ছবি : আপন দেশ
গবেষক ও ইতিহাসবিদরা বিশ্লেষণ ব্যখ্যা করে বলছেন, রবীন্দ্রনাথের অনেক গানে বঙ্গবন্ধু এদেশের মানুষের মনের কথা, আবেগের কথা, ভালোবাসার কথার অনুভব পেতেন। বাঙালিকে কবিগুরু অন্তর দিয়ে ভালোবেসেছিলেন ফলে তিনি তাদের অনুভবের গভীর তলানির সন্ধান করতে পেরেছিলেন।
ইতিহাস বলছে, অনেক কাল আগে থেকে আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি- গানটি আমাদের মননের সঙ্গে, চেতনার সঙ্গে, অস্থিমজ্জায় একাকার হয়ে মিশে গিয়েছিল। রবীন্দ্রনাথের এই গানটি কীভাবে আমাদের জাতীয় সঙ্গীতের মর্যাদা পেল তা নিয়ে নিয়ে ইতিহাসের তথ্য উপাত্ত বিশ্লেষণ করে যা পাওয়া যায় তাহল, ১৯৬৬ সালে ঢাকার ইডেন হোটেলে আওয়ামী লীগের তিন দিনব্যাপি কাউন্সিল অধিবেশনের উদ্বোধন হয়েছিল ‘আমার সোনার বাংলা,আমি তোমায় ভালোবাসি’ গানটি দিয়ে। আর একথা সবার জানা যে, এই গানটির প্রতি ছিল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের একটা আলাদা রকমের আবেগ। তার দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনের পরতে পরতে, কারাগারে বন্দী থাকার সময়ে নির্জন সেলে রবীন্দ্রনাথের এই গান সহ আরও অনেক গান তাকে আন্দোলন-সংগ্রামে অবিচল থাকার প্রেরণা যুগিয়েছিল। ফলে দীর্ঘকাল ধরে বঙ্গবন্ধুর হৃদয়ে এই গানের প্রতি একটা আলাদা মমত্ববোধ কাজ করত। তিনি যে এই গানটিকেই পরবর্তীতে স্বাধীন বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীত হিসেবে গ্রহণ করবেন তার ইঙ্গিত তারও আগে থেকে পাওয়া যায়।
ইতিহাসবিদরা বলছেন, বঙ্গবন্ধু কবিগুরুর গানে এই পূর্ব বাংলার প্রতি তার অতল গভীর ভালোবাসা, দেশপ্রেম, শ্যামল প্রকৃতি, আবেগ, মুক্তির ডাক, অত্যাচার বঞ্চনার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ- সবই খুঁজে পেয়েছিলেন।
২
সাহিত্য পাঠের পাশাপাশি প্রচুর গান শুনতেন বঙ্গবন্ধু। তার দীর্ঘ কারাবাসের সময় তিনি প্রচুর বই সঙ্গে রাখতেন- কারাগারে বসে লেখালেখির পাশাপাশি গোগ্রাসে বইপুস্তক পড়তেন। বঙ্গবন্ধুর ভীষণ প্রিয় ছিলো কবিগুরুর লেখা।
বঙ্গবন্ধু গবেষকরা এ প্রসঙ্গে বলছেন, বঙ্গবন্ধুর জীবনে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রভাব ছিল অপরিসীম। বঙ্গবন্ধু কবিগুরুর বাণী আর গান শুনে তার নিজস্ব স্বপ্ন পূরণে যোজন যোজন পথ পাড়ি দিয়েছেন। কবিগুরুর গান তাকে উৎসাহ আর প্রেরণা যুগিয়েছে। বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক আন্দোলন সংগ্রামে, দুঃসময়ে কিংবা উত্তাল সময়ের বাঙালি জাতির ভাগ্য নির্ণয়ের কঠিন সিদ্বান্ত গ্রহণে রবীন্দ্রনাথ তার গান দিয়ে, বাণী দিয়ে তার পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন পরম বন্ধুর মতো। গবেষকরা বলছেন, বঙ্গবন্ধুর ভেতরে বাঙালি জাতিসত্তার ভাবনার বীজ সফলভাবে প্রোথিত করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।
৩
প্রখ্যাত রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী ও গবেষক অধ্যাপক সনজীদা খাতুন ‘বঙ্গবন্ধুর ভাবনায় আমার সোনার বাংলা’ শীর্ষক এক লেখায় রবীন্দ্রসঙ্গীতের প্রতি বঙ্গবন্ধুর অপরিসীম ভালোবাসার কথা উল্লেখ করতে গিয়ে লিখছেন, ‘পঞ্চাশ দশকে একবার আমার খুব ভাল করে মনে আছে- কার্জন হলে একটা অনুষ্ঠান হচ্ছিলো। আমাকে গান গাইতে বলা হয়েছিল। আমি খুব বিস্মিত হয়ে গেলাম গান গাইতে। কী গান গাইবো?’
