Apan Desh | আপন দেশ

বীর প্রতীক তারামন বিবির একটি অজানা গল্প 

সুপর্ণা দে

প্রকাশিত: ১৮:২৮, ২৩ এপ্রিল ২০২৫

আপডেট: ১৮:৩০, ২৩ এপ্রিল ২০২৫

বীর প্রতীক তারামন বিবির একটি অজানা গল্প 

ছবি পরিচিতি: বাম থেকে ডানে পিছনে সোলায়মান সরকার, বিমলকান্তি দে, আজহারুল ইসলাম ও সবুর ফারুকী। সামনে তারামনের মা, পুত্র তাহের, তারামন বেগম বীরপ্রতীক, স্বামী আবদুল মজিদ ও কন্যা মাজেদা বেগম। সৌজন্যে: গিরিধর দে/ বাংলাদেশের দুষ্প্রাপ্য ছবি সমগ্র

উপাধিপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধাদের একটি তালিকায় তাঁর নাম দেখা যায়। সরকারি গেজেটে খোঁজ নিয়ে দেখা যায়, সেখানেও তাঁর নাম আছে। কিন্তু কেবল তাঁরই কোনো খোঁজ মিলছিলো না। ময়মনসিংহে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক গবেষক অধ্যাপক বিমল কান্তি দে নেমে পড়লেন সে উপাধিপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধাকে খুঁজে বের করার মিশনে।

এরপর কি হলো, কোথায় ছিলেন তিনি এবং কীভাবেই বা লোকচক্ষুর আড়াল থেকে সামনে এলেন বীর প্রতীক তারামন বিবি সেই ঘটনার পেছনের গল্পই ছবিসহ দুই বছর আগে "বাংলাদেশের দুষ্প্রাপ্য ছবি সমগ্র" গ্রুপের পাতায় লিখে শেয়ার করেন অধ্যাপক বিমল কান্তি দে-এর কন্যা সুপর্ণা দে।

পোস্টে তিনি লিখেন, “প্রয়াত বীর প্রতীক তারামন বিবিকে জনসমক্ষে নিয়ে আসার পেছনের গল্প ও ছবি আমার বাবা বিমল কান্তি দে’র জবানিতে শেয়ার করছি এ পেইজে। এ গল্পের আগে আছে বাবার দীর্ঘ সাত বছরের ব্যক্তিগত, একক নিরলস প্রয়াস। এখানে তুলে ধরা হলো শুধু সেই প্রয়াসের শেষ এবং সার্থক একটি দিনের কথন।
বাবা (প্রফেসর বিমলকান্তি দে)-এর উদ্বৃতিতে,

বিশাল ব্রহ্মপুত্র নদ যখন আসামের পাহাড়ঘেরা এলাকা ছেড়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করলো, তখন তার আনন্দ দেখে কে? বিশাল এলাকা জুড়ে ছড়িয়ে পড়েছে সে নদী। চর-নদী- স্রোতা- চর নদী পেরিয়ে রৌমারী থেকে কুড়িগ্রাম যাওয়া খুবই কঠিন।
তারামনের গ্রাম শঙ্কর মাধবপুর যেতে হলে রাজীবপুর থেকে তিনটি চর ও দুটি নদী পাড়ি দিতে হয় । ওই অঞ্চলে আমি দফায় দফায় চিঠি লিখেছি। বিভিন্ন সূত্রে কারো কাছে দুটি কারো কাছে তিনটি। জামালপুর জেলার সানন্দবাড়ি গ্রামে রবিউল নামে আমার এক ছাত্র থাকে। তার মাধ্যমে আমি সানন্দবাড়ীসহ দেওয়ানগঞ্জ, রাজীবপুর ও রৌমারী থানার সকল মুক্তিযোদ্ধার তালিকা সংগ্রহ করি। দৈবচয়ন ভিত্তিতে চিঠি পাঠিয়েছি। রৌমারীর অদুদ মন্ডল ও রাজীবপুরের চিঠির জবাব পেয়েছি। এদের কেউ কেউ দু’তিনটি চিঠি পেয়েছেন। যার বাড়িতে তারামনের দেখা তিনি তিনটি চিঠি পেয়েছেন, বাট নো রিপ্লাই।

তারামনকে খুঁজে পেতে বিলম্ব হওয়ার অন্যতম কারণ তার পারিবারিক পরিচয় সূত্র। গেজেটে তার স্বামীর নাম ছিল মেসের আলী। সেটি তার প্রথম স্বামীর নাম। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর তারামনের বিয়ে হয়। অল্প পরে মেসের আলী মারা যায়। কিছুদিন পর দ্বিতীয় বিয়ে হয়। সে ছিল উন্মাদ। অল্প পরে সে নিখোঁজ হয়। তৃতীয় বা বর্তমান স্বামীর নাম আব্দুল মজিদ। এসব না জেনে আমি মেসের আলীর স্ত্রী তারামনকে খুঁজি, লোকে হয়ত মজিদের স্ত্রী তারামনকে পোস্টিং দিতে পারে না। আমি সন্ধান করার পূর্ব পর্যন্ত তারামন খুবই নগণ্য, সে তার মুক্তিযোদ্ধা পরিচয় প্রকাশ করতো না। পরে জানলাম সে মুসলিম মেয়ে এবং প্রথম যৌবনেই পুরুষের পাশাপাশি যুদ্ধ করেছে একথা সমাজে জানলে তো মেয়ের বিয়েই হবে না। 

