পায়রা তাপবিদ্যুৎকেন্দ্র, ফাইল ছবি
রোববার (৪ জুন) দিবাগত মধ্যরাত থেকে পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যাচ্ছে দেশের বৃহত্তম ও সর্বাধুনিক পায়রা তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র। ডলার সংকটের কারণে কয়লার দাম দিতে না পারায় প্রায় এক মাসের জন্য এই বিদ্যুৎকেন্দ্রটির বিদ্যুৎ উৎপাদন বন্ধ থাকবে বলে জানান সংশ্লিষ্টরা। এর প্রভাব ঢাকা, বরিশাল ও খুলনাসহ সব জায়গায় থাকবে। বিদ্যুৎকেন্দ্রটি বন্ধ হলে জাতীয় গ্রিডে অন্তত এক হাজার ২০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ ঘাটতির আশঙ্কা রয়েছে। এতে দেশে ভয়াবহ লোডশেডিং দেখা দিতে পারে।
আগে রাজধানী ঢাকায় লোডশেডিং তেমন না হলেও এখন বিভিন্ন এলাকায় লোডশেডিং বেড়েছে। দিনে চার-পাঁচবার করে বিদ্যুৎ থাকছে না। দেখা যায় দৈনিক সর্বোচ্চ পাঁচ-সাত ঘণ্টা বিদ্যুৎহীন থাকে নগরী। জেলা শহর ও গ্রামের অবস্থা আরও শোচনীয়। কোথাও কোথাও ১২ থেকে ১৫ ঘণ্টা লোডশেডিংয়ের খবর পাওয়া গেছে। তীব্র গরমে বিদ্যুৎ না থাকায় শিশু ও বয়স্কদের অনেকে অসুস্থ হয়ে পড়ছে।
বিদ্যুৎ ভোগান্তি বেড়ে যাওয়ার কথা উল্লেখ করে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বলেন, ‘এ সংকট আরও কিছু দিন থাকবে।’ তিনি বলেন, ‘পায়রা তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের একটি হাফ বন্ধ আছে এবং আমাদের সেকেন্ড হাফও ৫ জুনের পর বন্ধ হয়ে যাবে। কারণ, এখানে কয়লার অভাব দেখা গেছে এবং এটি আসতে ২০-২৫ দিন লেগে যাবে।’
সংশ্লিষ্টরা জানান, দীর্ঘদিন ধরে বাকিতে কয়লা এনে বিদ্যুৎকেন্দ্রটি সচল রাখা হয়েছিল। এর আগে কয়লা সংকটে ২৫ মে বিদ্যুৎকেন্দ্রটির একটি ইউনিট বন্ধ হয়েছিল। কয়লার মজুত ফুরিয়ে যাওয়ায় অবশিষ্ট ইউনিটও বন্ধ হতে যাচ্ছে। মূলত ডলার সংকটে বিদেশ থেকে কয়লা আনা যাচ্ছে না। বিদ্যুৎকেন্দ্রটির দেনা প্রায় ৩৬ কোটি ডলার। এই বকেয়া পরিশোধ না করলে নতুন করে কয়লা আনা সম্ভব হবে না।
পায়রা এক হাজার ৩২০ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন বিদ্যুৎকেন্দ্রটি থেকে শতভাগ বিদ্যুৎ উৎপাদনে প্রতিদিন অন্তত ১৩ হাজার টন কয়লা পোড়াতে হয়; যা ইন্দোনেশিয়া থেকে আমদানি করত কর্তৃপক্ষ। কয়লা সংকট কাটাতে সংশ্লিষ্টরা কয়েক দফা বৈঠকও করেছেন। কিন্তু তাতে কোনো সমাধান মেলেনি।
সূত্র জানায়, বাংলাদেশের সরকারি প্রতিষ্ঠান নর্থওয়েস্ট পাওয়ার জেনারেশন কোম্পানি ও চীনের সরকারি প্রতিষ্ঠান সিএমসির মাধ্যমে বিদ্যুৎকেন্দ্রটি পরিচালনা করা হতো। পরে দুই প্রতিষ্ঠানের সমান মালিকানায় বাংলাদেশ-চীন পাওয়ার কোম্পানি লিমিটেড (বিসিপিসিএল) নামে আলাদা একটি প্রতিষ্ঠান গঠিত হয়। বিগত দিনে পায়রা তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রকে ছয় মাস বাকিতে কয়লা দিয়েছে সিএমসি। পরে আরও তিন মাসের বকেয়াসহ নয় মাসে বকেয়ার পরিমাণ দাঁড়ায় অন্তত ৩৯ কোটি ডলার। এই বকেয়া ডলার সংকটের কারণে পরিশোধ করতে পারেনি কর্তৃপক্ষ। যে কারণে চীন থেকে কয়লা আমদানি বন্ধ করে দেয়া হয়। ডলার সংকট মেটাতে কয়েক দফা বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিনিধিদের সঙ্গে বৈঠক করেও সমাধানে আসতে পারেননি সংশ্লিষ্টরা।
