ছবি : আপন দেশ
আগামী সাধারণ নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে হবে, নাকি সংবিধান অনুযায়ী বর্তমান শাসক দলের অধীনেই হবে? যদি তত্ত্বাবধায়ক সরকার না হয়, তাহলে বিএনপি ও তার মিত্রদলগুলো কি নির্বাচনে অংশ নেবে? এই সব প্রশ্ন সাধারণের মনে ঘুরপাক খাচ্ছে। কিন্তু উত্তর নেই।
আওয়ামী লীগ ও এই দলের আশির্বাদপুষ্ট আণুবীক্ষনিক দলগুলোর মাঠ পর্যায়ের অ্যাক্টিভিষ্টদের বেশিরভাগই আশা পোষণ করেন যে, ইলেকশন আগের মতোই হবে, হতে হবে।
ক্ষমতাসীন দলের সুবিধাভোগী অ্যাক্টিভিস্ট সাংবাদিক, টকশো পিপলস, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও আইনজীবীরাও মেঠো কর্মীদের মতোই ভাবতে পছন্দ করছেন যে, ইলেকশন আগের মতই হবে। আর যারা এক দফার আন্দোলনে আছে. তারা এমন ভাব দেখাচ্ছেন যে, শেখ হাসিনা সরকার পড়ে গেলো বলে!
প্রকৃত পক্ষে কী ঘটতে যাচ্ছে? তবে এই অবসরে একটা ভবিষৎবাণী করতে চাই। ইলেকশান কাটাছেঁড়া শাসনতন্ত্রের অধীনেই হোক, আর কেয়ারটেকারের অধীনেই হোক; এবার খুব দৃঢ়ভাবেই আশা করা যায় যে, ভোট হবে অবাধ ও প্রভাবমুক্ত। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা এখন পর্যন্ত প্রত্যাশিত রোল প্লে না করলেও শীঘ্রই অবস্থান পরিবর্তন করবে বলেই প্রতীয়মান হয়। অন্তত নগ্ন পক্ষপাতিত্বের ঝুঁকি তারা হয়তো নেবে না। এই পরিস্থিতিতে ভোটার সাধারণ, আশা করা যায় , যে যার ভোট দেয়ার সুযোগ পাবেন। কেন অতটা আশাবাদ ব্যক্ত করছি, সেটাই এখানে আলোচনা করবো।
বিএনপির এক দফার দাবি আসলে একটা প্যাকেজ। এর মধ্যে আরও অনেক কিছু আছে। প্রধানমন্ত্রী শেখহাসিনার পদত্যাগ; এটা প্রধান দাবি। তারপরেই আছে বর্তমান সংসদ ভেঙে দিতে হবে, তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন করতে হবে, নতুন নির্বাচন কমিশন গঠন করতে হবে, বেগম জিয়ার মুক্তি, তারেক রহমানের মামলা প্রত্যাহার ইত্যাদি। সাথে রয়েছে বাম ও ছদ্মবেশি বাম, ডানপন্থী অনেক দল ও জোট। তারা রাষ্ট্র মেরামতের কথাও বলছেন। রাষ্ট্র মেরামত মানে কী, তা অবশ্য জানেন না দেশের আমজনতা। কাজেই রাষ্ট্র মেরামতের দাবি গণদাবি নয়। গণদাবি হলো, অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন, যে নির্বাচনে ভোটার সাধারণ নির্ভয়ে ও নির্বিঘ্নে স্বতস্ফুর্তভাবে ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারবেন।
আতা সরকারের লেখা: কলাপাতার লিখন ও গুডলাক কালি
অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক সংগ্রামের পাশাপাশি বর্তমান দুনিয়ার মোড়ল ও শক্তিশালী গণতন্ত্রের দেশ আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র ও তার পশ্চিমা মিত্রদের পক্ষ থেকে ঘন ঘন কড়া বার্তা প্রেরণ করা হচ্ছে বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষের কাছে। তাদের প্রতিনিধি দল আসা- যাওয়াও করছেন ফ্রিকুয়েন্টলি। তারা সরকার ও বিরোধী দলের সাথে, বৈঠক করে চলেছেন সমানেই। নির্বাচন কমিশনের সাথেও কথা বলেছেন। আর এদিকে বাংলাদেশে নিযুক্ত বহুল আলোচিত মার্কিন অ্যামবেসডর পিটার হাস তো আছেনই। পিটার হাসের চলাফেরার খবর এখন সাংবাদিকদের নখদর্পণে । মাঝে মাঝে মনে হয় বাংলাদেশের রাজনৈতিক কোটে মিনিস্টার ইন চেজ ( দাবার কোটের মন্ত্রী) হয়ে উঠেছেন এই পিটার হাস।
রাজপথের প্রধান ও অপ্রধান সব দলেরই এক দাবি শেখ হাসিনা সরকারের অধীনে নির্বাচন হওয়া চলবে না। পক্ষান্তরে সরকারি দলেরও এক কথা, সংবিধান অনুযায়ী শেখ হাসিনার অধীনেই ফ্রি অ্যান্ড ফেয়ার ইলেকশন হবে। বিদেশীদেরও কথা একটাই যে, তারা অংশগ্রহণমূলক ফ্রি ফেয়ার ইলেকশন চান। কোনো পক্ষকে বাদ দিয়ে ভোট করা তারা সমর্থন করবে না। মত প্রকাশের স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে হবে। নির্বিঘ্নে রাজনৈতিক কর্মসূচি পালনের সুযোগ, আইন-শৃংখলা বাহিনীর নিরপেক্ষতা ইত্যাদি নিশ্চিত করতে হবে বলে তারা তাগাদা দিয়ে যাচ্ছেন। এসব বিষয়ে কথা বলছে খোদ জাতিসংঘও। কিন্তু তারা তত্ত্বাবধায়ক সরকার বা বর্তমান শাসনতন্ত্রের বাইরে গিয়ে জাতীয় সংসদ ভেঙ্গে দেয়ার কথা বলছে না। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের পক্ষে বা বিপক্ষে কোনো কথা বলছে না । আর এই না বলার বিষয়টিকে মাথায নিয়ে ক্ষমতাসীন দলের মুখপাত্রদের কেউ কেউ বলতে চাইছেন যে, বিদেশিরা তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কোনো কথা বলেননি। এতে তারা বাহ্যত খুবই খুশি । তারা এমনও বলছেন যে, বিএনপির একদফা মাঠে মারা গিয়েছে।
তবে, বিদেশি পর্যবেক্ষক–প্রতিনিধিদের পক্ষ থেকে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে এমনও বলা হয়েছে যে, আমরা প্রভাবমুক্ত অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের জন্য বাংলাদেশের রাজনৈতিক পক্ষগুলোর সাথে কাজ করছি। অবাধ ও সুষ্ঠু ইলেকশন করার জন্য কি কি পদক্ষেপ নিতে হবে, সেটা ঠিক করবে এদেশের রাজনৈতিক দলগুলো। এটা তাদের বিষয়। আমরা অবাধ, স্বচ্ছ ও অংশগ্রহণমূলক ইলেকশন চাই। এই বক্তব্যের মানেও কিন্তু পরিস্কার। এবার বিএনপি বা অন্য কোনো দলকে বাইরে রেখে ইলেকশন করা শাসকদলের পক্ষে সহজ নাও হতে পারে।
হারুন হাবীরের লেখা: বাঙালি সংস্কৃতির বাড়ন্ত প্রতিপক্ষ
