খ্যাতনামা ফুটবলার। বাহ্যিক গঠনও দৃষ্টি নন্দন। চলনে, বচন-খোলা চোখে ক্লিন ইমেজের মানুষ। তিনি আমিনুল হক। জন্ম স্থান ভোলায়। রাজনীতির মাঠে আসার পর তার ভেতর-বাইরের রূপের ফারাক বিস্তর।
যুগ যুগ রাজপথে থেকেও অনেকের ভাগ্যে নির্বাহী কমিটির সদস্যপদ জোটাভার। ভাগ্যবান আমিনুল হক খেলা ছেড়ে সোজা বিএনপির নির্বাহী কমিটির ক্রীড়া সম্পাদক। এরপর ঢাকা মহানগর বিএনপির (উত্তর) সেকেন্ডম্যানের দায়িত্ব পেয়েছেন। সাবেক মেয়র মির্জা আব্বাস-সাদেক হোসেন খোকার মতো স্টিয়ারিং এসেছে হাইব্রীড নেতা আমিনুলের হাতে। তিনি উত্তরের অধিকর্তা। শুধু নবীনই নয়, প্রবীণদের রাজনীতির ভাগ্য লেখেন ‘হাইব্রীড’ আমিনুল হক।
তারা ক্ষমতার উৎস সম্পর্কে সূত্রগুলো বলছে, মুলত হওয়া ভবনের বিতর্কিত ব্যাক্তি কারাগারে আটক ভোলার গিয়াস উদ্দিন আল মামুনের দক্ষিণ হস্ত আমিনুল হক। তার সাফায়াতেই গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে আমিনুল হক। আর এই আমিনুলের মাধ্যমে গিয়াস উদ্দিন আল মামুন হাইকমান্ডের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করেন।
দুরদৃষ্টি সম্পন্ন আমিনুলের আইডল পাকিস্তানের ইমরান খান। বিভিন্ন মহলে তিনি এমনটি বলেছেনও। তার বক্তব্য অনুযায়ী আমিনুল যেতে চান অনেক দুর। এজন্য তৃণমুল থেকে পুরো দলকে নিজের নিয়ন্ত্রণে নেয়ার মিশনে নেমেছেন। আমিনুল হকের রাজনৈতিক কৌশলে বেশ অতিচাতুর্যতাপূর্ণ। ঢাকা মহানগর উত্তরের দায়িত্ব পাবার পর দলীয় নেতাকর্মীকে ফুটবলের মতো ব্যবহার করছেন। বশ্যতা স্বীকার করা হাইব্রীড নেতাদের নিচ্ছেন কাছে আর ত্যাগীদের ঠেলে দিচ্ছেন মাঠের বাইরে।
ক্লিন ইমেজের নেতা আমিনুলেল বিরুদ্ধে উঠেছে দলের ৮৩ লাখ টাকা তছরুপের অভিযোগ। সিলেটের বন্যায় ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য সংগ্রহ করা অনুদানের টাকা করেছেন পকেটস্থ। আমিনুলের ডানহাতখ্যাত আতাউর রহমান। তিনি সহায়তা করেছেন কোটিকোটি টাকা কালেকশানে। পদ ছিল কোষাধ্যক্ষের। দলীয় কাউন্সিলরের মনোয়নপত্র বিক্রি করেছেন ৩৩ লাখ টাকার। পরে আতাউরের বদলে আক্তার নামের জাপা থেকে বিএনপিতে আসা ও বর্তমানে বিএনপির যুগ্ম সম্পাদককে এ দায়িত্ব দিয়েছেন। তবে আতাউরের সঙ্গে সম্পর্কের কিঞ্চিত ঘাটতিও হয়নি।
এক সময় সাইকেলের করে মদ-মাদক বিক্রেতা আতাউর রহমান পরিচালনা করতে ‘হোটেল ৮১’ নামে আবাসিক গেস্ট হাউস। অসংখ্যবার পুলিশি অভিযানে খদ্দেরসহ যৌনকর্মীকে আটক করেছে পুলিশ। ঝালেমা এড়াতে বসুন্ধরায় আতাউর রহমানের ফ্ল্যাটের চলে অনুরূপ আসর। সেখানকার অতিথি আমিনুল হকসহ তার সঙ্গীয়রা। ওই ফ্ল্যাটেই নেতার উত্থান-পতন নির্ধারণ করা হয়।
আমিনুলের নিয়ন্ত্রণ চিত্র:
ছাত্রদলের কমিটি গঠনের সময় প্রতিবারই হাইকমান্ড সাবেক ছাত্রনেতাদের মতামত নিয়ে থাকেন। কমিটি গঠনের ক্ষেত্রে সাবেক ছাত্রদল নেতা আমানউল্লাহ আমান, রুহুল কবীর রিজভী, হাবিব- উন-নবী খান সোহেল, সুলতান সালাউদ্দিন টুকু, আবদুল কাদের ভূঁইয়া জুয়েল, হাবিবুর রশীদ হাবিব, বজলুল করিম চৌধুরী আবেদ, রাজীব আহসান, আকরামুল হাসানসহ আরো কয়েকজন ভূমিকা রাখতেন। তাদের পছন্দের ব্যক্তিরা কমিটিতে স্থানও পেতেন। কিন্তু এবার হয়েছে ব্যাতিক্রম। কমিটি গঠনের ক্ষেত্রে প্রাধান্য পেয়েছে আমিনুলের পরামর্শ।
