ফাইল ছবি
প্রায় এক সপ্তাহ ধরে সারাদেশে দাবদাহ বইছে। এর মাঝে সিলেট ও মৌলভীবাজারে সামান্য বৃষ্টি হয়েছে। ঢাকাসহ চার বিভাগে বৃষ্টি হওয়ার পূর্বাভাস দিয়েছে আবহাওয়া অধিদফতর। ঢাকার তাপমাত্রা কমে এসেছে।
সারাদেশে বেড়েছে শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ যন্ত্রের বিক্রি। বিদ্যুৎ উৎপাদনে সুখবর এসেছে। তবু লোডশেডিংয়ের কবল থেকে মুক্তি মেলেনি। দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে লোডশেডিং হওয়ার খবর পাওয়া যাচ্ছে। তীব্র গরম ও রমজানের এই সময় লোডশেডিংয়ে অতিষ্ঠ জনজীবন।
সোমবার (১৭ এপ্রিল) বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি) ১৫ হাজার ৬০৪ মেগাওয়াট বিদ্যুতের উৎপাদনের রেকর্ড করে। কিন্তু ওই রেকর্ডের দিনেও সর্বোচ্চ চাহিদা ছিল ১৬ হাজার ২২১ মেগাওয়াট, যা পূরণ করা সম্ভব হয়নি।
ঠিক পরের দিন মঙ্গলবার (১৮ এপ্রিল) বিদ্যুৎ উৎপাদনে আবোরো রেকর্ড করে বাংলাদেশ। ওইদিন দেশে ১৫ হাজার ৬২৬ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন হয়েছে।
গ্রীষ্মের উষ্ণতম দিনগুলোতে বিদ্যুতের চাহিদা বৃদ্ধির কথা মাথায় রেখে এপ্রিল থেকে জুন মাস পর্যন্ত প্রতিদিন পিক আওয়ারে (দিনের যে সময় সর্বোচ্চ চাহিদা হয়) গড়ে ১৬ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের পরিকল্পনা করেছিল সরকার।
পিডিবির ওয়েবসাইটে প্রকাশিত তথ্য অনুসারে, গত সপ্তাহে পিক আওয়ারে দেশে এক হাজার থেকে দেড় হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুতের ঘাটতি ছিল।
বিদ্যুৎ বিতরণ সংস্থাগুলোর মতে, বিদ্যুৎ থাকছে না—এই পরিস্থিতি বেশিরভাগই গ্রামীণ এলাকায় দেখা যাচ্ছে।
এতে মুসলমানদের সিয়াম সাধনার মাস রমজানে মানুষ শুধু প্রচণ্ড গরমে ভুগছে না-তারা বোরো ধানের খেতে সেচ দেয়ার জন্য পানির পাম্পও চালাতে পারছে না।
গত কয়েকদিনে ফেনী ও ময়মনসিংহের একাধিক স্থানে শতাধিক বিক্ষুব্ধ মানুষ নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুতের দাবিতে বিক্ষোভ করেছেন।
শঙ্কিত হয়ে ময়মনসিংহ পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি-৩-এর মহাব্যবস্থাপক মোহাম্মদ আবুল কালাম আজাদ জেলা পুলিশ সুপারের কাছে একটি চিঠি লিখেছেন। চিঠিতে তিনি বৈদ্যুতিক উপকেন্দ্র বা স্থাপনাসমূহ ও তার সহকর্মীদের জান-মালের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার অনুরোধ জানিয়েছেন।
তীব্র গরমের সময় অসহনীয় লোডশেডিংয়ের কারণে সম্মানিত গ্রাহকগণ দুর্ভোগের শিকার হচ্ছেন এবং সেচ কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে, চিঠিতে লেখেন তিনি।
দেশের একাধিক জেলার মানুষ জানাচ্ছেন, দিনে ১০ থেকে ১৯ বার পর্যন্ত বিদ্যুৎ চলে যায়। দিনে মোট তিন থেকে ছয় ঘণ্টা বিদ্যুৎ পাচ্ছেন না তারা।
গ্রামাঞ্চলে বিদ্যুৎ সরবরাহ করে বাংলাদেশ পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ডের (আরইবি) অধীনে পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি। পিবিএস কর্মকর্তারা বলছেন, গ্রাহকদের চাহিদার তুলনায় বিদ্যুৎ সরবরাহ ২০ থেকে ৫০ শতাংশ কম।
