প্রতিকী ছবি
ঘটনাটা গত শতকের সত্তর দশকের প্রথম দিককার। মুক্তিযুদ্ধের চার বা পাঁচ বছরের মধ্যে।
ছবি গুন্ডা জামালপুর শহরে নিজেই একা একা কার্ফ্যু জারি করে দিল।
আমি তখন জামালপুরে থাকি না। আমাদের পরিবারও না। ঘটনাটার কিছুটা পত্রিকায় পড়েছি। বাকীটুকু লোকমুখে শোনা। ঘটনাটার কতটুকু সত্য আর কতখানি বাড়িয়ে বলা তা জানা নেই।
তবে ছবি গুন্ডা আমার চেনা। তাঁর সম্পর্কে এ ঘটনার বিবরণ যতখানি শুনেছি, তা ছবি গুন্ডার পক্ষেই সম্ভব। হলেও হতে পারে।
ছবি গুন্ডার আসল নাম কিন্তু ছবি নয়, অন্য কিছু। আসল নামটা উহ্যই রেখেছি। শুধু এই নাম নয়, এ ঘটনার সাথে জড়িয়ে থাকা সবগুলো নামই।
এই ঘটনাকে সত্য হিসেবে ধরে না নিয়ে শুধুই গালগল্প হিসেবেও ভেবে নিতে পারেন।
ছবি গুন্ডাকে আমি চিনি। শুধু আমি কেন, সে সময়কার জামালপুর টাউনবাসী সবাই চেনেন তাঁকে।
আমি তখন নেহায়েতই বালক। দেওয়ানপাড়ায় সুলতান উকিলের বাসায় আমাদের পরিবার ভাড়া-বাসায় বাস করে। আমাদের দুই বাসা পরেই ছবি গুন্ডার বাড়ি। ছবির বড় ভাই মিরাজ পাটব্যবসায়ী। তাঁর আড়ত আছে শহরের মাঝখানে। মিরাজের ছোট ছেলে বয়সে ছোট হলেও খেলাধূলোর সুবাদে আমার বন্ধু। নামটা এই মুহূর্তে মনে পড়ছে না, ধরা যাক ছন্টু।
ছবির গুন্ডা পদবী কেন, কিভাবে, আমার জানা নেই। তাঁকে দেখে গুন্ডা বলে কখনো মনে হয় না। খানিকটা লম্বা। একহারা গড়ন। তবে শরীরটা ব্যায়ামপুষ্ট পেটা বলেই মনে হয়। রাস্তাঘাটে যখন চলাফেরা করেন, কখনোই হামবড়া ভাব চোখে পড়েনি। দাপুটেপনাও দেখতে পাইনি। তবে ছন্টুর ভাষায়, তার কাকার নাকি অসম্ভব সাহস।
একবার কলেজে হঠাৎ মারামারির খবর ছড়িয়ে পড়ে। রটে যায়, কলেজে শহরের ছেলেদের উপর হামলা চালিয়েছে বহিরাগতরা।
ছবি কলেজের ছাত্র নন। কিন্তু শহরের ছেলেরা আক্রান্ত এ খবরটা কোন কারণে তাঁকে বোধহয় খুব বিচলিত করে। সে সময় তাঁর এক ভিন্ন চেহারা দেখতে পাই। বাসার ভিতর থেকেই তাঁর গর্জন ভেসে আসে। ধারালো অস্ত্র হাতে তিনি বাসা থেকে বেরিয়ে পড়েন। হুংকার দিতে দিতে ছুটে যান কলেজের দিকে। তাঁর এ রূপ এর আগে কখনো দেখিনি। সে যাত্রায় কলেজে শহরের ছাত্র-ছাত্রীরা জানে বেঁচে যায় তাঁরই কারণে।
আমাদের যে বয়স, সে বয়সে থ্রিলার, গোয়েন্দা কাহিনী, ডাকাতের গল্প পড়ায় আমাদের বেশ ঝোঁক। আমাদের কাছে তখন পরিচিত ছিল স্বপন কুমারের দীপক চ্যাটার্জী, দস্যু মোহন, দস্যু বাহরাম। মাসুদ রানা তখনো পা ফেলেননি। লাইব্রেরিতে নাড়াচাড়া করি শার্লক হোমস, রবিন হুড।
এসব বইয়ের যোগান আসতো বন্ধুদের মধ্যে বই আদান-প্রদানের মাধ্যমে। ছন্টু তার কাকা ছবি গুন্ডার বাসা থেকে চুপিচুপি বই এনে আমাক পড়তে দিত, বিশেষ করে দস্যু মোহন আর দস্যু বাহরামের বই। এসব বইয়ের নাকি বিপুল স্টক ছবি গুন্ডার বাসায়।
ছবি গুন্ডার স্ত্রী পনির আপা শহরে সুপরিচিতা। আমার আপারাও তাঁকে জানেন। চিনেন। পরিচিতা। তারপরও তাঁরা কেন জানি পনির আপার সাথে গল্প করতে সে বাসায় যান না। তিনিও তাঁর বাসা থেকে বেরোন না।
সেও এক রহস্য। পরে জেনেছি, শহরের নামজাদা ছাত্রনেতা মোকাররমের সাথে প্রেম ছিল পনির আপার। কিন্তু অন্যদিকে পনির আপাকে প্রেম নিবেদন করে ব্যর্থ ছবি।
মোকাররমের সাথে পনিরের বিয়ের আসরে কিংবা বিয়ের পর পনিরকে তুলে নিয়ে যান ছবি গুন্ডা। পরে নিজেই বিয়ে করে নেন। আনুষঙ্গিক নিয়ম মেনে।
গুন্ডা অভিধা কি তখন থেকেই? কে জানে?
