ছবি: সংগৃহীত
এ আর রেহমান একজন লিজেন্ড সঙ্গীতজ্ঞ। সর্বভারতে তিনি পরিচিতি পেয়েছেন ২১-২২ বছর বয়সে ‘রোজা’ সিনেমার সৌজন্যে, গত শতাব্দীর নব্বই দশকের শুরুতেই। ছিলেন হিন্দু, পরে সপরিবারে ধর্মান্তরিত হয়ে সুরা ‘আর রাহমান’র অনুকরণে নিজের নামকরণ করেন। ‘রোজা’, ‘বম্বে’, ‘দিল সে’, ‘পরদেশ’, ‘স্লামডগ মিলিয়নিয়ার’, ‘রকস্টার’, ইত্যাদি চলচ্চিত্র তাকে সুসংহত আসন, অর্থ-বিত্ত, অস্কার এনে দিয়েছে।
এ আর রেহমান এবার কবি নজরুলের গানের বারোটা বাজিয়েছেন। ভারতবর্ষের জাগরণের গানের অন্যতম মাইলফলক ‘কারার ঐ লৌহকপাট’কে ব্যবচ্ছেদ করেছেন নিজের স্টাইলে। জাগরণের গানকে ঘুমপাড়ানি স্টাইলে উপস্থাপন করেছেন পিপ্পা চলচ্চিত্রে। মূল সুরের ধারেকাছেও নেই। একটি ঐতিহাসিক গানের অপমৃত্যু ঘটালেন তিনি।
মজার ব্যাপার হলো এই গানের প্রসঙ্গ না এলে রাজাকৃষ্ণ মেনন পরিচালিত লো বাজেটের সিনেমা পিপ্পার কথা কেউ মনেও রাখতো না। মুক্তি পেত আর হারিয়ে যেত। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে বানানো এই সিনেমার কাহিনীর কথা বাংলাদেশের কেউ শুনেছে বলেও মনে হয় না। তাই ভাবনা অমূলক নয় যে সিনেমাটিকে আলোচনায় আনার জন্যেই এই অভাবনীয় বিতর্ক চাওড় করা।
তবে দুঃখ লাগে নজরুলের প্রতি বলিউডের এই অবহেলা দেখে। প্রকারান্তরে অবহেলা করা হলো দেশবন্ধুকেও। কারণ চিত্তরঞ্জন দাশের স্ত্রীর অনুরোধে কবি গানটি লিখেছিলেন। দেশবন্ধুর সঙ্গে নজরুলের সম্পর্ক সমন্ধে সবাই কমবেশি অবগত। অন্তত যারা সাহিত্যের খোঁজ-খবর রাখেন। তার অকালপ্রয়াণে ব্যথিত কবি গোটা একটি কাব্যগ্রন্থ ‘চিত্তনামা’ প্রণয়ন করেছিলেন। ‘কারার ঐ লৌহকপাট’ সম্পর্কে আমরা জানি যে ইংরেজ শাসনের বিরোধিতার কারণে দেশবন্ধু সহ যারা জেলে ছিলেন, কারাগারে তাদের প্রতিবাদের ভাষা হয়ে ওঠে এই গান। ১৯৪৯ সালে ‘চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠন’ সিনেমায় এটি প্রথম ব্যবহৃত হয়। এরপর ৬৯-৭০ সালে জহির রায়হান তার কালজয়ী চলচ্চিত্র ‘জীবন থেকে নেয়া’ সিনেমায় এই গান ব্যবহার করেন। সবচেয়ে বড় কথা এই গান আর নজরুল প্রায় সমার্থক। বিদ্রোহী কবিতার মতো ‘কারার ঐ লৌহকপাট’ আমাদের প্রাণের কবির একটি প্রতিনিধিত্বশীল সৃষ্টি। অথচ এ আর রেহমান গানটিকে কবর দিয়েছেন সুরবিকৃতির আশ্রয় নিয়ে। আমরা প্রতিবাদ জানিয়ে রাখলাম।
কিছুদিন আগে শিল্পী অভিজিৎ-এর একটি সাক্ষাৎকার দেখছিলাম ইউটিউবে। তিনি মনে করেন, এ আর রেহমান বাদ্যযন্ত্রীদের পেটে লাথি মেরেছেন। এক কি-বোর্ড দিয়েই তিনি বিবিধ সাউন্ড সৃষ্টি করেন। তার সৃষ্ট সুর অনেকগুলো সাউন্ডের মিলিত প্রকাশ মাত্র। ভারতের মূলধারার গান, সুর, দ্যোতনা নয়।