রমজানের প্রথম তিন সপ্তাহ ঢাকা মহানগরীসহ অন্যান্য শহরাঞ্চলে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ নিশ্চিত করেছে সরকার। রাজধানীবাসীকে এখনো চরম ভোগান্তিতে পড়তে হয়নি। কিন্তু দিনে দিনে গরমের তীব্রতা যতই বাড়ছে, অন্য শহরগুলোতে ভোগান্তি বাড়ছে।
দেশের মোট বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা ২২ হাজার ৫৬৬ মেগাওয়াট। কিন্তু কিছু কিছু বিদ্যুৎকেন্দ্র রক্ষণাবেক্ষণ বা জ্বালানি সংকটের কারণে বন্ধ রাখতে হয় বলে জানান পিডিবির মুখপাত্র শামীম হাসান। তিনি বলেন, 'আমরা আমাদের পরিকল্পনা মতোই বিদ্যুৎ উৎপাদন করছি। প্রতিনিয়ত রেকর্ড উৎপাদন হচ্ছে। কিন্তু এখন মূল সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে অতিরিক্ত গরম। এই সময় এত গরম পড়বে, সেটা ধারণারও বাইরে ছিল।'
টাঙ্গাইলের কৃষকরা জানিয়েছেন, সেচের অভাবে বোরো ধানের ক্ষতির আশঙ্কা করছেন তারা। সখীপুর উপজেলার বাসিন্দা সিরাজুল ইসলাম বলেন, 'তীব্র গরমে ধানের ব্লাস্ট রোগ (ছত্রাক থেকে হওয়া) রোধে প্রচুর সেচ দিতে হয়। কিন্তু ঘন ঘন বিদ্যুৎ বিভ্রাট এবং কম ভোল্টেজের কারণে আমরা প্রয়োজনীয় পানি সেচ দিতে পারছি না।'
টাঙ্গাইল শহরের দিঘুলিয়া এলাকার বাসিন্দা মিলকান খান বলেন, সোমবার ভোররাত ১২টা থেকে দুপুর ১২টা পর্যন্ত তিনি ১৯ বার বিদ্যুৎ গেছে।
'বিদ্যুৎ যায় না, মাঝে মাঝে আসে'—বিদ্যুতের পরিস্থিতি সম্পর্কে জানতে চাইলে এমন মন্তব্য করেন সাতক্ষীরার কালীগঞ্জ উপজেলার গোবিন্দপুর গ্রামের বাসিন্দা মতিয়ার রহমান।
সাতক্ষীরার তালা উপজেলার বর্ষা গ্রামের বাসিন্দা লিয়াকত আলী জানান, এই প্রচণ্ড গরমে তার দুই সন্তান অসুস্থ হয়ে পড়েছে।
ওই গ্রামের আরেক বাসিন্দা মো. আইয়ুব বলেন, ‘দিনের বেলা বাড়ি থেকে বের হলে আগুনে পুড়ে যাওয়ার অনুভূতি হয়। আর বিদ্যুৎ চলে যাওয়ার কারণে রাতে বাড়িতে থাকাও সমান কষ্টকর। মনে হয় সেদ্ধ হয়ে যাচ্ছি।’
গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জ উপজেলার রাজোশ গ্রামের একটি সেচ পাম্পের মালিক আব্দুর রউফ জানান, সোমবার রাতে তিন বার বিদ্যুৎ চলে গিয়েছিল।
‘এই অবস্থা চলতে থাকলে আমরা সঠিক সময়ে আমাদের উৎপাদিত পণ্য সরবরাহ করতে পারব না,’ বলেন আল মদিনা মেটাল অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের স্বত্বাধিকারী আবদুল মালেক।
‘দিনে পাঁচ থেকে ছয় বার বিদ্যুৎ চলে যায়। নির্ধারিত কোনো সময় সূচি নেই। রাতে বারবার বিদ্যুৎ চলে যাওয়ায় আমরা ঘুমাতে পারি না,' বলেন পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির আওতাধীন পাবনা সদর উপজেলার গাসপাড়া গ্রামের বাসিন্দা মো. আব্দুল লতিফ।
রংপুর জোন-৩-এর নর্দান ইলেকট্রিসিটি সাপ্লাই কোম্পানি লিমিটেডের (নেসকো) নির্বাহী প্রকৌশলী মাহাবুবুল হক বলেন, ‘জোনের অধীনে দৈনিক চাহিদা প্রায় ১৪ মেগাওয়াট কিন্তু গত তিন দিন ধরে দৈনিক মাত্র নয় মেগাওয়াট বিদ্যুৎ পাওয়া যাচ্ছে।’
