
ফাইল ছবি
পবিত্র রমজান মাসের প্রথম ১০ দিন রহমতের, দ্বিতীয় ১০ দিন মাগফিরাত ও শেষ ১০ দিন নাজাতের জন্য মহান আল্লাহ্ নির্ধারণ করে দিয়েছেন। তবে এ মাসের শেষ ১০ দিন সবচেয়ে বেশি মর্যাদাপূর্ণ। এ সময় ইতিকাফের মাধ্যমে আল্লাহ তায়ালার সান্নিধ্যে এসে তাঁর সঙ্গে বান্দাহর নিবিড় সম্পর্ক স্থাপনের সুযোগ সৃষ্টি হয়। ইতিকাফ সম্পর্কে আল্লাহ তায়ালা সূরা বাক্বারার ১২৫ নং আয়াতে ইরশাদ করেন, আমি ইব্রাহিম ও ইসমাইলকে আদেশ করলাম তোমরা আমার গৃহকে তাওয়াফকারী, ইতিকাফকারী ও রুকু সিজদাহ্কারীদের জন্য পবিত্র রাখো।
রাসূলুল্লাহ্ (সা.) নিজে ইতিকাফ করেছেন এবং সাহাবাদেরকেও উৎসাহিত ও অনুপ্রাণিত করেছেন। তিনি বলেন, মসজিদ মুত্তাকিদের ঘর। যে ব্যক্তি ইবাদতের উদ্দেশ্যে মসজিদে অবস্থান করবে, আল্লাহ তার প্রতি শান্তি ও রহমত নাজিল করবেন এবং পুলসিরাত পার-পূর্বক বেহেশতে পৌঁছবার জিম্মাদার হবেন। হযরত আবু হুরায়রা (রা.) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, প্রতি রমজানের ১০ দিন রাসূলুল্লাহ্ (সা.) ইতিকাফ করতেন। তবে যে বছর তিনি ইন্তিকাল করেন সে বছর তিনি ২০ দিন ইতিকাফ করেন। (সহিহ বুখারি: ১৯০৩)। হযরত ইবনে উমার (রা.) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, ‘রমজানের শেষ দশকে রাসূলুল্লাহ (সা.) ইতিকাফ করতেন। (সহিহ মুসলিম: ১১৭১)।
আরবি শব্দ ‘ইতিকাফ’ এর আভিধানিক অর্থ স্থির থাকা বা অবস্থান করা, আবদ্ধ হওয়া, কোনো জিনিসকে বাধ্যতামূলকভাবে ধরে রাখা ইত্যাদি। ইসলামি শরিয়তের পরিভাষায়, আল্লাহ্ তায়ালার সন্তুষ্টির লক্ষ্যে জাগতিক কার্যকলাপ ও পরিবার পরিজন থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে সওয়াবের উদ্দেশ্যে মসজিদে বা ঘরের নির্দিষ্টস্থানে অবস্থান করা বা স্থিতিশীল থাকাকে ইতিকাফ বলে। যিনি ইতিকাফ করেন তাকে ‘মুতাকিফ’ বলে। ইতিকাফের সর্বোত্তম স্থান হলো পবিত্র মসজিদুল হারাম। এরপর মসজিদে নববি। এরপর যথাক্রমে বাইতুল মুকাদ্দাস, জুমআ আদায়ের মসজিদ ও পাড়া-মহল্লার মসজিদ।
হযরত ইবনে রজব (র.) বলেছেন, ইতিকাফের উদ্দেশ্য হলো সৃষ্টির সঙ্গে সাময়িকভাবে সম্পর্ক ছিন্ন করা এবং স্রষ্টার সাথে সম্পর্ক কায়েম করা। আল্লাহ সঙ্গে পরিচয় যত দৃঢ় হবে, সম্পর্ক ও ভালোবাসা ততো গভীর হবে এবং তা বান্দাকে পুরোপুরি আল্লাহ কাছে নিয়ে যাবে।