সরকার পক্ষ মুখে যতই বলুক না কেন যে, বিদেশিরা যে যাই বলে বলুক, তার তোয়াক্কা আওয়ামী লীগ করে না । বাস্তবের পরিস্থিতি রিভার্স। সরকারি দলের প্রতিনিধিরাও দেন দরবার করছেন বিদেশী ডিপ্লোম্যাটদের সাথে। তার মানে তোয়াক্কা করছেন। প্রতিবেশী ভারতও কিন্তু আগের মতোই বিনা প্রশ্নে ক্ষমতাসীনদের পক্ষে কোমর বেঁধে নেমে যাবে, সেই পরিস্থিতি আর নেই। ভারতও বলছে তারা বাংলাদেশে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন চায়। ভারতের সাথে দেনদরবার করতে আওয়ামীলীগ প্রতিনিধি দল পাঠিয়েছে। এই প্রতিনিধি দল দিল্লীর মন কতটা বদলাতে পারবে , তা বলা মুশকিল।
কেননা জিয়োপলিটিক্যাল ক্যালকুলেশান কোল্ড ওয়ারের সময়ের মত আর সরল নেই। ইন্দিরাগান্ধীর ভারত গাঁটছড়া বেঁধে ছিলো তখনকার সুপার পাওয়ার সোভিয়েত ইউনিয়নের সাথে। চীনের সাথে বিরোধ থাকলেও আমলে নেয়নি। আর চীনও তখন বাংলাদেশের মিত্র ছিলো না। সোভিয়েত ইউনিয়নের সাথে টেক্কা দিয়ে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ বাংলাদেশে দাঁত বসাতে পারেনি। রাশিয়া এখন কাগুজে বাঘ। ইউক্রেন দখল করতে গিয়ে পুতিনের নিজের অবস্থাই লেজেগোবরে। এমতাবস্থায় বাংলাদেশের মত একটি ছোট বন্ধুর জন্য খুব বেশি পানিতে রাশিয়া নামবে না। বাংলাদেশের সবচেয়ে শক্তিশালী মিত্র এখন চীন। আর চীন ভারতের জান-ই দুশমন। চীনের দিকে বেশি ঝুঁকলে ইন্ডিয়া বেজার। ইন্ডিয়র সাথে মাখামাখি বেশি হলে চীন বেঁকে বসবে। দীল্লি এখন আমেরিকার মিত্র।
বাংলাদেশের জন্য এই ভূ-রাজনৈতিক পরিস্থিতি একটা জটিল অবস্থা তৈরি করেছে। এই বাস্তবতায় শেখ হাসিনা সরকার বর্তমান সংবিধানের অনুযায়ী তার সরকারের অধীনে অবাধ, সুষ্ঠু ও প্রভাবমুক্ত নির্বাচনের বিশ্বাসযোগ্য প্রতিশ্রুতি দিয়ে এক দফার দাবিকে দুর্বল করে দেবার সর্বপ্রযত্ন চেষ্টা চালিয়ে যাবে বলেই অনুমান করা যায়। সরকার এতে সফলকাম হলেও আমেরিকা ও তার পশ্চিমা গণতান্ত্রিক মিত্ররা উপরন্তু খোদ জাতিসংঘ বাংলাদেশে অবাধ, প্রভাবমুক্ত এবং সকল পক্ষের অংশগ্রহণ নিশ্চিত না করে থামবে বলে মনে হয় না। আন্তর্জাতিক সমাজের বহুমুখী চাপ উপেক্ষা করার শক্তি বাংলাদেশের নেই। বিএনপি ও তার মিত্রদের নির্বাচনে আনার জন্য সরকার কিছু দাবি মেনেও নিতে পারে।
রাজনীতিতে শেষ কথা বলে কিছু নেই; এই মন্ত্র বিএনপিরও জানা আছে। আবার তত্ত্ববধায়ক সরকার হয়ে গেলেও অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না। তবে আওয়ামীলীগ তত্ত্বাবধায়কের দাবি পাশ কাটিয়ে যাওয়ার জন্য বিদেশিদের সাথে দেনদরবার করছে বলেই মনে হচ্ছে। চীন ও ভারতকে ম্যানেজ করার চেষ্টা করছে। আওয়ামীলীগের একটি প্রতিনিধি দল কানাডাও সফর করেছে।