ভোক্তা অধিকার সংগঠন কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব) বলছে, জানুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত তিন দফায় বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হয়েছে। গত ১৪ বছরে পাইকারি পর্যায়ে ১১ বার ও ভোক্তা পর্যায়ে ১৩ বার বাড়ানো হয়েছে বিদ্যুতের দাম। তবু গরমে কষ্ট পাচ্ছেন মানুষ।
ক্যাবের জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি এম শামসুল আলম বলেন, দফায় দফায় দাম বাড়িয়েও নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ নিশ্চিত করতে পারেনি সরকার। বিদ্যুতের ঘাটতি গ্রামে পাঠিয়ে দেন কর্তারা। সমতার ভিত্তিতে বণ্টন করলে এটি সহনীয় হতো। আর সমাজের সুবিধাভোগীরা বিদ্যুৎ বিভ্রাটে পড়লে এ খাতের সমস্যারও সমাধান হবে। এখন গরম থেকে স্বস্তি পেতে বিদ্যুৎ নয়, বৃষ্টির ভরসায় থাকতে হবে।
জ্বালানি বিশেষজ্ঞ এবং বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) অধ্যাপক বদরুল ইমাম বলেন, ‘যার ওপর ভর করে এই গ্রীষ্ম কাটাবো বলে আমরা আশা করছিলাম, সেই রামপালের অর্ধেকটা বসে আছে। বিদ্যুৎ নিয়ে আমরা অনেক কথা শুনেছি, কিন্তু আমাদের বিদ্যুৎ উৎপাদনের যে ধারা, সেখানে খুব বেশি উন্নতি কিন্তু দেখা যাচ্ছে না। লোডশেডিং থেকে বের হতে পারছি না। তিনি মনে করেন, আগের কবছরের তুলনায় এবছরে তীব্র দাবদাহ তৈরি হওয়ায় বিদ্যুতের চাহিদার সঙ্গে সরবরাহের ঘাটতি তৈরি হয়েছে, সেটি লোডশেডিংয়ের একটা বড় কারণ। তিনি বলেন, আমরা যেটি আশা করেছিলাম, বড় বড় বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো, পায়রা, রামপাল -যেগুলো এই গ্রীষ্মে আমাদের সংকট মেটাবে। কিন্তু সেটি তো দেখা যাচ্ছে না। এই দুটি মিলিয়ে আমার মনে হয় বর্তমান সমস্যাটি বড় হয়ে উঠেছে।
বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ মঙ্গলবার (১৮ এপ্রিল) তার ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে বিদ্যুতের ঘাটতির জন্য দুঃখ প্রকাশ করেন। তিনি লিখেছেন, এ বছর গ্রীষ্ম, সেচ মৌসুম এবং রোজা একসঙ্গে হওয়াতে বিদ্যুতের চাহিদা সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছবে সেটি আমরা আগেই ধারণা করেছিলাম। বাংলাদেশের ইতিহাসে রেকর্ড বিদ্যুৎ উৎপাদনের মাধ্যমে আমরা আমাদের পূর্ব প্রস্তুতির স্বাক্ষরও রেখেছি। কিন্তু গত ৫০ বছরের তাপমাত্রার রেকর্ড ভেঙে বর্তমানে যে নজিরবিহীন দাবদাহ চলছে তাতে ধারণার চেয়েও বিদ্যুতের চাহিদা অনেক বেশি বেড়ে গেছে। সাধারণ মানুষ, বিশেষত শিশু ও বয়স্কদের প্রতি তিনি সহমর্মিতা প্রকাশ করে বলেন, 'পরিস্থিতি উত্তরণে বিদ্যুৎ বিভাগ সর্বাত্মক কাজ করছে।'
আপন দেশ/আরএ
মন্তব্য করুন ।। খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত,আপন দেশ ডটকম- এর দায়ভার নেবে না।