রফিক সুলায়মান
আমাদের কাছে লিয়ার লেভিন গত ৩০ বছর একটি আলোচিত নাম। আপনারা অনেকেই জানেন মহান মুক্তিযুদ্ধে এবং ৭০-এর ঘূর্ণিঝড় নিয়ে তিনি বাংলাদেশে কাজ করেছেন। মুক্তিযুদ্ধে তিনি প্রায় ২২ ঘণ্টার ফুটেজ ধারণ করেন। কিন্তু কোনো স্পন্সর না পাওয়ায় তিনি ফুটেজগুলো বিশ্বসভায় তুলে ধরতে পারছিলেন না। প্রায় দুই যুগ পর তার ফুটেজ অবলম্বনে তারেক মাসুদ এবং ক্যাথরিন মাসুদ নির্মাণ করেন ‘মুক্তির গান’। লিয়ার লেভিন প্রায় বিস্মৃতলোক থেকে ফিরে আসেন প্রতিটি বাঙালির মানসলোকে।
লিয়ার লেভিন একজন মার্কিন চলচ্চিত্র পরিচালক, আলোকচিত্রশিল্পী এবং মার্কিন টিভি সাংবাদিক। তিনি ১৯৭০ খ্রিস্টাব্দে প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড়ের পর তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান তথা বর্তমান বাংলাদেশে ছুটে এসেছিলেন। তখন তিনি ঘূর্ণি-উপদ্রুত মানুষকে নিয়ে একটি তথ্যচিত্র তৈরি করেন যা দুর্গতদের সাহায্যে তহবিল সংগ্রহে বিশেষ ভূমিকা রেখেছিল।
এরপর ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দে এদেশের মানুষের ওপর পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর অত্যাচার নির্যাতনের বার্তায় ব্যথিত হয়ে পুনরায় বাংলাদেশে আসেন তিনি। মাতৃভূমি থেকে বিতাড়িত এবং ভারতে আশ্রয় গ্রহণকারী লাখ লাখ শরণার্থীর দুঃখ-দুর্দশা নিয়ে তিনি প্রামাণ্যচিত্র তৈরির সিদ্ধান্ত নেন। লিয়ার লেভিন প্রায় ছয় সপ্তাহ পশ্চিম বাংলায় থেকে বিভিন্ন শরণার্থী শিবির ও যুদ্ধফ্রন্টের ছবি তোলেন। পরে ২২ ঘণ্টার ফুটেজ নিয়ে তিনি ‘জয় বাংলা’ নামে ৭২ মিনিটের একটি প্রামাণ্যচিত্র নির্মাণ করেন। কিন্তু কোনো স্পন্সর না পাওয়ায় ছবিটি পরিত্যক্ত হয়। দুই দশকের বেশি সময়ের পর বাংলাদেশের চলচ্চিত্র নির্মাতা তারেক মাসুদ ও তার স্ত্রী ক্যাথরিন মাসুদ লিয়ার লেভিনের সঙ্গে যোগাযোগ করে তার তোলা ফুটেজগুলো সংগ্রহ করেন। তারা লিয়ার লেভিনের ফুটেজকে নবরূপায়ণ দেন ‘মুক্তির গান’ ছবিতে। লেভিনের এই প্রয়াসে বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামের তাৎপর্যপূর্ণ দিক দালিলিকভাবে ফুটে ওঠেছে।
বাংলাদেশকে নিয়ে চলচ্চিত্র নির্মাণের আগ্রহ সম্পর্কে ভয়েস অব আমেরিকায় এক সাক্ষাৎকারে লিয়ার লেভিন বলেন, ‘১৯৭০ সালের সাইক্লোনকে কেন্দ্র করে আমি যে তথ্যচিত্রটি তৈরি করি, তার মাধ্যমে ঘূর্ণিঝড়ে দুর্গত লোকজনের সাহায্যের জন্যে চাঁদা তোলা হয়। আমার স্ত্রীও এতে যুক্ত ছিলেন।’
১৯৭১ এ তিনি একটি ছবি তৈরির পরিকল্পনা করেন, উদ্দেশ্য ছিল যারা তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানিদের বর্বরতার শিকার হয়েছে, তাদের সাহায্য করা। বিশেষত শরণার্থীদের সাহায্যে অর্থ সংগ্রহ করা। তিনি তখন তার কোম্পানি বন্ধ করে কিছু অর্থ নিয়ে বেরিয়ে পড়লেন। লিয়ার লেভিন প্রায় ছয় সপ্তাহ পশ্চিম বাংলায় থেকে বিভিন্ন শরণার্থী শিবির ও যুদ্ধফ্রন্টের ছবি তোলেন।
বাংলাদেশ মুক্তি সংগ্রামী শিল্পী সংস্থা নামক একটি দল তখন সারাদেশ ঘুরে ঘুরে মুক্তিযোদ্ধা ও শরণার্থীদের দেশাত্মবোধক ও সংগ্রামী গান শুনিয়ে উজ্জীবিত করতেন। লেভিন জুড়ে যান এদের সাথে। তাদের সঙ্গে ট্রাকে করে ঘুরে বেড়ান। তখন পরিকল্পনা ছিল, তাদের গানের মধ্য দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের গল্প এবং মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার আগে তখনকার পূর্ব পাকিস্তানের অবস্থার কথা শোনানো হবে। এর সঙ্গে পশ্চিম পাকিস্তানিদের সহিংসতার কথাও বলা হবে। এভাবে তিনি প্রায় ২২ ঘণ্টার ফুটেজ সংগ্রহ করেন। পরে সেই ফুটেজ নিয়ে তিনি জয় বাংলা নামে ৭২ মিনিটের একটি প্রামাণ্যচিত্র নির্মাণ করেন। কিন্তু আর্থিক সহায়তার অভাবে তা আর মুক্তির আলো দেখেনি।
