
ছবি: আপন দেশ
একটা সময় ছিল, যখন প্রকৌশল অধিদফতর (ইইডি) মানেই ছিল দক্ষতা, পরিকল্পনা আর অবকাঠামো উন্নয়নের নির্ভরযোগ্য ঠিকানা। আজ সেটাই হয়ে উঠেছে তদবির, তোষামোদি আর “হ্যাঁ স্যার” বলার প্রতিযোগিতার মাঠ। যেখানে সিন্ডিকেটই এখন সিনিয়রদের ভাগ্য নির্ধারণ করে, আর ফাইল ঘষা নয়—মুখ ঘষা হলেই মিলছে পদোন্নতি।
যোগ্যতা নয়, প্রমোশনের শর্ত এখন ‘কাকে চেনো’ আর ‘কার কথায় ওঠ বস করো’। সিনিয়রদের সুপারসিড করে জুনিয়রদের বসানো হচ্ছে শীর্ষ পদে, আর অভিজ্ঞরা পড়ে থাকছেন নীরব বঞ্চনার কবরখানায়। পুরো অধিদফতর যেন পরিণত হয়েছে এক ‘হুকুমের হুকুমত’-এ, যেখানে যোগ্যতা নয়, আনুগত্যই শেষ কথা।
ঘটনাস্থল শিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং প্রকৌশল অধিদফতর (ইইডি )। জাতীয় বাজেটের বেশ বড় অংশই ব্যয় হয় শিক্ষা অবকাঠামো উন্নয়নে। যা বাস্তবায়ন ঘটে দু’দফতরের মাধ্যমে। বড় অঙ্কের ঘুষ দিয়ে, তদবির করে, সিনিয়রদের ডিঙ্গিয়ে প্রধান প্রকৌশলীর পদে বসছেন। নেতা-ভজন আর দলবাজির মহৌষধে অপেক্ষাকৃত জুনিয়র বাগিয়ে নিচ্ছেন লোভনীয় পদটি। আর দক্ষ, অভিজ্ঞ এবং অপেক্ষাকৃত স্বচ্ছ প্রকৌশলীরা দিন পার করছেন ক্ষোভ, হতাশায়। বিষয়গুলো নিয়ে সংশ্লিষ্ট দু’দফতরে আলোচনা হলেও ফলাফল শূন্য।
এদিকে সুপারসিড করে জুনিয়র প্রকৌশলী উচ্চ আসনে বসার কারণে সিনিয়ররা পাত্তা দিতে চাচ্ছেন না জুনিয়রকে।
আরও পড়ুন<<>> ছয় সিনিয়র ডিঙ্গিয়ে ইইডির প্রধান হলেন প্রকৌশলী আলতাফ
শীর্ষ পদের প্রকৌশলীও ভীত শক্ত রাখতে নিজস্ব সিন্ডিকেট গড়ে তুলছেন। নিয়ন্ত্রণের বাইরে থাকা কর্মকর্তাদের কব্জায় আনতে লঘু অপরাধে দিচ্ছেন গুরুদণ্ড। আর বঙ্গবন্ধু প্রকৌশল পরিষদ ইইডি শাখার ১৮জন নেতাকে নির্বাহী প্রকৌশলী হিসেবে দিয়েছেন পদোন্নতি। পোস্টিং দিয়েছেন ঢাকা, মানিগঞ্জসহ রাজধানীর আশপাশে। সকাল থেকে রাত ১২টা নাগাদ রাখা হয় অফিসে। চলে ফাইল ঘষামাজার কাজ। তাতে বিরক্তবোধ করছেন প্রকৌশলীরা।
অন্যদিকে বঞ্চিতদের পাশাপাশি ওএসডি হওয়া কর্মকর্তারাও নানামুখী কৌশল অবলম্বন করছেন। কেউ দল, কেউ ধর্মীয় সংগঠনকেও ব্যবহার করছেন। সব কিছু মিলিয়ে উন্নয়ন কাজের বদলে প্রতিশোধ আর প্রতিরোধমূলক কাজ হচ্ছে বেশি। কয়েক পদ বছরের পর বছর পার হলেও শূন্যপদে কর্মকর্তা বসানো হচ্ছে না। নেপথ্যের অন্যতম কারণ পদশূন্য থাকলে প্রধানের পকেটে উঠে দ্বিগুণ পিসি।
বিরাজমান পরিস্থিতির কথা জানতে চাইলে- অধিদফতরের কর্মকর্তা থেকে শুরু করে কর্মচারী সবারই একই কথা, ‘এখানে অস্থির অবস্থা চলছে, কে কার বিরুদ্ধে কখন কী করছে বুঝাই মুশকিল’।