এমন সময় দেখা গেল সেখানে বঙ্গবন্ধু। তখন তো তাকে কেউ বঙ্গবন্ধু বলে না- শেখ মুজিবুর রহমান। তিনি লোক দিয়ে আমাকে বলে পাঠালেন আমি যেন ‘সোনার বাংলা’ গানটা গাই- ‘আমার সোনার বাংলা’।
আমি খুব ঘাবড়ে গেলাম। এত লম্বা একটা গান। তখন তো আর এটা জাতীয় সঙ্গীত নয়। পুরো গানটা আমি কেমন করে শোনাবো? আমি তখন চেষ্টা করে গীতবিতান সংগ্রহ করে সে গান গেয়েছিলাম কোনমতে। জানি না কতটা শুদ্ধ গেয়েছিলাম। কিন্তু তিনি এইভাবে গান শুনতে চাওয়ার একটা কারণ ছিল। তিনি যে অনুষ্ঠান করছিলেন, সেখানে পাকিস্তানীরাও ছিল। তিনি দেখাতে চেষ্টা করেছিলেন তাদেরকে ‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি’ কথাটা আমরা কত সুন্দর করে উচ্চারণ করি। এই গানটার ভেতরে যে অনুভূতি সেটা তিনি তাদের কাছে পৌঁছাবার চেষ্টা করেছিলেন। এবং আমার তো মনে হয় তখনই তার মনে বোধহয় এটাকে জাতীয় সঙ্গীত করবার কথা মনে এসেছিল।
আরও পড়ুন <> আজকে যে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো দেখছি এর সব কিছু নকল
বায়ান্ন সালে আমরা যখন রবীন্দ্র সঙ্গীত চর্চা করি তখন আমরা কিন্তু ঐ বায়ান্নের পরে পরে শহীদ মিনারে প্রভাত ফেরিতে আমরা রবীন্দ্র সঙ্গীত গাইতাম। এবং এইভাবে রবীন্দ্র সঙ্গীত কিন্তু তখন বেশ চলেছে। আরো পরে কেমন করে যেন একটা অলিখিত বাধা এলো। পাকিস্তান আমলের পরে রবীন্দ্র সঙ্গীত ‘আমার সোনার বাংলা’ যখন জাতীয় সঙ্গিত হলো, তার কিছুকাল পরে দেখা গেল- নানা ধরনের চল ছিল তো- সেই সময় গানটা না করে শুধু বাজনা বাজাবার একটা রেয়াজ শুরু হলো। আমার মনে হয় এর মধ্যে সেই পাকিস্তানী মনোভাবটা কাজ করেছে।”
৪
ইতিহাসবিদরা বলছেন, এই গানটি ১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল মেহেরপুরের মুজিবনগরে স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের শপথ গ্রহণের অনুষ্ঠানে জাতীয় সঙ্গীত হিসেবে প্রথম গাওয়া হয়েছিল। তবে এই গানটি আরও আগে থেকে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে স্বাধিকার ও স্বাধীনতার আন্দোলন সংগ্রামে বাঙালিকে সাহস ও অনুপ্রেরণা যুগিয়েছে। সে সময়ের সভা সমাবেশে এই গানটি গাওয়া হতো।
গবেষক, ভাষাবিদ এমিরেটাস অধ্যাপক আনিসুজ্জামান এই গান নিয়ে বলতে গিয়ে গণমাধ্যমে বলেন, মুক্তিযুদ্ধের সময় পুরো ১৯৭১ সালে তো বটেই, এর আরও অনেক আগে থেকেই গানটি বিভিন্ন অনুষ্ঠান ও সভা সমাবেশে গাওয়া হয়েছে। গানটি প্রতিটি বাঙালিকে উদ্দীপ্ত করেছে, প্রেরণাও যুগিয়েছে।
৫
‘আমার সোনার বাংলা কেমন করে বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীত হলো সে সম্পর্কে ব্রিটিশ সাংবাদিক ডেভিড ফ্রসট-কে এক সাক্ষাৎকারে বঙ্গবন্ধু বলেছেন, ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে আমি যখন শেষবারের মতো জনসভা করি, যেখানে ১০ লাখ লোক হাজির হয়েছিল আর তখন ‘স্বাধীন বাংলা স্বাধীন বাংলা’ স্লোগান দিচ্ছিল, তখন ছেলেরা গানটা গাইতে শুরু করে। আমরা সবাই, ১০ লাখ লোক দাঁড়িয়ে গানটাকে শ্রদ্ধা জানাই। তখনই আমরা আমাদের বর্তমান জাতীয় সঙ্গীতকে গ্রহণ করে নিই।
আপন দেশ/এবি
মন্তব্য করুন # খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, আপন দেশ ডটকম- এর দায়ভার নেবে না।