Apan Desh | আপন দেশ

মতপ্রকাশের আকাঙ্খা মানুষের মজ্জাগত

আবদুর রহমান মল্লিক 

প্রকাশিত: ১৭:৩২, ২৬ এপ্রিল ২০২৫

মতপ্রকাশের আকাঙ্খা মানুষের মজ্জাগত

ছবি সংগৃহীত

জন্মমাত্র সুতীব্র চিৎকারে মুষ্টিবদ্ধ হাত উত্তোলিত করে একটি শিশু তার অধিকারের কথা বিশ্ববাসীর কাছ জানান দেয়। এ অধিকারের কথাটা বলতে পারাই তার মত প্রকাশের স্বাধীনতা। মানুষের জীবনের মতপ্রকাশের দুর্দমনীয় আকাঙ্খা তার মজ্জাগত। সেই আকাঙ্খা দিনের পর দিন পদদলিত হলে তার ভেতর ক্ষোভ দানা বেঁধে ওঠে। এক সময় এ পুঞ্জিভূত ক্ষোভের বিষ্ফোরণ ঘটে। সংঘবদ্ধ হয়ে তারা রাজপথ কাঁপিয়ে গুলির মুখেও রুদ্ররোষে প্রতিবাদ জানাতে কুণ্ঠাবোধ করে না। এমনকি নিজের ও মানুষের অধিকারের জন্য মূল্যবান জীবন পর্যন্ত উৎসর্গ করে। 

ছাত্র-জনতার জুলাই বিপ্লবে সে ঘটনাই ঘটেছে। শিক্ষার্থীরা তাদের মনের কথা, হৃদয়ের কথা স্পষ্ট করে দেয়ালে দেয়ালে লিখে দিয়েছিল। নতুন নতুন স্লোগানে তারা জনগণকে উদ্দীপিত করেছিল। স্পর্ধিত বুকে তারা উচ্চারণ করেছিল-দেশটা কারও বাপের না। তারা যে রক্ত দিয়ে, জীবন দিয়ে পরিবর্তনটা এনে দিয়েছে, মতপ্রকাশের যে অবারিত সুযোগ এনে দিয়েছে, তা ঐতিহাসিক এবং যুগান্তকারী।

আরও পড়ুন<<>> মোফাজ্জল করিমের লেখা: ‘তু ক্যাম্চু’

অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূস গত ১১ সেপ্টেম্বর জাতির উদ্দেশে দেয়া ভাষণে বলেন, ‘আপনারা আমাদের সমালোচনা করুন। সংবাদমাধ্যম ও মতপ্রকাশের পূর্ণ স্বাধীনতা ইতোমধ্যে নিশ্চিত করা হয়েছে। আমরা সবাইকে বলে দিয়েছি, আপনারা মন খুলে আমাদের সমালোচনা করেন। আমরা সবার মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। মিডিয়া যাতে কোনো রকম বাধা-বিপত্তি ছাড়া নির্বিঘ্নে তাদের কাজ করতে পারে, সেজন্য একটি মিডিয়া কমিশন গঠন করা সরকারের সক্রিয় বিবেচনাধীন।’

ভয়েস অব আমেরিকা বাংলার করা এক জরিপে বলা হয়েছে, অন্তর্বর্তী সরকারের অধীন মতপ্রকাশের স্বাধীনতা পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলের চেয়ে বেড়েছে বলে মনে করেন ৬০ দশমিক ৪ শতাংশ মানুষ। আর অন্তর্বর্তী সরকারের সময় সংবাদমাধ্যম আওয়ামী লীগ আমলের চেয়ে বেশি স্বাধীনতা ভোগ করছে বলে মত দিয়েছেন ৬১ দশমিক ২ শতাংশ মানুষ। বাংলাদেশের সংবিধানের ৩৯ অনুচ্ছেদে চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতা এবং বাকস্বাধীনতা নিশ্চিতের কথা বলা হয়েছে। যেখানে রাষ্ট্রের নিরাপত্তা, বিদেশি রাষ্ট্রসমূহের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক, জনশৃঙ্খলা, শালীনতা ও নৈতিকতার স্বার্থে কিংবা আদালত অবমাননা, মানহানি বা অপরাধ সংঘটনে প্ররোচনা সম্পর্কে আইনের দ্বারা আরোপিত যুক্তিসঙ্গত বাধা নিষেধসাপেক্ষে প্রত্যেক নাগরিকের বাক ও ভাবপ্রকাশের স্বাধীনতার অধিকার এবং সংবাদপত্রের স্বাধীনতার নিশ্চয়তা প্রদান করা হয়েছে।

