ছবি: সংগৃহীত
ঢাকা শহরে প্রতি ৪০ মিনিটে ১টি করে বিবাহবিচ্ছেদের আবেদন জমা পড়ছে। এবং সেসব আবেদনকারীর মধ্যে ৭০ শতাংশ নারী। নানা জরিপ অনুযায়ী, বাংলাদেশের অন্যান্য শহরেও উদ্বেগজনকভাবে বিবাহবিচ্ছেদের হার বেড়েছে। এর হাওয়া গিয়ে লেগেছে গ্রামেও। এই নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এবং মিডিয়াপাড়া সরগরম। কিন্তু কেন বাড়ছে বিবাহবিচ্ছেদ?
‘বিবাহবিচ্ছেদ’-এর ঊর্ধ্বগতি নিয়ে নেটিজনরা বিচার-বিশ্লেষণে বসেছেন। নানামুনির নানামত! শেষে এসে বেশিরভাগ মানুষের রায় চলে যায় শিক্ষিত নারী সমাজের বিরুদ্ধে। তাদের আলোচনায় মোটামুটি একটি কারণ স্পষ্ট হয়ে ওঠে সেটি হলো শিক্ষিত ও স্বাবলম্বী নারীর সংখ্যা যত বাড়ছে ততই বাড়ছে তালাক। কিন্তু আসলে কী তাই?
বিবাহবিচ্ছেদের কারণে আমাদের সামাজিক-পারিবারিক প্রেক্ষাপটে নারীরাই বেশি ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন। একজন তালাকপ্রাপ্ত নারীকে ঘরে-বাইরে অনেক সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়। প্রথমত, আমাদের দেশে নারী উন্নয়ন বা স্বাধীনতার সুবার্তা বইছে সত্য কিন্তু এখনো এমন পর্যায়ে আসেনি যে পুরুষের ছায়া ছাড়া একাকী একজন নারী পুরো নিরাপত্তার সঙ্গে বাস করতে পারে। আমাদের দেশের মানুষ এখনো ভাবেন স্বামীই নারীর রক্ষক, নারীর মাথার ছাতা। তো একজন সাধারণ নারী কেন সেই ছাতার ছায়া থেকে সরে যেতে চাইবে?
জাতীয় মহিলা পরিষদ নারীদের তালাকের ক্ষেত্রে প্রধানত চারটি কারণকে চিহ্নিত করেছে। এগুলো হলো- যৌতুক, শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন এবং স্বামীর পরনারীতে আসক্তি। এর বাইরেও আরও অনেক কারণ রয়েছে, তার মধ্যে অন্যতম হলো মতের পার্থক্য।
আসলে মানুষ বিবাহসূত্রে আবদ্ধ কেন হয়? তার প্রথম কারণ পরিবার গঠন। এ ছাড়া রয়েছে বৈধ উপায়ে যৌন চাহিদা মেটানো, বংশ বৃদ্ধি, নারীর সামাজিক ও আর্থিক নিরাপত্তা, সামাজিক আচার পালন, ধর্মীয় বাধ্যবাধকতা এসব কারণে। কিন্তু বিবাহ যদি হয়ে ওঠে শৃঙ্খল তা হলে সেখানে শৃঙ্খল ভাঙার গান রচিত হবেই। দেখা গেছে আমাদের সমাজে পুরুষের চাইতে নারীদের জন্য সংসার ধীরে ধীরে কারাগার হয়ে ওঠার ঘটনা বহু বহু গুণ বেশি। সামাজিক রীতি অনুযায়ী এ দেশে নারীরাই বধূ হয়ে স্বামীর ঘরে বসবাস করে। সেখানে নানাধরনের কৈফিয়তের মধ্যে তাকে বাস করতে হয়। স্বামী-শ্বশুর-শাশুড়ি, ননদ-দেবরের মন জুগিয়ে চলতে হয়। পরিবারে বাস করতে গিয়ে নানা সময়ে নানাভাবে মতবিরোধ পক্ষান্তরে মনোমালিন্য তৈরি হয় এবং নির্যাতনের ঘটনাও ঘটে। ফলে বিবাহবিচ্ছেদ ছাড়া উপায় থাকে না।