জানা যায়, জটিলতা কাটাতে ২৭ এপ্রিল বিসিপিসিএল কর্তৃপক্ষ বিদ্যুৎ সচিবকে চিঠি দিয়েছিল। এর আগেও সংশ্লিষ্টদের বকেয়া অর্থ পরিশোধ করতে তাগিদ দিয়েছিল বিসিপিসিএল। এসব চিঠি চালাচালির পর তিন কোটি ডলার পরিশোধ করা হয়। এরপরও পায়রার কাছে ৩৬ কোটি ডলার পাবে সিএমসি। বড় অঙ্কের এই অর্থ পরিশোধ না হওয়া পর্যন্ত পায়রা তাপবিদ্যুৎকে বাকিতে কয়লা না দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সিএমসি।
জানা যায়, দেশে বিদ্যুতের বর্তমান উৎপাদন সক্ষমতা রয়েছে ২৩ হাজার ৭০০ মেগাওয়াট (ক্যাপটিভ বাদে)। আর বিদ্যুতের চাহিদা তৈরি হচ্ছে সর্বোচ্চ সাড়ে ১৪ হাজার মেগাওয়াট। নয় হাজার ২০০ মেগাওয়াটের মতো সক্ষমতা ব্যবহার করা যাচ্ছে না। এসব সক্ষমতার বেশির ভাগই জ্বালানি সংকটে বন্ধ রয়েছে। পাশাপাশি বেশকিছু বিদ্যুৎ কেন্দ্র নিয়মিত মেরামতে থাকায় সেগুলোও ব্যবহার করা যাচ্ছে না।
পাওয়ার গ্রিড কোম্পানি অব বাংলাদেশ (পিজিসিবি) সূত্রে জানা যায়, দেশে যে পরিমাণ বিদ্যুৎ চাহিদা তৈরি হচ্ছে তার মধ্যে গ্যাস থেকে সাড়ে ছয় হাজার মেগাওয়াট, তরলীকৃত জ্বালানি (তেলভিত্তিক) থেকে এক হাজার ৮০০ মেগাওয়াট, কয়লা থেকে দুই হাজার ২৫০ মেগাওয়াট, সৌর ও পানিবিদ্যুৎ থেকে প্রায় ৪৫০ মেগাওয়াট এবং বাকিটা ভারত থেকে আমদানি করে জাতীয় গ্রিডে সরবরাহ করা হচ্ছে।
বিসিপিসিএলের একজন প্রকৌশলী নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘পায়রা থেকে দৈনিক গড়ে এক হাজার ২০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন হয়; যা সরাসরি জাতীয় গ্রিডে যুক্ত হয়। ফলে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সেবা পেত দেশের মানুষ। বিদ্যুৎকেন্দ্রটি বন্ধ হলে সারা দেশেই এর প্রভাব পড়বে।’
লোডশেডিং পরিস্থিতির বিষয়টি নিয়ে জানতে চাইলে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন বাংলাদেশ পাওয়ার ডেভেলপমেন্ট বোর্ডের (বিপিডিবি) সদস্য (উৎপাদন) এসএম ওয়াজেদ আলী সরদার বলেন, ‘লোডশেডিং কীভাবে কমানো যায় সে বিষয়টি নিয়ে আমরা সার্বক্ষণিক কাজ করছি। মনিটরিং কার্যক্রম সার্বক্ষণিক চলমান।’
পায়রা তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র বন্ধ হয়ে গেলে বিদ্যুৎ উৎপাদন পরিস্থিতি কীভাবে সামাল দেয়া হবে জানতে চাইলে এ কর্মকর্তা বলেন, ‘পায়রার বিকল্প হিসেবে আমরা প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছি। বিশেষত পায়রায় ২২৫ মেগাওয়াট, ইউনাইটেড ১০০ মেগাওয়াট এবং বরিশাল ইলেকট্রিক পাওয়ারের ৩০৭ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ কেন্দ্র প্রস্তুত রাখা হয়েছে। এ ছাড়া ছোট-বড় সক্ষমতার আরও কয়েকটি কেন্দ্র প্রস্তুত রয়েছে।’
বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বলেন, ‘বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাত বড় ধরনের চ্যালেঞ্জে পড়েছে। সঞ্চালন ও বিতরণ ব্যবস্থা সঠিক পরিকল্পনায় চললেও প্রাথমিক জ্বালানির ধারাবাহিক সরবরাহ চ্যালেঞ্জে রয়েছে।’ ঘাটতি মেটাতে দেশের বাইরে থেকে বিদ্যুৎ আনাসহ বিকল্প বেশকিছু পদক্ষেপ নেয়া হবে বলে জানান প্রতিমন্ত্রী।
আপন দেশ/আরএ
মন্তব্য করুন ।। খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত,আপন দেশ ডটকম- এর দায়ভার নেবে না।