আবদুল আউয়াল ঠাকুরের লেখা: ভাষা স্বাধীন বলেই দেশ স্বাধীন
আওয়ামীলীগের প্রতিনিধি দল ভারত থেকে ফিরে এলে সরকার কি করবে, তা আরও স্পষ্ট হবে। তথ্যাভিজ্ঞ মহলের অনেকেই বলছেন, পরিস্থিতিদৃষ্টে মনে হচ্ছে পনের বছর ক্ষমতায় থাকার পর আওয়ামীলীগ এবার আর অতীতের পথে পা বাড়াবে না। ঢাকা-১৭ আসনের নির্বাচন ছিলো একটা টেস্ট কেস। এখানে শাসক দলের অভিজ্ঞতা সুখকর হয়নি। আন্তর্জাতিক সমাজের চাপে যারা একজন প্রার্থীকে পুলিশের সামনে মেরে তক্তা বানিয়ে দিলো, তাদেরই আবার গ্রেফতার করতে হলো। শাসকদলের নীতিনির্ধারকরা সব মিলিয়ে পরিস্থিতি কোন দিকে যাচ্ছে, তা বুঝতে পারছেন না, এমনটি চিন্তা না করাই উচিত। বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী এবং বিরোধী বলয়ের দলগুলো দেড় দশকে সাংগঠনিকভাবে বেশ শক্তিশালী হয়ে উঠেছে।
১৯৯৬ সালে ১৫ ফেব্রুয়ারির এক তরফা নির্বাচন করে বিএনপি খুব কম সময়ই ক্ষমতায় থাকতে পেরেছিলো। ২০০৭ সালে নির্বাচন নিয়ে চালাকির ফল কতটা খারাপ হয়েছিলো, সেও কারও অজানা নয়। এক্ষেত্রে বাইরের দুনিয়ারও বহু দৃষ্টান্ত রয়েছে। ফিলিপিনসের কথা। ১৯৮৬ সালে ১৬ ফেব্রুয়ারি ব্যাপক জাল-জলিয়াতির নির্বাচনে কোরাজন একুইনোকে হারিয়ে ফার্দিনান্দ মার্কোসকে বিজয়ী ঘোষণা করা হয়েছিলো। সাথে সাথে ফুঁসে উঠলো ফিলিপিনস। জরুরি অবস্থা জারি করেও শেষ রক্ষা হয়নি। গণ অভ্যুত্থান দমন করা যায়নি। মার্কোসকে ক্ষমতা ছেড়ে বিদেশে আশ্রয নিতে হয়েছিলো, আমেরিকা কোরাজন একুইনোকে বিজয়ী বলে মেনে নিলো। দেশ ও বিদেশের এই শিক্ষা সামনে থাকতে আওয়ামীলীগ জাল-জালিয়াতিরর ইলেকশনের ঝুঁকি নেবে কি?
পক্ষান্তরে শাসক দল যদি সকল অর্থে ফেয়ার ইলেকশান নিশ্চিত করে, তাহলে নৌকার ভরাডুবি হবে, এমনটি হলো সস্তা আবেগের কথা। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দলকে সংগঠিত করতে যে সব পদক্ষেপ নিচ্ছেন, তা নিশ্চিত করা গেলে ভোটের রেজাল্ট খারাপ হওয়ার কোনো কারণ নেই। আওয়ামী লীগের উন্নয়ন- অর্জনের দিকগুলো কিন্তু অস্বীকার করা যায় না। সাইলেন্ট মেজরিটি অবশ্যই এইসব অর্জনের মূল্যায়ণ করবেন। দেশের মানুষ সুশাসন চায়, কোনো বিশেষ দলের ব্রুট মেজরিটি চায় না। চায় ভারসাম্যপূর্ণ একটা পার্লামেন্ট; যেখানে একটি শক্তিশালী ও কার্যকর বিরোধী দল থাকবে।
এ বিষয়ে আলোচনা হবে বারান্তরে।
ফাইজুস সালেহীন: বহুদর্শী কলামমিসট ও কথা সাহিত্যিক
মন্তব্য করুন # খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, আপন দেশ ডটকম- এর দায়ভার নেবে না।