
বিএনপি ও জামায়াতের লোগো।
আবারও আলোচনায় এসেছে বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীর সম্পর্ক। দীর্ঘদিনের দূরত্বের পর সম্প্রতি লন্ডনে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া ও ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সঙ্গে জামায়াত আমীর ডা. শফিকুর রহমানের বৈঠক নতুন করে জোট গঠনের সম্ভাবনা জোরালো হচ্ছে। অবশ্য রাজনৈতিক জোট গঠনের সম্ভাবনাকে একপাক্ষিক সিদ্ধান্ত হিসেবে না দেখে বিশ্লেষকরা এটিকে সময়োপযোগী কৌশল হিসেবে দেখছেন।
যুক্তরাষ্ট্রের কূটনীতিকদের সঙ্গে জামায়াত আমীরের সাম্প্রতিক বৈঠকেও উঠে এসেছে জোট গঠনের সম্ভাবনার ইঙ্গিত। শফিকুর রহমান বলেন, তারা একটি “গণতান্ত্রিক শক্তি” হিসেবে বাংলাদেশের রাজনীতিতে অবদান রাখতে চায়। এর মাধ্যমে জামায়াত নিজেদের ভাবমূর্তি শোধরানোর চেষ্টা করছে। যাতে তারা ভবিষ্যতে বিএনপির সঙ্গে আবারও মিলে চলতে পারে।
অন্যদিকে বিএনপিও বুঝে গেছে এককভাবে সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করা কঠিন। অতীতে যেমন ২০০১ সালে জামায়াতের সমর্থন নিয়ে সরকার গঠন করতে পেরেছিল। তেমনি এবারও বিরোধী আন্দোলনে জামায়াতকে পাশে পাওয়া কৌশলগতভাবে লাভজনক হতে পারে।
বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামী—দুই দল দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক মিত্র। কিন্তু আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর জুলাইয়ের অভ্যুত্থান ঘিরে এ সম্পর্ক চরম টানাপোড়েনের মধ্যে পড়ে। একে অপরকে লক্ষ্য করে চলতে থাকে আক্রমণাত্মক বক্তব্য। ছাত্র সংগঠনগুলোর মধ্যে শুরু হয় বিতর্ক।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা তখনই ধারণা করেছিলেন—এ দুই দলের পথ এবার আলাদা হয়ে গেছে।
বিএনপি তখন দ্রুত নির্বাচনের দাবিতে সোচ্চার। অন্যদিকে জামায়াত চাইছিল অন্তর্বর্তী সরকারকে সময় দিতে। সংস্কার ইস্যুতে জামায়াত ছিল আগ্রহী। বিএনপি ছিল গা-ছাড়া। সম্পর্কের টানাপোড়েন এতটাই চরমে পৌঁছায় যে, একে অনেকে ‘ইতিহাসের সবচেয়ে বাজে সময়’ বলেও মন্তব্য করেন। তবে এখন পরিস্থিতি আবার বদলাচ্ছে। মিলনের ইঙ্গিত দেখা যাচ্ছে।
সম্প্রতি জামায়াতের আমীর ডা. শফিকুর রহমান যুক্তরাজ্যে গিয়ে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানের সঙ্গে দেখা করেছেন। তার সঙ্গে ছিলেন জামায়াতের নায়েবে আমীর সৈয়দ আবদুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের।
জানা গেছে, শফিকুর রহমান বেলজিয়াম হয়ে যুক্তরাজ্যে যান। সেখানে গত রোববার তিনি খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। বিএনপি নেতারা এটিকে সৌজন্য সাক্ষাৎ বলে উল্লেখ করছেন। তাদের ভাষায়, অসুস্থ খালেদা জিয়াকে দেখতে গিয়েছিলেন জামায়াত নেতারা।
জামায়াত আমীর ডা. শফিকুর রহমান খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন—এটা নিয়ে প্রথমে বলা হচ্ছিল, এটি নিছকই একজন দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক সহকর্মীর খোঁজখবর নেয়া। শফিকুর রহমান নিজেও বলছেন, এটি ছিল ‘নৈতিক দায়িত্ব’ পালন।