রীতিনীতি যখন সুপারসিড
ইইডিতে অধিদফতরে প্রধান প্রকৌশলী হিসেবে বর্তমানে আছেন মো. আলতাফ হোসেন। এর আগে ছিলেন- মো. জালাল উদ্দিন চৌধুরী (৬), রায়হান বাদশা, দেলোয়ার হোসেন মজুমদার, শাহ নাইমুল কাদের, আরিফুর রহমান (৬), বুলবুল আখতার, দেওয়ান মো. হানজালা, আব্দুল্লাহিল আজাদ, মিজানুল করিমসহ ডজন প্রধান প্রকৌশলীর আমলনামা ঘাটলে পাওয়া যায় অধিকাংশই প্রধান প্রকৌশলীল দায়িত্ব পেয়েছেন তদবির, সুপারসিড করেই। এর মধ্যে বর্তমান প্রধান প্রকৌশলীর মো. আলতাফ হোসেন, তার আগে জালাল উদ্দিন চৌধুরী আরিফুর রহমান প্রত্যেকেই পদ বাগিয়েছেন ছয়জনকে পেছনে ফেলে। আবার অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলীর পদে বসেছিলে সুপারসিড করেই।
আরও পড়ুন<<>> জামালপুর জনস্বাস্থ্যে দুর্নীতির কিংপিন সুলতান, আমিনুল, হোয়াইট বাবু
বঞ্চিত একাধিক সিনিয়র বলেন, এ বিষয়টি শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের যাদের দেখার বা বিচার করবার কথা তাই সুবিধা নিয়ে অনৈতিক কাজগুলো করেছেন। অনৈতিক সুবিধা না নিলে এখানের চিত্র ভিন্ন হতো।
পিসির লোভে পদশূন্য: অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী ও দফতরের হিসাব বিভাগের দুইশূন্যপদ সহ অধিদফতরের তিনটি গুরুত্বপূর্ণ পদ শূন্য দীর্ঘদিন ধরে। তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী ছিলেন আফরোজা বেগম, আর হিসাব বিভাগে ছিলেন আবুল হাসেম সরদার। আফরোজা বেগম ওএসডি। হাসেম সরদার অবসরে। তবে এ পদগুলোতে কর্মকর্তা বসানো হচ্ছে না। এ নিয়ে জানা গেছে, প্রধান প্রকৌশলীর দায়িত্বপ্রাপ্তজন ওই পদের কর্মকর্তাকে আসন্ন প্রতিদ্বন্দ্বী মনে করেন। এছাড়াও ওই পদের জন্য নির্ধারিত ১% পিসিও মিলে। যে কারণে ওই পদসহ চলতি দায়িত্বকে মিলিয়ে আর্থিক কমিশনও পান ২%। আর আটজনকে ডিঙ্গিয়ে প্রধান হিসাবরক্ষক আবু সাঈদের সঙ্গে প্রধানের হিসেব-নিকেশের ফর্দটাও দীর্ঘ হয়। অন্যদিকে তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী (এসি) মাহবুবুর রহমানকে এখনকার ঠিকাদারগণ চিনেন ‘ চীফ ইঞ্জিনিয়ারের ক্যাশিয়ার’ হিসেবেই।
বঞ্চিত-ওএসডিদের তৎপরতা:
বছরের পর বছর ধরে ইইডির অনেক কর্মকর্তা বৈষম্য-বঞ্চনার শিকার। চাকরির বয়স অবসরের কাছাকাছি এলেও উচ্চপদে বসার স্বপ্ন স্বপ্নই থেকে যাচ্ছে। পদোন্নতি পেয়ে বৈধ আর্থিক সুযোগ সুবিধাসহ সামাজিক মর্যাদার আমায় শুধুই দিন গুনছেন তারা। তদবির, দলবাজি, ঘুষ নয় তারা চান দক্ষতা ও অর্জিত অভিজ্ঞতার ডাক পড়বেই। কিন্তু গত একযুগে এমন নজির নেই।