ইসলামি ধর্মতত্ত্ববিদদের মতে, ইতিকাফ তিন প্রকার। ১. সুন্নাত ইতিকাফ: রমজানুল মুবারকের শেষ ১০ দিন ইতিকাফ। এ ধরনের ইতিকাফকে সুন্নাতে মুয়াক্কাদাহ কিফায়াহ বলা হয়। গ্রাম-মহল্লা বা এলাকাবাসীর পক্ষে কোনো এক বা একাধিক ব্যক্তি এই ইতিকাফ করলে জনপদের সবার পক্ষ থেকে তা আদায় হয়ে যায়। তবে ওই জনপদের কেউ যদি ইতিকাফ না করে তাহলে সকলেই সুন্নাতে মুয়াক্কাদাহ বর্জনের দায়ে দায়ী হবেন। তবে আদায়ের ক্ষেত্রে যিনি বা যাঁরা আদায় করবেন, শুধু তিনি বা তাঁরাই সওয়াবের অধিকারী হবেন। ২. ওয়াজিব ইতিকাফ: মানতের ইতিকাফ ওয়াজিব। যেমন- কেউ বলল যে, আমার অমুক কাজ সমাধা হলে আমি এতোদিন ইতিকাফ করবো। যত দিন শর্ত করা হবে তত দিন ইতিকাফ করা ওয়াজিব। ওয়াজিব ইতিকাফের জন্য রোজা রাখা শর্ত। ৩. নফল ইতিকাফ: সাধারণত যেকোনো সময় ইতিকাফ করাকে নফল ইতিকাফ বলে। এর জন্য কোনো দিন কিংবা সময় নির্ধারিত নেই। অল্প সময়ের জন্যও ইতিকাফ করা যেতে পারে। এ জন্য মসজিদে প্রবেশের পূর্বে ইতিকাফের নিয়ত করে প্রবেশ করা উত্তম।
রমজানের ২০ তারিখ সূর্যাস্তের পূর্ব থেকেই ইতিকাফ শুরু করতে হবে এবং ঈদুল ফিতরের চাঁদ দেখা যাওয়া পর্যন্ত ইতিকাফ অবস্থায় থাকতে হবে। এ সময় কেউ ইতিকাফ করলে সে-ই পূর্ণাঙ্গ ইতিকাফের সওয়াব অর্জন করতে পারবে। ১০ দিনের কম যে কোনো পরিমাণ সময় ইতিকাফ করলে তা নফল ইতিকাফ হিসেবে গণ্য হবে। নফল ইতিকাফ ও অত্যন্ত ফজিলতপূর্ণ নেক আমল। তাই সম্পূর্ণ সুন্নাত ইতিকাফ পালন করতে না পারলে যতদূর সম্ভব নফল ইতিকাফ করাও গুরুত্বপূর্ণ। আত্মশুদ্ধির চর্চা ও আত্মার পবিত্রতা অর্জন করাসহ ইতিকাফ পালন করার মূল উদ্দেশ্য হলো মহান আল্লাহ সন্তুষ্টি অর্জন করা। এ ছাড়া রমজান মাসের শেষ ১০ দিন ইতিকাফ করার আরো অন্যতম বিশেষ উদ্দেশ্য হলো শবে কদর অন্বেষণ করা; রমজানের শেষ দশক ইতিকাফ করলে শবে কদর প্রাপ্তি অনেকটা নিশ্চিত হয়।
আড়ও পড়ুন>><>>>রমজান মাসে দান-সদকার গুরুত্ব অপরিসীম
ইতিকাফের ফজিলত সম্পর্কে রাসূল (সা.) বলেছেন, যে ব্যক্তি রমজানের রোজার শেষ ১০ দিন ইতিকাফ করবে, সে ব্যক্তি দু’টি হজ ও দু’টি উমরার সমপরিমাণ সওয়াব পাবে। (বুখারি ও মুসলিম) এছাড়াও হযরত ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ্ (সা.) ইরশাদ করেছেন, ইতিকাফকারী সর্বপ্রকার পাপ হতে মুক্ত থাকে এবং অন্যরা বাইরে আমল করে যে নেকি লাভ করে সে ইতিকাফে থেকে বাইরের আমলগুলো না করেও সে পরিমাণ নেকি লাভ করে। (ইবনে মাযাহ: ১৭৮১)।