ছন্টুর সাথে আমি একবার ওদের গাঁয়ের বাড়িতে গিয়েছিলাম। ব্রহ্মপুত্র নদের ওপারে। পক্ষিমারী চরে। সম্পন্ন গৃহস্থবাড়ি।
এতোদিন পর পুরো বাড়ির চিত্র এখন প্রায় পুরোটাই ঝাপসা। একটা বিষয় আমাকে চমকে দিয়েছিল। সে বাড়িতে একটা গানের বইয়ের বেশ কিছু স্টক দেখতে পেলাম। বইটির লেখক আজনবী। আজনবী শব্দটির সাথে এর আগে আমার পরিচয় ছিল না। এমন নামের কোনো কবি বা গীতিকবির সাথেও না। পরে জেনেছি, আজনবী মানে অজ্ঞাতনামা। এটা গানের সংকলন। প্রকাশ করেছেন ছন্টুর বাবা মিরাজ সাহেব। তিনি ওস্তাদ ফজলুল হকের ভক্ত। গানগুলো অধিকাংশই তাঁর গাওয়া। চলচ্চিত্রকার আমজাদ হোসেন পরে তাঁর সিনেমায় এ গানগুলো কিছু কিছু ব্যবহার করেছিলেন, যেগুলো জনপ্রিয়তাও পেয়েছিল।
এতটুকু দৃশ্যপট আমার দেখা। জানাশোনার আওতায়।
এর পরের কাহিনী যেন এক বিস্ময়কর উপকথা।
মিরাজ-ছবি পরিবারের যেমন অনেক মিত্র ও বন্ধু ছিল, তেমনি শত্রুর সংখ্যাও কম ছিল না।
এক ভোরে জামালপুর শহর যখন জেগে উঠল মৃদুমন্দ বাতাসের দোলায়, পরপরই হাওয়ায় হাওয়ায় রাষ্ট্র হয়ে গেল মিরাজ খুন হয়েছেন। ঐটুকু শহরে মানুষের স্বাভাবিক মৃত্যুই এক ঘটনা, আর এটা তো খুন। যে সে খুন নয়, পাটব্যবসায়ী মিরাজকে খুন। তাঁকে শুধু খুনই করা হয়নি। পুরো দেহ নগ্ন করা হয়েছে। লাশটা ঝুলিয়ে দেয়া হয়েছে তাঁরই আড়তের দরজায়।
খবর পেয়ে হাউমাউ মাতম করতে করতে ছুটে এলেন তাঁরই ছোট ভাই ছবি। এলেন তাঁদের পুরো পরিবার আত্মীয়-স্বজন সব। জমে উঠল ভিড়।
এলো আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী লোকজন।
মুহূর্তে মাথা উঁচু রেখে শিরদাঁড়া সিধা করে উঠে দাঁড়ালেন ছবি। ভাইয়ের লাশ কাউকে ছুঁতে দিলেন না। দরজায় ঝুলানো অবস্থা থেকে নামাতেও দিলেন না।
ছবির ক্রোধ উন্মত্ত হচ্ছে। রাগে ফুঁসছেন তিনি। অপরাধী কারা, তিনি নিজে খুঁজে বের করবেন। নিজ হাতে তাদেরকে শাস্তি দিবেন হত্যা করে। তারপর হবে তাঁর ভাইয়ের সৎকার।
ভিড় সরিয়ে দিলেন। হটিয়ে দিলেন সবাইকে।
সারা শহরে ঘোষণা করলেন কার্ফ্যু। নিহত ভাইয়ের জন্য শহরময় আরেক ভাইয়ের মাতম। হাতে তাঁর অস্ত্র। কেউ বলে রাম দা, কেউ বলে বল্লম, কেউ বলে দুই হাতেই দুই অস্ত্র।
শহর জুড়ে তাঁর আহাজারি। তাঁর হুংকার। ছুটছেন এমাথা ঐমাথা। উন্মত্ততা থামে না।
শহরবাসী আতংকে যার যার ঘরে। রাস্তা শূন্য। দোকানপাট বাজার হাট সব বন্ধ। শুধুই এক হায়েনার গর্জন।
এরই এক ফাঁকে মূল সড়কের পাশে যাদের বাসা তারা জানালার ফোঁকর দিয়ে দেখতে পেল: সড়ক আগলে বুক চিতিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন ছবি গুন্ডা। ধারালো অস্ত্র ধরা হাতদুটি তুলে প্রস্তুত। এখনই যেন হামলে পড়বেন। ঠিক তাঁর সামনেই থমকে দাঁড়িয়েছে রক্ষীবাহিনীর একটি গাড়ি। তাদের হাতেও আগ্নেয়াস্ত্র। ছবি গুন্ডার দিকেই তাক করা।
মুহূর্ত মাত্র। ঠা ঠা শব্দে কেঁপে উঠল চরাচর সড়ক ঘরবাড়ি।
আর এদিকে ছবির হাত থেকে খসে পড়ছে অস্ত্র। তাঁর পুরো শরীর যেন আড়মোড়া ভাঙতে ভাঙতে গড়িয়ে পড়ছে। ধূলোয় লুটিয়ে পড়ছেন ছবি। ছবির মতোই।★
লেখক : কথাসাত্যিক ও কলামিষ্ট
( আপন দেশ ডটকমের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের আপন কথার মিল নাও থাকতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির আইনগত, মতামত বা বিশ্লেষণের দায়ভার সম্পূর্ণরূপে লেখকের। লেখকের নিজস্ব মতামতের কোনো প্রকার দায়ভার আপন দেশ ডটকম নিবে না।)
মন্তব্য করুন # খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, আপন দেশ ডটকম- এর দায়ভার নেবে না।