Apan Desh | আপন দেশ

হাওয়া ভবন টু গণভবন, ‘নাচের পুতুল’ জাপা

আফজাল বারী

প্রকাশিত: ০১:২৩, ২৩ আগস্ট ২০২৩

আপডেট: ০২:০৭, ২৩ আগস্ট ২০২৩

হাওয়া ভবন টু গণভবন, ‘নাচের পুতুল’ জাপা

ছবি: আপন দেশ

বরাবরই ক্ষমতাসীনদের ‘নাচের পুতুল’ হিসেবে পরিচিত জাতীয় পার্টি। সে পার্টির শীর্ষ নেতা বেগম রওশন এরশাদ। চলতি সংসদের সদস্য। এক সময়ের ফাস্ট লেডি। রাজনীতিতে ডিগবাজির স্বভাবটা তার যেন দু’আনা সূত্রে প্রাপ্ত। ঝোপ বুঝে কোপ দেয়ার নজির তিনি। সব সময় পাওয়ারের দিকে হেলেন। ঘনঘন যাতায়াত তার হাওয়া ভবন টু গণভবন।

জীবদ্দশায় স্বামী এইচ এম এরশাদকে যেভাবে ল্যাং মেরেছিলেন ১৬ বছর পর একই কায়দায় ল্যাং মারলেন দেবর জিএম কাদেরকেও। রাজনীতির মাঠে ফাষ্ট লেডি রওশন এরশাদ এখন ‘হাসির খোরাক’। তাকে নিয়ে ফায়দা লোটার সাজানো-পাতানো আয়োজন হয়ে আসছে দেড়যুগ ধরেই। তবে এবারের স্ক্রিপটা দুর্বল হয়েছে, পাকার আগেই ভাঙ্গা হয়েছে কাঠাল-এমন মন্তব্য সমালোচকদের। জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জি এম কাদের যখন ভারত সফরে রয়েছেন, সে সময় রওশন এরশাদ নিজেকে জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান ঘোষণা করায় দলে ভাঙনের আশঙ্কা করছেন দলের নেতারা।

জাতীয় নির্বাচন ঘনিয়ে এলে আলোচনায় শীর্ষে চলে আসে জাতীয় পার্টি। প্রায় সময়ই খবরের শিরোনাম হয় ক্ষমতাসীন সরকারের আশীর্বাদপুষ্ট এই দলটি। এরশাদের জীবদ্দশায় তখণ থেকেই। এবার তার ব্যাতিক্রম নয়। ২০১৯ সালের এরশাদের মৃত্যুর পর জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান পদ নিয়ে কয়েকদফা টানাটানি হয় দেবর জিএম কাদের ও ভাবি রওশন এরশাদের মধ্যে। অদৃশ্য খন্ড হয় দলটি। তৈরী হয় দেবর-ভাবীর দুই বলয়। জি এম কাদের নির্বাচিত হন দলের চেয়ারম্যান। এখনো দলের নিয়ন্ত্রণ পুরোপুরি জি এম কাদেরের হাতেই।

ইতোমধ্যে এইচ এম এরশাদের তালাকপ্রাপ্তা স্ত্রী বিদিশা সিদ্দিক পৃথক জাতীয় পার্টি গঠন করেন। গত বছরের ৩১ আগস্ট জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জিএম কাদেরকে না জানিয়েই দলের প্রধান পৃষ্ঠপোষক বেগম রওশন এরশাদ স্বাক্ষরিত এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে নতুন কাউন্সিলের আহ্বান করা হয়। এ কাউন্সিল ২৬ নভেম্বর ২০২২ তারিখ নির্ধারণ করা হয়। অন্যদিকে জাপার সংসদীয় দল বৈঠক জিএম কাদেরের সভাপতিত্বে বৈঠকে সিদ্ধান্ত নেয়া হয় জাতীয় সংসদের বিরোধী দলের নেতার পদ থেকে রওশন এরশাদকে সরিয়ে জিএম কাদেরকে বিরোধী দলের নেতা করার। ওই বছরের ১ সেপ্টেম্বর জাতীয় পার্টির সংসদীয় দলের চেয়ারম্যান জিএম কাদেরকে সংসদে বিরোধীদলীয় নেতা নির্বাচন করার জন্য স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরীকে চিঠি দিয়েছে। কিন্তু সে আবেদন কার্যকর হয়নি।

                                                         আরও পড়ুন <<>> জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব নিলেন রওশন এরশাদ

মাঝখানে সরকার বিরোধী বক্তব্য দেয়ার কারণ জিএম কাদেরের চেয়ারম্যান পদ অবৈধ দাবি করে আদালতে মামলা দায়ের করা হয়। ওই মামলায় জিএম কাদেরকে কিছুদিন দলের ‘চেয়ারম্যান পদ’ দায়িত্ব পালনের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে আদালত। এ নিয়ে বিরোধের মধ্যেই জিএম কাদের, রওশন এরশাদ ও সাদ এরশাদ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাত করেন। অতপর বিরোধ মিটে যায়।

জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জি এম কাদের যখন ভারত সফরে রয়েছেন, সে সময় রওশন এরশাদ নিজেকে জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান ঘোষণা করায় দলে ভাঙনের আশঙ্কা করছেন দলের নেতারা। যদিও জাতীয় পার্টির মহাসচিব মুজিবুর রহমান চুন্নুসহ নেতাদের অনেকেই বলেছেন, তারা রওশন এরশাদের এ ঘোষণার ব্যাপারে কিছুই জানেন না। দলের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে এই দুই শীর্ষ নেতার বিরোধ চলছে অনেক দিন ধরেই। নির্বাচন যত এগিয়ে আসছে, জাতীয় পার্টিতে দুই শীর্ষ নেতার বিরোধ তত বাড়ছে। আওয়ামী লীগ সরকারের সঙ্গে রওশন এরশাদের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক নিয়ে জাতীয় পার্টির ভেতরে নানা আলোচনা রয়েছে। আর জি এম কাদের বেশ কিছুদিন ধরে সরকারের সমালোচনা করে বক্তব্য দিয়ে আসছেন।

নিজেকে নিজেই ঘোষণা দিলেন রওশন

গতকাল গণমাধ্যমে পাঠানো রওশন এরশাদের সই করা বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, ‘আমি বেগম রওশন এরশাদ, এমপি জাতীয় পার্টির প্রতিষ্ঠাতা কো-চেয়ারম্যান এই মর্মে ঘোষণা করছি যে পার্টির সিনিয়র নেতাদের পরামর্শে ও সিদ্ধান্তক্রমে দলের গতিশীলতা বজায় রাখার স্বার্থে দলের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব গ্রহণ করলাম।’ এই বিজ্ঞপ্তিতে তিনি দলের প্রতিষ্ঠাতা কো-চেয়ারম্যান ও জাতীয় সংসদের বিরোধীদলীয় নেতা হিসেবে সই করেছেন।

রওশন এরশাদ লিখেছেন, পার্টির নেতাদের পরামর্শে ও সিদ্ধান্তের ভিত্তিতে তিনি চেয়ারম্যানের দায়িত্ব নিয়েছেন। কিন্তু জাতীয় পার্টির মহাসচিব মো. মুজিবুল হক (চুন্নু) বলেন, ‘এ বিষয়ে আমি কিছুই জানি না। আর এভাবে পার্টির চেয়ারম্যানের দায়িত্ব নেয়ার কোনো সুযোগ নেই।

রওশন এরশাদের পক্ষে দাবি করা হয়, মেয়াদোত্তীর্ণ কমিটি, নানা ধরনের মামলা-মোকদ্দমা এবং দল পরিচালনায় অযোগ্যতা ও অসাংগঠনিক আচরণের কারণে জাতীয় পার্টির বর্তমান চেয়ারম্যান জিএম কাদেরকে চেয়ারম্যান পদ থেকেও তারা অব্যাহতি দিয়েছেন। দাবি করা হয়, ২০২২ সালের ৭ ডিসেম্বর জাতীয় পার্টির ৪ জন কো-চেয়ারম্যান ও ২ জন প্রেসিডিয়াম সদস্য এক সভায় অংশ নেন। সেখানে দলের কো-চেয়ারম্যান এবিএম রুহুল আমিন হাওলাদার, অ্যাডভোকেট কাজী ফিরোজ রশীদ, সৈয়দ আবু হোসেন বাবলা, অ্যাডভোকেট সালমা ইসলাম, প্রেসিডিয়াম সদস্য শফিকুল ইসলাম সেন্টু ও নাসরিন জাহান উপস্থিত ছিলেন।

তবে পার্টির চেয়ারম্যান হিসেবে রওশন এরশাদ এর দায়িত্ব গ্রহণ প্রসঙ্গে সৈয়দ আবু হোসেন বাবলা বিবৃতি দিয়ে প্রতিবাদ করেছেন। তিনি বলেছেন, তিনি এ বিষয়ে কিছুই জানেন না এবং সংবাদে তার নামটি প্রস্তাবকারী হিসেবে ব্যবহার করার তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়েছেন। তিনি ওই সংবাদটিকে ভূয়া ও অসত্য বলে যিনি এই সংবাদটি গণমাধ্যমে পাঠিয়েছেন তার দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবী করেছেন। বিবৃতিতে তিনি বলেন, জি এম কাদের এমপি জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হিসেবে বহাল আছেন। আমরা তার নেতৃত্বে ঐক্যবদ্ধ আছি।

রওশন এরশাদের দলের চেয়ারম্যান ঘোষণা প্রসঙ্গে জাতীয় পার্টির কো-চেয়ারম্যান কাজী ফিরোজ রশিদ বলেন, তাদের দলে বিভক্তি আনার জন্য কোনো মহল এ ধরনের তৎপরতা চালাচ্ছে। বাস্তবতা হলো রওশন এরশাদ বর্তমানে জাতীয় পার্টির প্রধান পৃষ্ঠপোষক কো চেয়ারম্যান নন।

১৬ বছর আগের রওশন কী বলেছিলেন?

