ফাইল ছবি
দীর্ঘ ১০ বছর পরে আলোতে নিবন্ধন হারানো জামায়াত। কারাগার থেকে ঘরে, ঘর থেকে মঞ্চে। সহসায় দেখা মিলবে রাজপথে। হিসাব কষে বোল পাল্টানো, মঞ্চ বদলানো সুবিধাভোগী এই সংগঠনকে নিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গনে চলছে নানান আলোচনা-সমালোচনা।
কেউ বলছেন, মার্কিন ভিসানীতির সুফল ভোগ করছে জামায়াতে ইসলাম। কারো কারো মন্তব্য- অতীতের মতোই পর্দার আড়ালে ক্ষমতাসীনদের সঙ্গে বোঝাগড়া কিছু একটা হয়েছে। কারণ বড় দুই দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যকার রাজনীতির খেলায় জামায়াতের ভূমিকা বরাবরই থাকে তুরুপের তাসের মতো।
স্বৈরাচার এরশাদ বিরোধী ৯০’র গণআন্দোলনে সর্বদলের সঙ্গে ছিল জামায়াতও। গণতন্ত্রমুক্তির পর ৯১’র নির্বাচনের মাঠে ছিল নিজ প্রতীক নিয়ে। বিএনপি নেতৃত্বাধীন সরকারে জামায়াতের আসন ছিল ১৭টি। বিএনপি ক্ষমতাসীন হওয়ার দুই বছরের মাথায় তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলন শুরু হয়। আওয়ামী লীগের সঙ্গে আন্দোলনে যোগ দেয় জামায়াত।
৯৬’র নির্বাচনে তিনশ’ আসনে প্রার্থী দিয়ে বিএনপিকে বড় ধাক্কা দেয়। সুফল পায় আওয়ামী লীগ। তবে সে সময় জামায়াত পেয়েছিল তিনটি আসন। আশাগুড়েবালি হলে ফের ২০০১ সালের নির্বাচনে বিএনপির মঞ্চে উঠে জামায়াত।
ওই নির্বাচনে পায় ১৭ আসন। জুটে মন্ত্রীত্বও। ঘটন-অঘটনের মধ্য দিয়ে ২০০৭ সালের আসে ১/১১। ২০০৮ সালে বিএনপিকে ভোটযুদ্ধে নামায় জামায়াত। পরিণতি উল্টো। দূরত্ব বাড়তে থাকে বিএনপি-জামায়াতের। পরস্পরকে দূরে ঠেলে। আড়ালে আবড়ালে, কখনো প্রকাশ্যেই বিচ্ছেদের কথা বলেছেন।
২০০৮ সালের নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর থেকেই নানামুখী চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ে জামায়াত। মানবতাবিরোধী অপারাধে জড়িতদের মধ্যে বেশিরভাগই ছিলেন জামায়াতের শীর্ষস্থানীয় নেতা। বর্তমান সরকার সেই বিচার কার্যকরের উদ্যোগ নেয়ার পর চাপ বাড়তে থাকে জামায়াতের ওপর। দলটির শীর্ষ বেশ কয়েকজন নেতার ফাঁসিও কার্যকর করা হয়। হারাতে হয় সংগঠনের নিবন্ধনও। যুদ্ধাপরাধের বিচার কার্যকরের প্রতিবাদে দেশব্যাপী সহিংস কর্মসূচি পালন করতে থাকে দলটি। এর ফলে প্রশাসনিক বাধার মুখে পড়ে ২০১৩ সালের পর থেকে স্বাভাবিক কোনো কর্মসূচি পালন করতে দেখা যায়নি।
এদিকে নিবন্ধনের পর সংগঠনটিকেই নিষিদ্ধ করার দাবি জানিয়ে আসছে আওয়ামী লীগসহ মুক্তিযুদ্ধে প্রজন্ম। তবে সেটি বিচারাধীন। আজ রোববার (১১ জুন) আইনমন্ত্রী সাফ জানিয়ে জামায়াতকে নিষিদ্ধ করবার মতো যতেষ্ঠ তথ্যাধি আছে। মামলার রায় না হওয়া পর্যন্ত সংগঠনটিকে নিষিদ্ধ করা বা দোষী বলা যাবে না। ইতোমধ্যে জামায়াতের নতুন প্রজন্ম খন্ডিত হয়ে গঠন করেছে পৃথক সংগঠন।
বিশ্লেষকদের মতে, দ্বাদশ নির্বাচন ঘিরে ভোটের বাজারে ফের পণ্যে পরিণত হয়েছে জামায়াত। নির্বাচন সামনে রেখে সংগঠনটিকে নিয়ে কৌশলে এগোচ্ছে সরকার। প্রথমত হতে পারে, নির্বাচনে অধিকসংখ্যক দলকে আনার পরিকল্পনা থেকে দলটিকে হাতে রাখা। অন্যদিকে নিয়ন্ত্রণের বাইরে গিয়ে জামায়াত যেন সহিংস পথ বেছে না নেয়, সে বিষয়টি বিবেচনা করা। প্রকাশ্যে জামায়াতকে সমাবেশ করতে দেয়া সরকারের এক ধরনের চালও হতে পারে। হতে পারে ৯৬’র মতো বিএনপি থেকে জামায়াতকে দূরে সরানোর একটি চেষ্টাও।