‘কারার ঐ লৌহকপাট’ গান নিয়ে বিতর্ক শুরু না হলে ‘পিপ্পা’ সিনেমাটি নিয়ে বাংলাদেশে ইতিবাচক আলোচনা শুরু হতে পারতো। মুক্তিযুদ্ধে আলোচিত ‘গরিবপুর যুদ্ধ’ নিয়ে সিনেমাটি। যশোরের কপোতাক্ষের তীরে সেক্টর কমান্ডার জেনারেল মঞ্জুরের অধিনায়কত্বে অনন্য এই যুদ্ধটি সংঘটিত হয়। এতে ভারতীয় বাহিনীর ক্যাপ্টেন বি এস মেহতা উপ-অধিনায়ক ছিলেন। যুদ্ধটি হয়েছিল ১৯৭১ এর নভেম্বরে। এর কিছুদিন পর ভারত ডিসেম্বরের ৩ তারিখে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক যুদ্ধ ঘোষণা করে।
বি এস মেহতা অর্থাৎ বলরাম সিং মেহতা পরবর্তী সময়ে ব্রিগেডিয়ার হিসেবে অবসর নেন। তার লেখা গরিবপুর যুদ্ধ নিয়ে অসাধারণ একটি বই ‘দ্য বার্নিং শাফিজ’। শাফি আমেরিকার তৈরী ট্যাংক। গরিবপুর যুদ্ধ নিয়াজীর অহংকার মাটিতে মিশিয়ে দেয়। পাকিস্তানের ট্যাংকগুলো ছাইভস্মে পরিণত হয়। উপ-অধিনায়ক হিসেবে তিনি বীরত্বপূর্ণ অবদান রাখেন। আর অধিনায়ক জেনারেল মঞ্জুর (সেই সময় লে. কর্নেল) প্রশংসিত হন।
ভারত তার পূর্বাঞ্চল কমান্ডের এই অনন্য অবদানকে সেলুলয়েডে বন্দি করেছে। দ্য বার্নিং শাফিজ অনুসারে স্ক্রিপ্ট লিখিত হয়েছে। ছবি প্রযোজনা করেছেন অভিনেত্রী বিদ্যা বালানের স্বামী সিদ্ধার্থ রায় কাপুর এবং রনি স্ক্রুওয়ালা। একটি গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রে অভিনয় করেছেন মহেশ ভাটের পত্নী সোনি রাজদান।
পিপ্পা সিনেমায় ব্যবহৃত হয়েছে ‘কারার ঐ লৌহকপাট’ গানটি বিকৃত সুরে। এখন আমাদের কী করা উচিত? কবি পরিবার, কবি নজরুল ইন্সটিটিউট, চুরুলিয়ার নজরুল একাডেমি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বাংলা বিভাগ, ময়মনসিংহ নজরুল বিশ্ববিদ্যালয়, আসানসোল নজরুল বিশ্ববিদ্যালয়, প্রসঙ্গ নজরুল সঙ্গীত (প্রনস)- প্রত্যেক সংগঠন ও এর সকল সদস্যের উচিত এই ঘটনার প্রতিবাদ জানানো। পিপ্পা চলচ্চিত্র থেকে গানটি প্রত্যাহার করে মূল সুরে এর ব্যবহার সুনিশ্চিত করা হোক। ইতোমধ্যে দুই বাংলার সংস্কৃতিসেবীরা প্রতিবাদ জানাচ্ছেন যার যার জায়গা থেকে। খোদ নজরুল পরিবারের সদস্যরা প্রতিবাদ জানিয়েছেন। বলা চলে দুই বাংলায় তোলপাড় চলছে এ নিয়ে। নজরুল যাদের আরাধ্য তারা এ আর রেহমানের কাণ্ডজ্ঞানহীন কাজ মানতে পারছেন না। প্রত্যেকেই দুঃখ ভারাক্রান্ত মনে প্রতিবাদ করছেন। প্রতিবাদ অব্যাহত থাকুক।