একক পরিবারেও দেখা যায় স্বামীর মতকে প্রাধান্য দিয়ে একজন নারীকে সংসার জীবন চালাতে হয়। চাই সে মত পছন্দ হোক বা না হোক। এর বাইরেও রয়েছে কিন্তু সেসবের সংখ্যা খুবই নগণ্য। স্বামী শুধু বাইরে গিয়ে আয় করার কাজটি করলেও নারীকেই পরিবারের বাকি সব কাজের দায়িত্ব নিতে হয়। সন্তান-সন্ততি লালনপালন, রান্নাবান্না, ঘরদোর পরিষ্কার রাখা, আত্মীয়তা, সামাজিক আচার ইত্যাদি। তা ছাড়া দুজনের মত রুচির পার্থক্য তো থাকেই, সঙ্গে সন্দেহ প্রবণতাও দু’জনের মধ্যকার বিশ্বাসে চিড় ধরিয়ে দেয়। পরকীয়া এখন খুবই চর্চিত বিষয়। এই ব্যাধিতে নারী-পুরুষ উভয়েই জড়িয়ে পড়ছেন। বিভিন্ন অনুসন্ধানে দেখা গেছে পরকীয়া আসক্তিতে নারীর তুলনায় পুরুষদের জড়িয়ে পড়ার সংখ্যা বহু গুণ বেশি। এতে করেও উভয়ের মধ্যে ফাটলের ব্যাপ্তি বৃদ্ধি পাচ্ছে। কিন্তু দিনশেষে নারীকেই খোঁটা শুনতে হয় যে, ‘টাকা আমার, আইনও আমার।’ বা ‘তুমি চরিত্রহীনা।’ ফলে বিবাহবিচ্ছেদই হয়ে ওঠে শান্তির একমাত্র রাস্তা।
এক সময় ছিল স্বামীর আয়ের ওপরে স্ত্রীদের পুরোপুরি নির্ভর করতে হতো। তার যাওয়ার জায়গা ছিল না। স্বামীর সংসার থেকে বেরিয়ে সন্তান এবং নিজের আর্থিক বা সামাজিক নিরাপত্তার অভাব তাকে ভীত করে রাখত। সমাজের ভ্রƒকুটির ভয়ে বাবার বাড়ি থেকে ক্রমাগত চাপ আসত, ‘মানিয়ে চল’ ফলে একজন নারী সহসা বিবাহবিচ্ছেদের রাস্তায় হাঁটার কথা ভাবলেও কাজে পরিণত করার সাহস ছিল না। সব অত্যাচার-অন্যায় মুখ বুজে সহ্য করেও স্বামীর সংসার করতে বাধ্য হতো। কিন্তু দিন বদলে গেছে। এখন নারীরা প্রায় সমান হারে আয় করছে। সামাজিক নিরাপত্তা কিছুটা হলেও বেড়েছে। যে আর্থিক নিরাপত্তার কারণে নারী সবকিছু মুখ বুজে সহ্য করত সে এখন ‘সিংগেল মাদার’ নাম নিয়ে হলেও সন্তানের দায়ভার নিতে পারে। একাই বাসা ভাড়া নিয়ে বা সন্তান-সন্ততিসহ দিব্যি সংসার করতে পারছে। তাই নারীর কাছে যখন সংসার শৃঙ্খল হয়ে দাঁড়াচ্ছে বা টর্চার সেল তখন সেটি ভেঙে বেরিয়ে আসছে বিবাহবিচ্ছেদের মাধ্যমে। এখানে বিবেচ্য নারী বেরিয়ে আসছে কেন? নিশ্চয় স্বনির্ভরতা বা স্বাধীনতার কারণে নয় বরং শারীরিক-মানসিক নির্যাতনের কারণে। পার্থক্য শুধু ভবিষ্যৎ চিন্তায় আগে সাহস ছিল না এখন তার সাহস হয়েছে।