কিন্তু তার দলের মুখপাত্র মতিউর রহমান আকন্দ ভিন্ন ইঙ্গিত দিচ্ছেন। তিনি বলেন, এ বৈঠকের মধ্য দিয়ে আগামীতে দুই দলের সম্পর্ক আরো দৃঢ় হবে।
এ কথার প্রতিধ্বনি পাওয়া গেছে ঢাকায় অনুষ্ঠিত এক আন্তর্জাতিক বৈঠকেও।
গত বুধবার ঢাকায় যুক্তরাষ্ট্রের দুই ডেপুটি আন্ডার সেক্রেটারি নিকোল চুলিক ও এন্ড্রু হেরাপের সঙ্গে বৈঠকের পর জামায়াত আমীর বলেন—তারা আগামী রমজানের আগেই, অর্থাৎ ২০২৬ সালের ফেব্রুয়ারির মধ্যেই সংসদ নির্বাচন চান।
এ বক্তব্যের তাৎপর্য আরও বাড়ে। কারণ একই দিনে বিএনপিও প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে দেখা করে তাদের আগের দাবির পুনরাবৃত্তি করে—ডিসেম্বরের মধ্যেই নির্বাচন করতে হবে। ইউনূস যখন বলেন, ডিসেম্বর থেকে জুনের মধ্যে নির্বাচন হওয়া উচিত তখন তাতে বিএনপি অসন্তোষ প্রকাশ করে। নির্বাচন যদি বিলম্বিত হয়, তাহলে দেশে নতুন সংকট তৈরি হবে—এ আশঙ্কা থেকেই দুই দলই সরকারকে বারবার সতর্ক করছে।
বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন যদি না হয়, তাহলে দেশে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক পরিস্থিতি আরও খারাপ হবে। তখন সেটা নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন হয়ে যাবে।
জামায়াত আমিরও বলেন, জুন পর্যন্ত অপেক্ষা করলে বর্ষা চলে আসবে। ঝড়-বৃষ্টি, প্রাকৃতিক দুর্যোগ শুরু হলে নির্বাচন আবার অনিশ্চিত হয়ে পড়বে।
তবে খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানের সঙ্গে শফিকুর রহমানের বৈঠকে আসলে কী কথা হয়েছে, তা প্রকাশ্যে জানা যায়নি। তবে এটুকু নিশ্চিত যে, বিএনপির ভেতরে এখনো চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত আসে খালেদা জিয়া কিংবা তারেক রহমানের দিক থেকেই।
এ সাক্ষাৎকে কেন্দ্র করে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন—বিএনপি ও জামায়াতের দূরত্ব কিছুটা হলেও কমেছে। সম্পর্কের পুরনো জট কাটিয়ে আবার নতুন সমন্বয় তৈরি হচ্ছে কি না, সেটিই এখন দেখার বিষয়।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন, তাদের মধ্যে দূরত্ব কমার ইঙ্গিত স্পষ্ট হলেও পুরোপুরি নিশ্চিত হতে কিছুটা সময় লাগবে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও লেখক মহিউদ্দিন আহমদ বলেন, এটা তাদের মধ্যে মত পার্থক্য কমিয়ে আনার একটা চেষ্টা হতে পারে। দেখতে হবে কয়েকদিন পরে তারা পরস্পরের প্রতি বিষোদগার করছে কি না। যদি বিষোদগার কমে আসে, তাহলে বুঝতে হবে এ সাক্ষাৎ ও বৈঠক একটা ভূমিকা রেখেছে।
২০২৪ সালের জুলাইয়ে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট বদলে যায়। বিএনপি-জামায়াতের মধ্যে তখন তীব্র মতভেদ দেখা দিলেও আদর্শিক অবস্থান ও ইতিহাসের টানাপোড়েন তাদের মধ্যে নৈকট্যের মাটি সবসময়ই শক্ত ছিল।
আপন দেশ/এমবি
মন্তব্য করুন ।। খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত,আপন দেশ ডটকম- এর দায়ভার নেবে না।