃক্ত। এর মধ্যে ৮০ শতাংশ রাজনীতিবিদই ক্ষমতাসীন দলের সঙ্গে যুক্ত।
তবে ৫ আগস্টের পর পরিবহনে চাঁদাবাজির ক্ষেত্রে পুলিশের অংশগ্রহণ একেবারে কমে গেছে বলে গোয়েন্দাদের সাম্প্রতিক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। ফলে চাঁদাবাজির টাকা এখন মূলত পরিবহন মালিক ও শ্রমিক সংগঠন, স্থানীয়ভাবে প্রভাবশালী ব্যক্তি, রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মী, সিটি কর্পোরেশনের কর্মকর্তা-কর্মচারী ও চাঁদা আদায়কারী ব্যক্তিদের মধ্যে ভাগ হচ্ছে তদন্তে উঠে এসেছে।
টার্মিনালগুলোর বাইরে ঢাকায় ৩৭টি লেগুনা স্ট্যান্ড, চারটি ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা, তিনটি সিএনজিচালিত অটোরিকশা এবং একটি মাইক্রোবাস স্ট্যান্ড রয়েছে। এসব জায়গায় থেকে চাঁদা আদায়ের সঙ্গে স্থানীয়ভাবে প্রভাবশালী ব্যক্তি ও রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীরা জড়িত বলে জানা যাচ্ছে।
কারওয়ান বাজারে মালামাল নিয়ে আসা গাড়িগুলো থেকেও নেওয়া হয় চাঁদা। বিএনপি ও এর অঙ্গ সংগঠনের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে চাঁদাবাজির সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগ বেশি বলে গোয়েন্দা প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। সরেজমিনে খোঁজ নিতে গিয়েও একই ধরনের অভিযোগ পাওয়া গেছে।
অভিযুক্তরা কী বলছেন?
মালিক ও শ্রমিকদের সংগঠনগুলো চাঁদাবাজির অভিযোগ অস্বীকার করছে। সে সঙ্গে দাবি করেছেন, চাঁদাবাজি ছিল আওয়ামী লীগ আমলে। তখন সমিতির নামে চাঁদাবাজি উঠাইতো বিভিন্ন জায়গায়। আমরা দায়িত্ব নেয়ার পরে সেটা বন্ধ করে দিয়েছি। আমরা ঘোষণা করে দিছি যে, ঢাকা পরিবহন সমিতির নামে কোনো চাঁদা ওঠানো যাবে না, বলেন ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির সভাপতি এমএ বাতেন।
তাহলে টার্মিনালগুলোতে বাস থেকে যে টাকা আদায় করা হচ্ছে, সেগুলো কী? ‘যেটা দেখছেন, সেটা চাঁদা না। সেটা হলো পরিচালনা ব্যয়। অফিসভাড়া, বেতন, টিকেট, কর্মচারী ইত্যাদি খরচের জন্য কোম্পানিগুলো এটা তোলে,’ বলেন বাতেন।
‘আওয়ামী লীগ আমলে যেখানে দেড়-দুই হাজার টাকা করে নেওয়া হতো, আমরা এখন সেটা ৩০০-৩৫০ টাকা নির্ধারণ করে দিয়েছি,’ বলেন এ বাস মালিক নেতা।
যদিও টার্মিনালভেদে অনেক সময় চাঁদার অঙ্ক কিছুটা কম-বেশি হয় বলে জানিয়েছেন তিনি। ‘এক্ষেত্রে গাড়ির সংখ্যা, স্টাফ ইত্যাদি হিসাব করে এটা নির্ধারণ করা হয়,’ বলেন বাতেন।
ট্রাক-কাভার্ডভ্যান মালিক সমিতিও একই কথা বলছে। ‘ট্রাক স্ট্যান্ডের উন্নয়ন কাজে যে খরচ হয়েছে, সেটার জন্যই একশ টাকা করে নেওয়া হয়। বাকিটা সংগঠনের কাজে ও শ্রমিকদের কল্যাণে ব্যয় করা হয়,’ বলেন বাংলাদেশ ট্রাক-কাভার্ডভ্যান মালিক সমিতির সভাপতি তোফায়েল হোসেন মজুমদার।
তবে পরিবহন মালিক সংগঠনের এসব ব্যাখ্যা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে দুর্নীতিবিরোধী বেসরকারি সংস্থা ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ। বিষয়টা যেভাবেই মালিক সমিতি ব্যাখ্যা করুক না কেন, বাস্তবে যুক্তিটা কতটুকু যথার্থ সেটা নিয়ে মূল প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে,’ বলেন টিআইবি'র নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান। সূত্র: বিবিসি বাংলা
আপন দেশ/এমবি
মন্তব্য করুন ।। খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত,আপন দেশ ডটকম- এর দায়ভার নেবে না।