স্বামী কখন বিবাহবিচ্ছেদ চান? বেশিরভাগ ক্ষেত্রে দেখা গেছে স্ত্রীর চরিত্রকে দোষারোপ বা স্ত্রী সন্তান জন্মদানে অক্ষম, মানসিক নির্যাতন ইত্যাদি কারণ দেখিয়ে স্বামীরা স্ত্রীদের তালাক দিয়ে থাকেন। কারণ যাই থাকুক, বিবাহবিচ্ছেদ কারোরই কাম্য নয়। নানাবিধ সমস্যার সম্মুখীন হলেই তবে তালাকের প্রশ্ন আসে। এবং তালাক হওয়ার পর স্বামী-স্ত্রী উভয়েই কমবেশি ক্ষতিগ্রস্ত হন। নারীদের ক্ষতির দিকটা বেশি। কারণ নারী সহজে আর দ্বিতীয় বিয়ের কথা ভাবতে পারে না বা পুরুষরা তাদের স্ত্রী হিসেবে গ্রহণ করতে চায় না। অন্যদিকে যদি আয়ের উৎস না থাকে তা হলে আর্থিক দৈন্যের শিকার হয়ে হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়ে। সমাজে একা বাস করার হ্যাপাও অনেক। সন্তান নিজের কাছে রাখতে গেলে নানা আইনি জটিলতা থেকেও তাদের মধ্যে মানসিক পীড়নের মধ্যে থাকতে হয়। এ ছাড়া প্রতিবেশী আত্মীয়স্বজনের খোঁটা তো রয়েছেই। শেষ জীবনে এসে অনেক নারী একাকিত্বে ভুগতে থাকেন।
পুরুষদের ক্ষেত্রে বিবাহবিচ্ছেদজনিত ভোগান্তির পরিমাণ অপেক্ষাকৃত কম। সিংহভাগ পুরুষ এক স্ত্রী চলে গেলে দ্বিতীয় স্ত্রী গ্রহণ করেন। তারা স্বাবলম্বী থাকার কারণে আর্থিক নিরাপত্তাহীনতার শিকার হন না। অনেক পুরুষ রয়েছে যারা স্ত্রী-সন্তান ছাড়া শেষ জীবন অত্যন্ত নিঃসঙ্গতায় কাটান।
স্বামী-স্ত্রীর বিবাহবিচ্ছেদের কারণে ওই দম্পতির সন্তানরা ভয়াবহ ক্ষতির সম্মুখীন হয়। অনেক ক্ষেত্রে তাদের জীবন বিপন্ন হয়ে ওঠে। এর বাইরে আজীবন তাদের সমাজের কাছে জবাবদিহি করতে হয়, তোমাদের বাবা-মা একসঙ্গে থাকেন না কেন? বা তুমি বাবার কাছে থাকো না মায়ের কাছে থাকো? বড় কথা হলো, প্রতিটি সন্তানের কাছেই তাদের বাবা-মায়ের ভালোবাসাকে একটি মৌলিক চাহিদা বলা যায়। ব্রোকেন ফ্যামিলির সন্তানদের সেই ভালোবাসা থেকে বঞ্চিত হতে হয়। হয় তাদের মায়ের ভালোবাসা যত হতে দূরে রাখা হয় না হয় বাবার ভালোবাসা যতœ থেকে। নানা মানসিক পীড়ায় তারা মানসিকভাবে দুর্বল থাকে। ফলে নিজের মেধাকে সঠিকভাবে কাজে লাগাতে পারে না। বাস্তবক্ষেত্রে দেখা গিয়েছে অনেক সময় এসব পরিবারের সন্তান ধীরে ধীরে প্রতিবন্ধী হয়ে ওঠে বা সন্ত্রাসী।