এদিকে ওএসডি থাকা সাবেক প্রধান প্রকৌশলী রায়হান বাদশাসহ আফরোজা বেগম ও সমীর কুমার রজক দাস নিজ নিজ কৌশলে এগুচ্ছেন। নির্ভরযোগ্য সূত্রের দাবি, সমীর কুমার রজক দাস ইতোমধ্যে রামকৃষ্ণ মিশনের শীর্ষপদে থাকা আদর্শিক নেতৃবৃন্দকে বিষয়টি অবহিত করেছেন। তিনি অভিযোগ করেছেন, তার প্রতি অন্যায় করা হয়েছে। ওএসডি আদেশ প্রত্যাহারসহ নিয়মিত প্রোমোশন হলে তিনি অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলীর পদ পাবেন। উত্তরবঙ্গের বাসিন্দা হিসেবে রায়হান বাদশাও একজন উপদেষ্টার কাছে ধরনা দিচ্ছেন। আফরোজা বেগমও মনে করেন ওএসডি আদেশ উঠে গেলে অটো তিনি চাকরি জীবনের শেষ স্বপ্নের প্রধান প্রকৌশলীর চেয়ার পাবেন।
চেইন অব কমান্ড ভেঙ্গে পড়েছে
তদবির করে সুপারসিড করে দুইপদ বাগানো প্রধান প্রকৌশলী আলতাফ হোসেনকে মানতে চাচ্ছেন না অনেক সিনিয়-মধ্যসারির কর্মকর্তারা। জেলার এক্সেনদেরকে নির্দেশনা দিলে তা প্রতিপালন করছেনও না। তাই প্রধান কার্যালয়ের ১৫/২০ কর্মকর্তার সমন্বয়ে টিম নিয়ে যাচ্ছেন জেলা-বিভাগে। মিটিং করে কাউকে সহজ ভাষায়, কাউকে শাস্তির ভীতি প্রদর্শন করছেন। ইতোমধ্যে তিনি অর্ধডজন জেলায় গাড়ির বহর নিয়ে পিকনিক মোডে সফর করেছেন। আরও যাওয়ার দিনক্ষণ ঠিক রেখেছেন।
ভিডিও ফাঁস, দুর্নীতি লালনের অভিযোগ
এদিকে মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, প্রকৌশলী আলতাফ হোসেনের বিরুদ্ধে পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের এমপি-মন্ত্রী ও নেতাদের সঙ্গে সখ্যতা রাখার বিষয়টি স্পষ্ট হয়েছে। বগুড়ার বাসিন্দা একজন বিএনপি নেতা একটি ভিডিও ক্লিপ মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট দফতরে দিয়েছেন। যেখানে আলতাফ হোসেন আওয়ামী লীগের প্রয়াত নেতা আব্দুর রহমানের নির্বাচনী মঞ্চে বক্তব্য দিচ্ছেন, নৌকা প্রতীকে ভোট চাইছেন, শেখ হাসিনার হাতকে শক্তিশালী করোর আহবান জানিয়েছেন।
অভিযোগকারী ওই নেতার দাবি- সকল দফতরের প্রধান যখন স্বৈরাচারের দোসর দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে শ্বেতপত্র করছেন তখন প্রধান প্রকৌশলী মো. আলতাফ হোসেন বঙ্গবন্ধু প্রকৌশল পরিষদ নেতা-ইইডির দুর্নীতিবাজ হিসেবে পরিচিত সিরাজুল ইসলাম, জাফর আলী শিকদারসহ কয়েজ ডজন প্রকৌশলীর অপকর্ম ধামাচাপা দিতে আশপাশের জেলায় গুরুত্বপূর্ণ পদে বদলি করছেন।
আপন দেশ/এবি
মন্তব্য করুন # খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, আপন দেশ ডটকম- এর দায়ভার নেবে না।