অনজন রহমান।
রাষ্ট্রীয় দায়বদ্ধতায় দেশের সাধারণ মানুষের আর্থ-সামাজিক, সাংস্কৃতিক উন্নয়ন ও বিকাশে সম্প্রচার কার্যক্রম প্রচারের উদ্দেশ্যেই বিটিভি। নানা উন্নয়নমূলক অনুষ্ঠানের মাধ্যমে বিটিভি গণমানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষার অন্যতম অগ্রদূত হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে সারাবিশ্বে। কিন্তু এ গণমাধ্যমটি রাষ্ট্রিয় রাজনৈতিক ইচ্ছা বাস্তবায়নে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করায় এটি দেশের মানুষের কাছে বোকাবাক্স রাষ্ট্রিয় সরকারের মুখপাত্র হয়ে দাড়ায় এবং দর্শক প্রিয়তা হারায়।
অথচ আশির দশকের আগে ও পরে ছিল দেশে সবচেয়ে জনপ্রিয় ছিল বাংলেদেশ টেলিভিশন। শিশু-কিশোর, যুবক-বয়স্ক সবার জন্য ছিল অনুষ্ঠান। ততকালিন বিটিভিতে অনেক অনুষ্ঠান শুরু হলে রাস্তাঘাট জনশুন্য হয়ে পড়তো। বিশেষ করে বিটিভির ম্যগাজিন অনুষ্ঠান, ধারাবাহিক নাটকগুলোর কথা বলা যায়।
আপনাদের স্পষ্ঠই মনে আছে, শিশু কিশোরদের জন্য ছিল শিশু ও কিশোরমেলা অনুষ্ঠান, বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া ছাত্রছাত্রী-যুবকদের জন্য ছিল জ্ঞান জিঙ্গাসা, যুবমেলা অনুষ্ঠান। এ অনুষ্ঠানগুলো থেকে বেরিয়ে এসেছিল আবদুর নূর তুষার, ফরহাদুর রেজা প্রবালের মত জনপ্রিয় উপস্থাপক। কুমার বিশ্বজিত, আবদুল মান্নান রানা, সৈকত দাসের মত জনপ্রিয় সঙ্গীত শিল্পী। যুবমেলার কুমার বিশ্বজিতের সেই ‘তোরে পুতুলের মত করে সাজিয়ে’ গানটি এখনো কানে বাজে।
ছোটদের অনুষ্ঠান দিয়ে যদি শুরু করি। প্রথমেই আসবে বিটিভির যুগান্তকারী অনুষ্ঠান ‘নতুন কুঁড়ি’। এ নতুন কুঁড়ি থেকে বেরিয়ে আসা শিশুশিল্পী ঈশিতা, তারিনরাই পরবর্তিতে এ অঙ্গনে নেতৃত্ব দিয়েছে। শিশুপ্রেমি স্বাধীনতার ঘোষক জিয়াউর রহমান সরাসরি অনুষ্ঠানটির সাথে সম্পৃক্ত ছিলেন। একটি স্যাটালাইট টেলিভিশন ‘টক শো’ কে জনপ্রিয় করলেও এ টক শোসহ বেশীরভাগ টেলিভিশন অনুষ্ঠানের পাইওনিয়ার বিটিভি। যা আজ অবহেলিত।
যুগের সাথে তাল মেলাতে পারছে না। যদিও ২৫ জানুয়ারি ২০১১ সালে ডিজিটাল টেরিস্ট্রিয়াল সম্প্রচার শুরু হয় এবং মোবাইল টিভি সম্প্রচার শুরু (টেলিটক মোবাইলে) ২৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৪।
আশা যাক টেলিভিশন নাটকের কথায়। টেলিভিশন নাটকের কথা বলতে গেলেই চোখে ভাসে মগজে নাড়া দেয় কিছু নাম যা উজ্জ্বল নক্ষত্রের মত। আতিকুল হক চৌধুরী, আবদুল্লাহ আল মামুন, নওয়াজেস আলী, বরকত উল্লাহ ও মুসা আহমেদের নাম। তখনকার একেকটি ধারাবাহিক একেকটি ইতিহাস। কি নক্ষত্রের মত নাম বিবেককে নাড়া দেয়। বেগম মমতাজ হোসেনের ‘সকাল সন্ধ্যা’ এক বিস্ময়।
ধারাবাহিক নাটক শুকতারা, বহূব্রীহি, অয়োময়, ভাঙনের শব্দ শুণি ও এইসব দিনরাত্রি। এইসব দিনরাত্রি নাটকটি আধুনিক নাট্যধারা এক পাইওয়িার সংযোজন। ওই সময়ে ওয়ার্ল্ড ওয়াইড জনপ্রিয় হলিউড সিরিয়াল ডাইনেস্টি’র সাথে ফাইট দেয়ার মত এক নাটক।