মোট কথা বাবা-মায়ের আলাদা হয়ে যাওয়ার মধ্যে নিরানব্বই ভাগ সন্তানের জন্য দুর্ভাগ্যের শিকার হতে হয়। কিন্তু বিবাহবিচ্ছেদ রোধ করার উপায় কী? আসলে ব্যতিক্রম কিছু ঘটনা ছাড়া বিবাহবিচ্ছেদ এড়াতে পারে কেবল সংশ্লিষ্ট দুজন মানুষের আন্তরিকতা এবং বুদ্ধিমত্তা। এ ক্ষেত্রে উভয়ের কমবেশি দায়দায়িত্ব রয়েছে। এমন নয় যে, বিয়ের দিন থেকেই ঝগড়া বা মনোমালিন্য শুরু হয় বরং ছোট ছোট বিষয় নিয়ে মনোমালিন্য হতে হতে এক সময় বিশাল আকারের মতভেদ তৈরি হয়ে যায়। যার কারণে দেখা গিয়েছে দশ বছরের প্রেমের বিয়েও দুই বছর টেকেনি। তাই প্রথম থেকেই মনোমালিন্যের কারণগুলোকে এড়িয়ে না গিয়ে সে বিষয়ে দুজন মিলে খোলাখুলি কথা বলে সতর্ক হতে হবে। সম্পর্কও পার্থিব যে কোনো পদার্থের মতো যতœ চায়। একটি গাছের চারাকে যেভাবে নার্সিং বা যতœ দিয়ে সেবা দিয়ে বড় করতে হয় তেমন সম্পর্কের ক্ষেত্রেও যতেœর প্রয়োজন রয়েছে। অযতেœ সেখানেও ধূলির আস্তর পড়ে যায়। সেই ধূলি পরিষ্কার করে দাম্পত্য জীবন ঝকঝকে করার দায়িত্ব স্বামী-স্ত্রী উভয়েরই। বৈবাহিক সম্পর্ক হেলদি রাখতে চাইলে উভয় পক্ষকে কমবেশি ছাড় দিতে শিখতে হবে।
ডিজিটাল এই যুগে নিজেকে ভালো রাখা বা খারাপ রাখার অনেক হাতিয়ার আজ হাতের মধ্যে। মানুষ সৃষ্টির সেরা জীব একমাত্র তাকেই জ্ঞানের অধিকারী করা হয়েছে। তাই সেই হাতিয়ারকে কোন কাজে ব্যবহার করা হবে সেটা সে নিজেই সিদ্ধান্ত নেবে। আজ অনেকেই স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে বিশ্বাসহীনতার জন্য মোবাইল ফোন, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ইত্যাদিকে দায়ী করে থাকেন। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে মানুষই এর জন্য দায়ী, হাতিয়ার নয়। তাই যে বিষয়টি স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে দূরত্ব তৈরি করছে বলে মনে করা হয় তার ব্যবহার যদি যথাযথভাবে করা যায় তা হলে বিশ্বাস ভঙ্গের প্রশ্ন আসে না।
পরিশেষে বলতে পারি, স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে মধুময় সম্পর্কই একটি পরিবারকে সুখী করে, পরিবার সুখী হলে সমাজ রাষ্ট্র সমৃদ্ধ হয়। কারণ একটি অসুখী পরিবারের কোনো সদস্যই নিজের জন্য, সমাজের জন্য তথা রাষ্ট্রের জন্য ভালো কিছু করতে পারে না। তাই পরিবারের বন্ধনকে সুদৃঢ় এবং দীর্ঘস্থায়ী করতে প্রত্যেক দম্পতির উচিত নিজেদের মধ্যে সমঝোতার পরিবেশ তৈরি করে পরস্পরের প্রতি সহনশীল এবং প্রেমময় সম্পর্ক তৈরি করা।
লেখক: কথাসাহিত্যিক এবং সহকারী অধ্যাপক ময়মনসিংহ কলেজ
মন্তব্য করুন # খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, আপন দেশ ডটকম- এর দায়ভার নেবে না।