আরও পড়ুন<<>> হিন্দু জঙ্গিবাদী সংগঠন ইসকন নিষিদ্ধ প্রয়োজন বাংলাদেশের স্বার্থেই

সংবিধানে নাগরিকের সুরক্ষার কথা থাকলেও বিগত সরকার তা চরমভাবে লঙ্ঘন করেছে। স্বাধীন মতপ্রকাশের ক্ষেত্রে আমরা দেখেছি, নাগরিকের ওপর কতটা নিপীড়ন চালানো হয়েছে। নিরাপদ সড়কের দাবিতে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের মধ্যে ‘উসকানিমূলক মিথ্যা’ প্রচারের অভিযোগে তথ্যপ্রযুক্তি আইনে ২০১৮ সালের ৬ আগস্ট রমনা থানায় আলোকচিত্রী শহিদুল আলমের বিরুদ্ধে একটি মামলা করা হয়। ট্রায়াল ওয়াচ আরও বলেছে, শহিদুল আলমের ফেসবুক লাইভ বা টিভি সাক্ষাৎকারে সহিংসতার ডাক দেয়ার কোনো উপাদান ছিল না। তবুও তার বিরুদ্ধে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটানো এবং সামাজিক অস্থিরতা সৃষ্টিতে উসকানি ও প্ররোচণার মাধ্যমে ধ্বংসাত্মক কাজের জন্য অনুপ্রাণিত করার অভিযোগ আনা হয়। এর আগে মানবাধিকার সংস্থা অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের প্রতিবেদনে বলা হয়, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইনের ৫৭ ধারা প্রয়োগ করে এক হাজার ২০০ জনকে গ্রেফতার করা হয়। এ ধারা বাংলাদেশে ভিন্নমত দমনের প্রধান হাতিয়ার।   

সাংবাদিকদের অধিকার নিয়ে কাজ করা আন্তর্জাতিক সংগঠন রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডারসের (আরএসএফ) এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, বাংলাদেশের ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন সাংবাদিকদের জন্য বিশ্বের সবচেয়ে কঠোর আইনের মধ্যে অন্যতম। এ আইন কোনো পরোয়ানা ছাড়াই গ্রেফতার, তল্লাশি ও যেকোনো কারণে সাংবাদিকের সূত্রের গোপনীয়তা লঙ্ঘন করা অনুমোদন করে। এ ধরনের আইন বিদ্যমান থাকলে সম্পাদকেরা নিয়মিত নিজেদের ‘সেন্সর’ করেন। আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে গত বছর বিতর্কিত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন বাতিল করে এর বদলে সাইবার নিরাপত্তা আইন প্রণয়ন করা হয়। কিন্তু আইনটিও সাংবাদিকসহ বিভিন্ন মহলের তীব্র সমালোচনার মুখে পড়ে।

আরও পড়ুন<<>> মারুফ কামাল খানের লেখা: টুকরো টুকরো নানা ঘটনা গল্পের মতো করে বলবার চেষ্টা করেছি

অন্তর্বর্তী সরকার সম্প্রতি এ আইন বাতিলের বিষয়ে নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছে। সেই সঙ্গে ইতোমধ্যে সাইবার নিরাপত্তা আইনে দায়ের হওয়া মামলাগুলো প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত নিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। এসব মামলায় কেউ গ্রেফতার থাকলে আইনি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে তাৎক্ষণিকভাবে তাকে মুক্তি দেয়া হবে বলেও সরকারের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে।

বিশ্ব সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা সূচকে বাংলাদেশের বড় অবনমন ঘটেছিল ২০২২ সালে। ২০২১ সালের তুলনায় ওই বছর সূচকে বাংলাদেশের ১০ ধাপ অবনমন হয়েছিল। পরের বছর আরও এক ধাপ পেছায় বাংলাদেশ। আর এবার দুই ধাপ পিছিয়েছে। সে হিসেবে ২০২১ সালের তুলনায় ২০২৪ সালে তিন বছরে সূচকে বাংলাদেশের ১৩ ধাপ অবনমন ঘটল, ১৫২তম থেকে ১৬৫তম অবস্থানে নেমে গেল বাংলাদেশ।

রাজধানীর একটি হোটেলে ১৯ অক্টোবর ‘নাগরিক সমাজ অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যত’ শীর্ষক মতবিনিময় সভায় বলা হয়েছে, বিগত আওয়ামী আমলে সরকার ক্ষমতায় টিকে থাকতে রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠান কাঠামোর  অপব্যবহার করার পাশাপাশি বেসরকারি সংস্থাগুলোকে গোয়েন্দা সংস্থার মাধ্যমে হয়রানি করেছে। এতে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা ক্ষুন্ন হয়েছে। 

অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেয়ার পর থেকে আমরা লক্ষ করছি, রাষ্ট্রপ্রধান কিংবা গুরুত্বপূর্ণ কারও বিরুদ্ধে সোস্যাল মিডিয়ায় সমালোচনা করলে তাকে গ্রেফতার করা হয় না। যার যা খুশী বলছে। কিছুদিন তো দেশটা গুজবের দেশে পরিণত হয়েছিল। যা কিছুটা হলেও কমে এসেছে। কারণ গুজবের পাল্টা প্রতিক্রিয়া মানুষ জানতে পারছে। অন্তর্বর্তী সরকারের সমালোচনা যেমন হচ্ছে, তেমনি একটি দলের নেতাকর্মী আরেকটি দলের নেতাকর্মীদের সমালোচনা করছে। তবে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা মানে যা খুশী তাই বলা নয়। যা বলা উচিত তাই বলা। আমরা দেশটার প্রতি দায়িত্বশীল হই। নিজ অবস্থান থেকে দেশের জন্য কাজ করি। জুলাই বিপ্লবের অর্জন যেন ম্লান না হয়ে যায় সে ব্যাপারে সতর্ক থাকি।

আপন দেশে/এবি

মন্তব্য করুন # খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, আপন দেশ ডটকম- এর দায়ভার নেবে না।

শেয়ার করুনঃ

সর্বশেষ

জনপ্রিয়