সুখের বিষয়, পিপ্পার নির্মাতারাও দুঃখ প্রকাশ করেছেন। সম্প্রতি ‘পিপ্পা’ সিনেমার অন্যতম প্রযোজনা সংস্থা রায় কাপুর ফিল্মস একটি বিবৃতি দেয়। সেখানে বলা হয়, কবি কাজী নজরুল ইসলাম এবং তার সৃষ্টির প্রতি পিপ্পা টিমের ‘গভীর শ্রদ্ধা’ রয়েছে। যাবতীয় নিয়ম মেনেই কবি পরিবারের কাছ থেকে গানের স্বত্ব নেওয়া হয়েছিল। সেই চুক্তি মেনেই গানের কথা ব্যবহার এবং সুরের পরিবর্তন করা হয়েছে। গানটির ঐতিহাসিক তাৎপর্যকে শ্রদ্ধা জানানোই ছিল পিপ্পা টিমের উদ্দেশ্য।
বিবৃতিতে বলা হয়, ‘আমরা মূল গানটি ঘিরে শ্রোতাদের আবেগকে সম্মান করি। শিল্প যেহেতু ব্যক্তিগত দৃষ্টিভঙ্গির ওপর নির্ভরশীল, সেখানে আমাদের পদক্ষেপ যদি কারো আবেগে আঘাত করে থাকে বা অনিচ্ছাকৃত কষ্টের কারণ হয়ে থাকে, তাহলে আমরা ক্ষমাপ্রার্থী।’
নজরুলের নাতনি অনিন্দিতা কাজী ফেসবুকে একটি দীর্ঘ পোস্টে মূল গানের স্বত্ব হস্তান্তর প্রক্রিয়া নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। নিউ জার্সি প্রবাসী অনিন্দিতা লেখেন, ‘গোটা বিশ্ব জুড়ে বিতর্কের ঝড়, তোলপাড়। আমার মা কল্যাণী কাজী, যার বেঁচে থাকাই ছিল নজরুলকে নিয়ে, তিনি ২০২১ সালে গানটি অবিকৃত রেখে ব্যবহার করার অনুমতি দিয়েছিলেন বলে জানতে পারি। কিন্তু এর পরিণতি এমন হবে, তিনি মৃত্যুর পরেও ভাবতে পারেননি বোধ হয়।’
অনিন্দিতা লেখেন, চুক্তির কাগজ তার ভাই কাজী অনির্বাণের কাছে রয়েছে বলে সংবাদমাধ্যম থেকে জানতে পেরেছি। এ ছাড়া নজরুলের নাতনি খিলখিল কাজীও এ আর রেহমানের কঠোর সমালোচনা করেন। তার ভাষায় সুর বদলে ‘গর্হিত অপরাধ’ করেছেন এ আর রেহমান।
খোদ এ আর রেহমান এখনো নিশ্চুপ। তাকে দুঃখ প্রকাশ করতে হবে। এবং বিকৃত সুরের গানটির সকল কনট্যান্ট সকল মাধ্যম থেকে সরিয়ে নিতে হবে। সহজ বাংলায় বিকৃত সুরের গানটি যেন হাতের নাগালে কেউ না পান।
মগবাজারের একজনকে চিনি যিনি চার দশকের অধিক কাল নজরুল-চর্চার সঙ্গে যুক্ত থেকেও কবিকে বুঝতে পারেননি এক রত্তি। এ আর রেহমানকে মনে করতাম তিনি যেখানে হাত দেন সোনা ফলিয়ে থাকেন। তানহা তানহা, দিল হ্যায় ছৌটাছা, রঙ রঙিলা রে, তাল সে তাল মিলা, মা তুঝে সালাম, মুস্তাফা মুস্তাফা, জিয়া জ্বলে ইত্যাদি গান দিয়ে পুরো নব্বই দশক তিনি আমাদের বুঁদ করে রেখেছিলেন।
কিন্তু নজরুলে হাত দিতে এসে নিজেই জ্বলে গেলেন! নজরুল এক তেজোদ্দীপ্ত রশ্মি। নজরুল এক অনির্বাণ শিখা। সবাই তাঁর অমূল্য সৃষ্টির কাছে পৌঁছুতে পারে না।
কবি নিজেই বলেছেন-
‘ফল বহিয়াছ পাওনিক রস হায় রে ফলের ঝুড়ি,
লক্ষ বছর ঝর্ণায় ডুবে রস পায় নাকো নুড়ি।’
রফিক সুলায়মান : লেখক ও শিল্প-সমালোচক। [email protected]
আপন দেশ/আরএ
মন্তব্য করুন # খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, আপন দেশ ডটকম- এর দায়ভার নেবে না।