২৮ অক্টোবর/১৯৯৫ সন বেলা দশটা নাগাদ আমরা শঙ্করমাধবপুর গ্রামে মুক্তিযোদ্ধা সোলায়মান সরকারের বাড়ি যাই। আগে থেকে তারামন সেখানে ছিল। লম্বা শীর্ণ, রুগ্ণ চেহারা তাঁর। আমাদের সামনে বসে আছে। মাঝে সাজে খুক খুক করে কাশছে। আশেপাশে অনেক প্রতিবেশী। তারা তারামনকে দেখতে আসেনি, শহরের লোক দেখতে এসেছে। শুধু আমিই গেছি সেই গুপ্তধন দর্শনে। আমি দেরি করিনি। সঙ্গীকে টেপ রেকর্ডার ও ক্যামেরা দিয়ে নিজে খাতা কলম নিয়ে বসলাম। আমি প্রশ্ন করে যাচ্ছি-- আপনার নাম কি, বাড়ি কোথায় ইত্যাদি অনেক প্রশ্ন। অতিক্ষীণ কণ্ঠে তারামন কথা বলছিল, মাঝে মাঝে হাঁপাচ্ছিল। মাঝে সাজে বিশ্রাম দিয়ে দিয়ে ঘণ্টা খানেক প্রশ্ন করলাম এবং কিছু নির্দেশনা দিলাম। 

সোলায়মানের বাড়িতে আমরা ডাল মাছ ভাত খাব এর ফাঁকে তারামনকে বাড়িতে পাঠিয়ে দেয়া হলো। আহারান্তে নদীর পাড় দিয়ে হেঁটে, ঢাল দিয়ে লেংচাতে লেংচাতে ২ কি.মি. গেলাম। অছাতি তীব্র রোদের গরমে ঘামতে ঘামতে নদী পাড়ি দিয়ে আমরা তারামন ভিলার দিকে অগ্রসর হই। চরের ধানক্ষেতের মাঝখান দিয়ে অনেকগুলি দ মার্কা একফুটি আইল পেরিয়ে অবশেষে তীর্থধামে গিয়ে পৌঁছলাম। কিছু মানুষ আমাদের চারপাশে এসে দাঁড়ালো। সেই বাড়িতে তিনটি শরিক, চারটি খড়ের ঘর --- তিনটি শয়নঘর, একটি কর্পোরেট রান্নাঘর কাম ঢেঁকি ঘর। ছবিতে দেখুন ১৯৯৫ সনে তারামনের একটি ভাঙা কুঁড়েঘর, চালের ছাউনি মাঝে মাঝে নেই, একটা কুমড়ো গাছ চালে লতানো। একক একটি রান্নাঘরও তারামনের নেই---হয়ত দরকারও নাই। কেননা, যখন একজন রান্না করে, দ্বিতীয় জন নিজের চাল ধোয়, তরকারি কুটে, তৃতীয়জন হয়ত শাক-লতাপাতা আনতে গেছে অকারণ রান্নাঘর নিয়ে বিলাসিতার কি দরকার।
তারামনের নয় বাই সাত হাত ঘরের ভিতরে উঁকি দিয়ে দেখলাম ঘরের অর্ধেকটায় বাঁশের ফালির মাচা, তার উপর খড়ের বিছানা। সে ঘরে ক্ষুধা-শীত-রোগ-বন্যা এ চার শত্রু এবং স্বামী পুত্র কন্যা এ তিন বন্ধুসহ তার বসবাস। বীর প্রতীকের বাড়ি দেখে আমার চোখ জলে ভরে এলো।

এ ছবিটি সম্ভবত সর্বপ্রথম জনসমক্ষে এলো। সর্বশেষ কি না জানি না। অনেকদিনের পুরোনো যক্ষ্মা রোগ নিয়েও তারামন বাঁচার জন্য সংগ্রাম করেছে। আমি তার পুরোনো প্রেসক্রিপশান দেখেছি। সে বারতিনেক রাজীবপুর, জামালপুর ও গাইবান্ধা গিয়ে চিকিৎসার চেষ্টা করেছে। আর হয়ত পয়সায় কুলোয়নি, কিংবা সরকারি হাসপাতালে ঔষধ ছিল না। 

তারামনের বাড়ি থেকে বাইরে বেরিয়ে রাজীবপুর হাসপাতালে গেলাম। রোগীকে যথাসাধ্য চিকিৎসাসেবা দেয়ার জন্য অনুরোধ করলাম। ডাক্তার সাহেব রাজী হলেন। ইন্টারভিউ নিবার সময়ে একজনকে টেপরেকর্ড করতে দিয়েছিলাম। পরে রিউইন্ড করে দেখা গেল কিছুই রেকর্ড হয়নি। ভাগ্যিস আমি খুব দ্রুত কিছু লিখতে পারি। ফেরার পথে ঔষধ কেনার জন্য অতি সামান্য কিছু টাকা তারামনের হাতে দিয়ে আসি। সন্ধ্যায় সবুর ফারুকির বাসায় ফিরে আসি। আমার সে ছাত্র রবিউল আবার এসে হাজির। আরো কজন সজ্জন এলেন। তাদের সঙ্গে সারাদিনের কর্ম বিশ্লেষণ করে কিছু কাজে সহায়তার অনুরোধ জানিয়ে বিশ্রাম, আহার ও নিদ্রা।। পরদিন সানন্দবাড়ীতে রবিউলের গৃহে গমন।

আপন দেশ/এবি

মন্তব্য করুন # খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, আপন দেশ ডটকম- এর দায়ভার নেবে না।

শেয়ার করুনঃ

সর্বশেষ

জনপ্রিয়