তথ্যমতে, ছাত্রদলের কেন্দ্রিয় কমিটিতে নিজের অনুসারীদের পদ দেয়ার মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখেননি আমিনুল। আন্দোলনে কেন্দ্র ঢাকার গুরুত্বপূর্ন ৮টি কমিটিতে শীর্ষ ১৬টি পদের মধ্যে ১১টি পদে বরিশাল অঞ্চলের নেতাদের স্থান করে দিয়েছেন অত্যন্ত চাতুরতার সঙ্গে।
গত ১০ মে ঘোষিত গুরুত্বপূর্ণ ৮টি ইউনিটের মধ্যে ঢাকা মহানগর উত্তরের সভাপতি মেহেদী হাসান রুবেল ও সাধারণ সম্পাদক রাসেল বাবু, ঢাকা মহানগর পশ্চিমের সভাপতি আবুল কালাম আজাদ নাসির ও সাধারণ সম্পাদক জুয়েল হাসান রাজ, ঢাকা কলেজ শাখার সাধারণ সম্পাদক জুলহাস মৃধা, তেজগাঁও কলেজ শাখার সাধারণ সম্পাদক বেলাল হোসেন, কবি নজরুল সরকারি কলেজ শাখার সভাপতি সাইদুর রহমান সাইদ ও সাধারণ সম্পাদক কাউসার হোসেন, সরকারি বাঙলা কলেজ শাখার সভাপতি ইব্রাহিম হোসেন বিপ্লব ও সাধারণ সম্পাদক বেলাল হোসেন সোহাগ ও সরকারি তিতুমীর কলেজ শাখার সভাপতি আরিফুর রহমান এমদাদের বাড়ী বৃহত্তর বরিশাল অঞ্চলে।
অনুসারীদের শুধু শীর্ষ পদ পাইয়ে দিয়েই সন্তষ্ট থাকেননি সাবেক এই ফুটবলার। অন্যপদ গুলোতেও বরিশাল অঞ্চলের নিজের অনুসারীদের স্থান পাইয়ে দিয়েছেন বেশ নগ্নভাবে। এরমধ্যে সরকারী বাঙলা বাংলাজের ১৩ জনের কমিটির ১০ জন বরিশাল অঞ্চলের। তেজগাও কলেজের ১৩ জনের মধ্যে ৭ জন, ঢাকা কলেজের কমিটিতে সাধারন সম্পদক সহ ৫ জন, সরকারি তিতুমীর কলেছে ৬ জন বরিশালের ছাত্ররা পদ পেয়েছে। পদের তালিকায় দেখলে যে কারো মনে হতেই পারে ছাত্রদল শুধু বরিশালের ছেলেরাই করেন। নয়তো নেতৃত্ব দোয়ার যোগ্যতা আছে শুধু বরিশাল অঞ্চলের ছাত্রদের।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, একই অঞ্চলের এতজনকে পদ দেয়ায় ক্ষুব্ধ নেতাকর্মীরা এর কারণ অনুসন্ধান করতে শুরু করেছে। কারা এর নেপথ্যে কাজ করছে, এনিয়ে ক্ষমতাসীনদের সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা আতাত করেছে কিনা, আন্দোলনে এর কতটা নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে এসব বিষয় নিয়ে হচ্ছে চুলচেলা বিশ্লেষণ। তাতেই বেরিয়ে আসছে বিবাহিত, অছাত্র ও বরিশাল অঞ্চলের আধিপত্যের তথ্য।
সে অনুযায়ী, ঢাকা মহানগর পশ্চিম ছাত্রদলের সাধারণ সম্পাদক পদ পাওয়া জুয়েল হাসান রাজ প্রায় এক যুগ আগে ২০১২ সালের ১০ নভেম্বর তানিয়া আক্তারকে বিয়ে করেন। জুয়েলের বিরুদ্ধে এই অভিযোগ পাওয়ায় এবং একাধিক প্রমাণ সামনে আসায় সেই সময় নেতারা তাকে কমিটিতে রাখতে পারেনি। এবারের কমিটিতে তার নাম আসায় আগের নেতারাও বিস্মিত হয়েছেন।