তাদের মতে, রাজনীতিতে জামায়াত তুরুপের তাস। তবে যাই হোক, সমাবেশের মধ্য দিয়ে প্রতীয়মান হয় যে জামায়াতের প্রতি ক্ষমতাসীন দলের মনোভাব আগের চেয়ে নমনীয় হয়েছে।
জাতীয় পার্টির (জাপা) চেয়ারম্যান ও সংসদের বিরোধীদলীয় উপনেতা জিএম কাদের সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে দাবি করেছেন, ভোট ছাড়া সংসদীয় আসন ভাগাভাগির যে ছক কষছে সরকার, তাতে জামায়াতকেও রাখা হয়েছে। নির্বাচন কমিশনের নিবন্ধন হারানোয় স্বনামে ভোটে আসার সুযোগ নেই জামায়াতের; তাই অন্য নামে তাদের সঙ্গে আসন ভাগাভাগি হতে পারে বলেও দাবি করেছেন জিএম কাদের। ক্ষমতাসীনদের পক্ষ থেকে জাপা চেয়ারম্যানের এমন বক্তব্যের কোনো প্রতিবাদ বা প্রতিক্রিয়া দেখা যায়নি এখনো।
জামায়াত নেতাদের দাবি, সরকারের সঙ্গে সমঝোতার প্রশ্নই ওঠে না। কারণ এই সরকারের আমলেই তারা সবচেয়ে বেশি অবহেলা ও নির্যাতনের শিকার হয়েছে। জাতীয় নির্বাচনের আগে সরকার নিজেদের অগণতান্ত্রিক আচরণ আড়াল করতে অন্য দলের সভা-সমাবেশে বাধা না দেয়ার কৌশল নিয়েছে বলেও মনে করেন জামায়াতের নেতারা।
এদিকে শনিবার (১০ জুন) এক অনুষ্ঠানে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছেন, জামায়াত নিবন্ধিত দল নয়। তবে তাদের মুরুব্বি বিএনপি আবারো আগুন সন্ত্রাস করার জন্য জামায়াতকে মাঠে নামিয়েছে।
এ ছাড়া ২০১৪ সালের নির্বাচনের আগে দেশজুড়ে আগুন সন্ত্রাসের ঘটনায়ও জামায়াত ও এর ছাত্রসংগঠন ইসলামী ছাত্রশিবিরকে অভিযুক্ত করে আসছে ক্ষমতাসীনরা। এরপর দলটির ওপর চাপ আরও বাড়তে থাকে। তখন থেকে মগবাজারে দলটির কেন্দ্রীয়, পুরানা পল্টনে মহানগর কার্যালয়সহ সারা দেশের দলীয় কার্যালয়গুলো অঘোষিতভাবে বন্ধ রয়েছে। পরবর্তীতে বিভিন্ন সময়ে প্রশাসনের অনুমতি ছাড়াই জামায়াত ও শিবিরকে বিভিন্ন ইস্যুতে ঝটিকা কর্মসূচি পালন করতে দেখা গেছে।
বিভিন্ন সূত্র অবশ্য বলছে, সরকারের সঙ্গে বোঝাপড়ার ভিত্তিতেই মাঠে নামার সুযোগ পেয়েছে জামায়াত। কিছুদিন আগে সরকারের কয়েকজন প্রভাবশালী নীতিনির্ধারকের সঙ্গে জামায়াতের নায়েবে আমির ডা. সৈয়দ আবদু্ল্লাহ মো. তাহেরের বৈঠক হয়েছে। যদিও সেই বৈঠকের কথা কোনো পক্ষ কখনো স্বীকার করেনি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক অধ্যাপক নূরুল আমীন ব্যাপারী বলেন, ভিসানীতি অন্যতম একটি কারণ। সরকারের সঙ্গে জামায়াতের সমঝোতার কথাও শোনা যাচ্ছে। তবে এমন কথার ভিত্তি নিয়ে আমি সন্দিহান।
জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মাওলানা আবদুল হালিম বলেন, ভিসানীতির চাপের কারণে সরকার অনুমতি দিয়েছে কিনা তা বিশ্লেষণ করবেন আপনারা। কিন্তু রাজনৈতিক দল হিসেবে সভা-সমাবেশ করার অধিকার জামায়াতের রয়েছে।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ইকবাল হাসান মাহমুদ মন্তব্য করেছিলেন, জামায়াতের সঙ্গে আওয়ামী লীগের তলে তলে পরকীয়া চলছে।
আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য কাজী জাফর উল্যাহ বলেন, আমরা চাই আগামী জাতীয় নির্বাচনে নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধিত সব রাজনৈতিক দল অংশগ্রহণ করুক। এখানে কে কোন দল, এত কিছু দেখি না। আমরা সকলের অংশগ্রহণে আগামী জাতীয় নির্বাচন চাই।
আপন দেশ/এবি
মন্তব্য করুন ।। খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত,আপন দেশ ডটকম- এর দায়ভার নেবে না।