দীর্ঘ দুই দশকের বেশি সময়ের পর বাংলাদেশের চলচ্চিত্র নির্মাতা তারেক মাসুদ ও তার স্ত্রী ক্যাথরিন মাসুদ লিয়ার লেভিনের সঙ্গে যোগাযোগ করে তার তোলা ফুটেজগুলো সংগ্রহ করেন। যেগুলো পরবর্তীতে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক ছবি নির্মাণে এক নতুন অধ্যায় তৈরি করে।
তারেক মাসুদের সঙ্গে তার প্রথম সাক্ষাৎ প্রসঙ্গে লিয়ার লেভিন বলছেন, ‘মুক্তিযুদ্ধের সময়ে মুক্তি সংগ্রামী শিল্পী সংস্থা এর প্রধান ছিলেন মাহমুদুর রহমান বেণু। যিনি ওই সময়ে আমার ধারণ করা চিত্রের মূল ব্যক্তি ছিলেন। তিনি আবার তারেক মাসুদের চাচাতো ভাই। তার এবং অন্যান্যদের মাধ্যমেই তারেক তাকে নিউ ইয়র্কে খুজে বের করেন এবং ওই ফুটেজগুলো চান।’
১৬ মিলিমিটারে তোলা ওই ছবিটি বস্তুত সুপার সিক্সটিন পর্যায়ের এবং এর প্রাযৌক্তিক মান ছিল ব্যতিক্রম ধর্মী। তাই এর মান রক্ষা করা এবং ছবিটি যে লিয়ার লেভিনই তুলেছেন সেটি নিশ্চিত করতে তারেক মাসুদকে তিনি বিশেষভাবে বলেন। তবে এর বিনিময়ে তিনি কিছুই চাননি।
লেভিনের বানানো ৭২ মিনিটের ‘জয় বাংলা’ মুক্তির মুখ না দেখলেও তারেক মাসুদের হাতে সম্পাদিত হয়ে তা মুক্তির গান শিরোনামে আত্মপ্রকাশ করে।
তারেক মাসুদ চলচ্চিত্র যাত্রা নামক নিবন্ধ সংকলনে লিয়ার লেভিন-আমাদের মুক্তির সারথি শিরোনামে একটি প্রবন্ধ লিখেছিলেন। সেখানে তিনি উল্লেখ করেন, শুধু লিয়ার লেভিনের ফুটেজ নয়, মুক্তির গান এর জন্য আমরা যুক্তরাষ্ট্র , কানাডা, ইংল্যান্ড, ফ্রান্স, ভারত সহ বিভিন্ন দেশ থেকে প্রচুর ফুটেজ সংগ্রহ করেছি। তবে সেগুলো দেখে মনে হয়েছে, লিয়ারের কাজের সামনে লাখো ঘণ্টার ফুটেজও কিছ না। তার ফুটেজ ও সহযোগিতায় ‘মুক্তির গান’র অস্থিমজ্জা দাঁড়িয়েছে।
লিয়ার লেভিনই নিউ ইয়র্কে বছর তিনেক আগে বাংলাদেশ সম্পর্কে এক স্মৃতিচারণমূলক অনুষ্ঠানে জানান, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় ছয় সপ্তাহে ৭২ ঘণ্টা তথ্যচিত্রের ভিডিও ধারণ করার পর তিনি ভারতে গ্রেফতার হন। প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর নির্দেশে তাকে ভারত এবং বাংলাদেশ ত্যাগ করার নির্দেশ দেওয়া হয়। এক সপ্তাহ কারাবাস শেষে সহকর্মীসহ তাকে ভারত ত্যাগ করতে হয়।
অনুষ্ঠানে লিয়ার লেভিন বাংলাদেশিদের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে আরো বলেন, আমেরিকানরা কেউ কাজ করার পর কে কাজটি করেছিল প্রয়োজন শেষে ভুলে যায়। বাংলাদেশের মানুষ আমাকে যেভাবে সম্মান করে যাচ্ছে তাতে আমি অভিভূত। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ আমার জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ।
২০১৩ সালের ২৭ মার্চ বাংলাদেশ সরকার মুক্তিযুদ্ধের এই মহান বন্ধুকে ঢাকায় অবস্থিত বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে সম্মাননা প্রদান করেন। বাংলাদেশের অন্যতম বান্ধব লিয়ার লেভিনের জন্য আমাদের অনেক অনেক শুভকামনা।
লেখক : সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ত্ব ও শিল্প সমালোচক।
আপন দেশ/এমআর
মন্তব্য করুন # খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, আপন দেশ ডটকম- এর দায়ভার নেবে না।