এছাড়া ঢাকা মহানগর উত্তরের সিনিয়র সহ সভাপতি রাজীব বিবাহিত। আর কবি নজরুল সরকারি কলেজ শাখার সভাপতি সাইদুর রহমান সাইদ ছিলেন জামায়াত শিবিরের নেতা। এমন আরো অসংখ্য তথ্য সংগ্রহ করেছেন ক্ষুব্ধ নেতাকর্মীরা। কমিটি গঠনে অনিয়ম, আর্থিক লেনদেন, আঞ্চলিক স্বজন প্রীতি, যোগ্যদের অবমুল্যায়ন সিনিয়র জুনিয়র অসামঞ্জস্যতার অভিযোগ লিখিতভাবে দিয়ে বাঙ্লা কলেজ ছাত্রদলেরসহ সভাপতি তারিকুল ইসলাম তারেক পদত্যাগ করেছেন।
অন্যদিকে বিবাহিত, অছাত্র, অযোগ্য বরিশাল অঞ্চলের ছাত্রদের নেতৃত্বে আনায় এই অঞ্চলের নেতাকর্মীদের কাছে এখন হিরো হয়ে গেছেন আমিনুল। সাবেক তারকা ছাত্রনেতরা যা পারেনি তা করে দেখিয়েছেন আমিনুল। এজন্য অনুসারীদের কাছে তার গ্রহযোগ্যতাও বেড়েছে। তার এমন সফলতা দেখে বিএনপিসহ অন্য অঙ্গ সহযোগী সংগঠনের পদপ্রত্যাশীরাও তদবীরের জন্য ছুটছেন আমিনুলের কাছে।
আমিনুলের বিরুদ্ধে ঝাড়ু-জুতা মিছিল
আমিনুলের বসবাস রূপনগর ৯২ নম্বর ওয়ার্ডের ৫টি উইনট কমিটি বিলুপ্ত করে। মাদক ব্যবসায়ি কামালকে করেছেন ৬ নং ওয়ার্ড কমিটির সভাপতি। পুতুল নামের একজনকে ৭ নং ওয়ার্ড বিএনপির সহ-সভাপতি করেছেন যিনি মানিকগঞ্জ মৎসজীবী লীগের নেতা।
নিজাম উদ্দিন যোগ দিয়েছেন আওয়ামী লীগের স্থানীয় এমপির হাতে ফুল দিয়ে। ওই দল ত্যাগ করেননি। তাকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে রূপনগর থানার ৯২ নং ওয়ার্ড বিএনপির সাধারণ সম্পাদকের।
এদিকে আমিনুলের এহেন কর্মের প্রতিবাদ করায় ইতোমধ্যে বহিষ্কার করা হয়েছে প্রতিষ্ঠাতা লগ্নের বিএনপি নেতা ও ঢাকা মহানগর বিএনপির আহবায়ক কমিটির সদস্য আমজাদ হোসেন মোল্লাসহ অনেককে।–এমন দাবি আমজাদ মোল্লার।
এ নিয়ে মোল্লার সমর্থকরা বিক্ষোভ করেছে। ঘোষণা দিয়েছে- আমিনুলকে যেখানে পাবেন জুতাপেটা করা হবে। একই সঙ্গে পার্টির শীর্ষ নেতাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়েছে। দলীয় নেতাদের শঙ্কা- সাবেক সেনা প্রধান প্রয়াত মাহবুবুর রহমানকেও লাঞ্ছিত করতে ছাড়েনি ক্ষুব্ধরা। ফুটবলার আমিনুল হকের বেলায় তেমন ঘটনার সমুহ শঙ্কা বিরাজ করছে।
অভিযোগ সম্পর্কে যা বললেন আমিনুল হক:
আমজাদ হোসেন মোল্লাহর বহিস্কার নিয়ে তিনি বলেন, তার বিরুদ্ধে কিছু অভিযোগ এসেছিল। তদন্ত কমিটিকরা হয়। কেন্দ্রকে জানানো হয়েছে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানকে অবহিত করেই তার বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। নিজাম উদ্দিনের প্রসঙ্গে আমিনুল হকের বক্তব্য হলো- অতীতে কেকি করল আমরা তা দেখছি না। এখন ভালো মনে হয়েছে তাই সংগঠনের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে।
কমিটিতে ভোলা-বরিশালের আধিক্য প্রসঙ্গে তিনি বলেন, দুই বছর বয়স থেকে আমি ঢাকায়। ভোলা-বরিশালের কাউকে চিনিই না।
অন্যান্য প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আওয়ামী লীগের হয়ে বিভ্রান্তি ছড়ানোর জন্য কাজ করছে।
জুতা-ঝাড়ুপেটার শঙ্কায় আছেন কিনা প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এ কোনো ব্যাপার না।
আপন দেশ/এবি
মন্তব্য করুন ।। খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত,আপন দেশ ডটকম- এর দায়ভার নেবে না।