ঢাকার রাজপথ তখন উত্তাল। ১/১১। প্রেসিডেন্ট ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদ ২০০৭ সালের ২২ জানুয়ারি নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করেছেন। ২০০৬ সালের নভেম্বরের একদিন জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান এইচ এম এরশাদ ‘খালেদা জিয়ার পাতানো নির্বাচনে’ অংশ নেবেন না ঘোষণা দেয়ার লক্ষ্যে বারীধারার প্রেসিডেন্ট পার্কে সংবাদ সম্মেলন ডেকেছেন। সাংবাদিকদের ভীড়। আছে বিভিন্ন সংস্থার সদস্যরাও। এরশাদের দেখা নেই। খবর এলো বেগম রওশন এরশাদ তার গুলশানের বাসায় সংবাদ সম্মেলন করছেন। যথাযথ রওশন এরশাদের বাসায় সাংবাদিকরা। রওশনের বক্তব্য আরম্ভ। রওশন এরশাদ নিজেকে জাতীয় পার্টির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান এবং গোলাম মসিহকে মহাসচিব ঘোষণা দিলেন। একই সঙ্গে এইচ এম এরশাদকে চেয়ারম্যান পদ থেকে এবং এবিএম রুহুল আমিন হাওলাদারকে মহাসচিব পদ থেকে অব্যাহতি দেন।

তিনি অভিযোগ করেন, ‘এরশাদ জাতীয় পার্টিকে আওয়ামী লীগের বি-টীম করে ফেলেছেন’। স্বামী এরশাদকে ল্যাং মারার ওই সময় বনানীর ‘হাওয়া ভবন’ এ রওশন এরশাদের ঘনঘন যাতায়াত ছিল। বেগম খালেদা জিয়ার অনুগত হিসেবে নিজেকে জাহির করতে রওশন এরশাদ নানান কর্মকাণ্ড করেছেন। সেই ২০০৬ সাল থেকে ১৬ বছর পর স্বামী এরশাদের মতোই দেবর জিএম কাদেরকে চেয়ারম্যান পদ থেকে সরিয়ে গতকাল মঙ্গলবার  নিজেকে জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান ঘোষণা করলেন রওশন এরশাদ। এবারও তার পাশে সেই গোলাম মসিহ। তবে এবার সংবাদ সম্মেলন নয় গণমাধ্যমে বিবৃতি পাঠিয়ে নিজেকে দলের চেয়ারম্যান ঘোষণা করলেন।

জাতীয় পার্টির কয়েকজন নেতার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, দীর্ঘ সোয়া বছর বিদেশে চিকিৎসা নেয়া রওশন এরশাদ এখনো অসুস্থ। স্বামী এরশাদের মৃত্যু, নানা রোগ ও বয়সের কারণে তিনি কার্যত স্বাভাবিক ভাবে চলাফেরা করতে পারেন না। এরমধ্যে ১৯ আগষ্ট তিনি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে গণভবনে সাক্ষাৎ করেছেন। তিনি আগের মতোই ঘোষণা দিয়েছেন বরাবরের মতো এবারও জাতীয় নির্বাচনে আওয়ামী লীগের অনুগত হয়ে প্রার্থী দেবেন। রওশন নিজেও ঘোষণা দিয়েছেন সংবিধান অনুযায়ী নির্বাচনে তিনি অংশ গ্রহণ করবেন। তবে দলের চেয়ারম্যান হিসেবে দল পরিচালনার মতো শারীরিক অবস্থা তার নেই। কিন্তু গোলাম মসিহসহ কয়েকজন বহিস্কৃত ও পরিত্যাক্ত নেতা অসুস্থ রওশনকে ব্যবহার করছেন।

জাপার নেতারা আরও বলেন, তারা আগামী নির্বাচনে আওয়ামী লীগের সঙ্গে আসন ভাগাভাগির লক্ষ্যে জিএম কাদেরকে চেয়ারম্যান পদ থেকে বাদ দিয়ে রওশন এরশাদকে চেয়ারম্যান ঘোষণা করেছেন। যা জাতীয় পার্টির গঠনতন্ত্রের মধ্যে নেই। অন্যদিকে জাতীয় পার্টির সিনিয়র নেতাদের বেশির ভাগই সুবিধাবাদি চরিত্র। তাদের মধ্যে দলীয় আদর্শ নীতি নৈতিকতার বালাই নেই। তারা মূলত পদ আর ক্ষমতার মধুলোভী রাজনীতি করেন। তারা এখন জিএম কাদেরের পক্ষ্যে রয়েছেন ঘোষণা করলে তাদের চরিত্রই হচ্ছে হাওয়া দেখে পক্ষ বদল করা।

আপন দেশ/এবি

মন্তব্য করুন ।। খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত,আপন দেশ ডটকম- এর দায়ভার নেবে না।

শেয়ার করুনঃ

সর্বশেষ

জনপ্রিয়