এ নাটক নিয়ে অনেক নাটক হয়েছে বিগত সময়ে, অর্থাত ১৯৯৫ উত্তর প্যাকেজ নাটক শুরুর কাল থেকে। এ সময়টাকে বলতে পারেন আমাদের টিভি নাটকের পতনের কাল। তখনকার প্রিভিউ কমিটির সদস্যরাও হয়েছেন অনেক টাকার মালিক। তখনকার ঈদের নাটকের জনপ্রিয় নাট্যকার, পরিচালকদের নাটকের অগ্রিম প্রিভিউ এবং নিউজ করতে যেয়ে গোপন সূত্রে দেখা গেছে, প্রযোজনা সংস্থা তার ক্ষমতা বলে খালি স্টিকারযুক্ত ক্যাসেট জমা দিয়ে প্রিভিউ এবং ঈদের প্রথম দিনে বুকিং কনফার্ম করেছেন।
এ নোংরামিটা শুরু হয়েছিল আশির দশকের মাঝামাঝি থেকে। প্রযোজকদের বাড়াবাড়ি, ক্ষমতার অপব্যবহার, শিল্পীদের নামে-বেনামে চেক জালিয়াতি, শিল্পীদের সাথে অসদ আচরণ, অডিশন গ্রেডেশন বোর্ড বাতিল এবং সর্বপরি শিল্পীদের ব্লাক লিস্টেড করা। এসময়েই টেনাশিনাস’ টেলিভিশন নাট্য শিল্পী ও নাট্যকার সংসদের প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক আবদুল মতিনের নেতেৃত্বে টিভি গেটে বনদ্ ডাকা হয় এবং সরকার শিল্পীদের সাথে সমঝতা করে দাবি-দাওয়া মেনে নিয়ে ব্লাক লিস্ট তুলে নেয়।
কিন্তু তারই ধারাবাহিকতায় বিগত ফ্যাসিবাদের ১৬ বছরে বিটিভি রুপ নেয়। সেই বোকাবাক্সে রাষ্ট্রিয় সরকারের মুখপাত্র হয়ে দর্শক জনপ্রিয়তা হারায়। শিল্পীদের মধ্যে গড়ে তোলে বিভেদ, করা হয় ব্লাকলিস্ট। এ ব্লাক লিস্টের আওতায় একশ্রেণীর জ্ঞানপাপি ফ্যাসিবাদের আদর্শ উদ্দেশ্য চরিতার্থে ঐক্যবদ্ধ হয়ে বিটিভিকে করে তোলে রাজনৈতিক ইচ্ছা বাস্তবায়নে হাতিয়ার।
ফ্যাসিষ্ট রাজনৈকতিক ব্যক্তিত্ব, মন্ত্রী-এমপিদের নিয়ে নানা আঙ্গিকে টক শো, মুজিববাদের একতরফা বন্দনা, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়নের নামে একপরিবারের বন্দনা, প্রিভিউ কমিটির একচ্ছত্র আধিপত্যে, পিক আওয়ারসহ নানা সময়ে তাদের সমর্থিত প্রয়োজনা সংস্থার নাটক ও অনুষ্ঠান প্রচার করে।
স্যাটালাইট চ্যানেলের প্রচারিত অনুরুপ অনূষ্ঠান বিটিভিতে প্রচার করতে বাধ্য করে।
যদিও অনুরুপ অনুষ্ঠান বিটিভিতেই প্রচারিত হচ্ছিল। রাজনৈতিক ইচ্ছায় এবং ক্ষমতা বলে বিশেষ কর্মকর্তা-কর্মচারী টাকার কুমির হয়ে উঠে। এমনকি বিটিভি সংবাদেও তাদের স্বীয় চরিতার্থ বাস্তবায়নের জন্য ফ্যাসিস্ট সরকারের বাছাইকৃত লোককে সংবাদ প্রতিনিধি করা হয়।
প্রশাসনের আর্কাইভে থাকা অনেক অনুষ্ঠানের অংশ এবং কখনো পুরো অনুষ্ঠানই অন্যান্য সেটালাইট টেলিভিশনে প্রচার হতে দেখা যায়। বিটিভির অনেক প্রযোজক দাবি করেন, অমুক টিভি চ্যানেলে প্রচারিত অমুক অনুষ্ঠানের অংশ/পুরো অনুষ্ঠানটি তার। সরকারি খরচে নির্মিত অনুষ্ঠান আর্কাইভ থেকে অন্য চ্যানেলে প্রচার হতে দেখা যায়। একসময় বিটিভিতে সোনালী সময়ের গান, নাটক, অনুষ্ঠান পুণ: প্রচারিত হতো, এখন আর সেগুলো হয় না।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, সেই উল্লেখযোগ্য অনুষ্ঠান/তথ্যচিত্র বিটিভি আর্কাইভে নাই। এখন আরও সুযোগ, তারা হয়তো বলবে দুস্কৃতকারীরা আগুন দিয়ে জালিয়ে দিয়েছে, নতুবা নিয়ে গেছে বিটিভি আর্কাইভ থেকে। জুলাই ২৪ আন্দোলনের বিজয়ের পর কতদিন বৈষম্য ও ফ্যাসিবাদমুক্ত থাকবে এ বিটিভি সেটাই এখন দেখার বিষয়।
মন্তব্য করুন # খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, আপন দেশ ডটকম- এর দায়ভার নেবে না।