ইতিকাফের কিছু শর্ত রয়েছে। যেমন, পুরুষদের ইতিকাফের ক্ষেত্রে এমন মসজিদে ইতিকাফ করতে হবে, যেখানে নামাজের জামাত হয়। জুমআর জামাত হোক বা না হোক। পক্ষান্তরে পুরুষদের মতো করে নারীদের ইতিকাফ করাও সুন্নাত। তবে মহিলাদের মসজিদের পরিবর্তে ঘরের নির্দিষ্ট স্থানে ইতিকাফ করা উত্তম। আর কারো যদি নামাজের জন্য নির্দিষ্ট স্থান না থাকে তাহলে নামাজের স্থানকে কাপড় দিয়ে ঘেরাও করে তাতে ইতিকাফের ব্যবস্থা করা যেতে পারে। এ বিষয়ে হযরত আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত একটি হাদিসে তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ্ (সা.) রমজানের শেষের দশকে ইতিকাফ করেছেন তাঁর ইন্তিকাল পর্যন্ত। এরপর তাঁর পূণ্যবতী স্ত্রীগণ ইতিকাফ করেছেন। (সহিহ মুসলিম: ২০০৬)। ইতিকাফ সম্পর্কিত আরেকটি শর্ত হচ্ছে, ইতিকাফের নিয়ত করতে হবে। মহিলারা ইতিকাফ করা অবস্থায় তাদের পিরিয়ড অথবা প্রসব পরবর্তী রক্তক্ষরণ শুরু হলে ইতিকাফ ছেড়ে দিতে হবে।
ইতিকাফ অবস্থায় দুনিয়াবি কথাবার্তা, চিন্তা-ভাবনা থেকে দূরে থাকতে হবে। প্রতিটি সময় আল্লাহর স্মরণে এবং ইবাদত-বন্দেগিতে কাটাতে হবে। এ ক্ষেত্রে দৈনন্দিন প্রাকৃতিক যে সমস্ত কাজ রয়েছে, যেমন: প্রস্রাব-পায়খানা, অজু-গোসল, ঘুম ইত্যাদি সবই করা যাবে, তবে এ সব কিছুই নিয়মের মধ্যে থেকে আদায় করলে, সে ব্যক্তি তার ইতিকাফের মধ্যে পরিগণিত হবে এবং পরিপূর্ণ ইতিকাফের সওয়াবের অধিকারী হবে। তবে ইতিকাফ অবস্থায় এমন সব কথা বলা ও কাজ করা বৈধ যাতে কোনো গুণাহ নেই। প্রয়োজনীয় সাংসারিক কথাবার্তা বলতেও নিষেধ নেই; তবে অহেতুক অযাচিত কথাবার্তা কোনোক্রমেই বলা দুরস্ত হবে না।
ইতিকাফ অবস্থায় ইতিকাফকারী ফরজ ইবাদতের বাইরে কোনো নফল ইবাদত না করলেও ইতিকাফের সওয়াব পাবেন। তবে অতিরিক্ত নফল ইবাদত করলে আরও বেশি ফজিলতের অধিকারী হবেন। যেমন- কুরআনুল কারিম তিলাওয়াত করা, বেশি বেশি নফল নামাজ আদায় করা, কাযা নামাজ আদায় করা, দুআ দরুদ পাঠ করা, জিকির-আযকার ও তাওবা-ইস্তিগফার করা। এছাড়া দীনি কথাবার্তা ও ধর্মীয় জ্ঞানচর্চা করা ও সওয়াবের কাজ। যেমন- কুরআন, হাদিস, ফিক্হ, তাফসির ইত্যাদি পাঠ করা ও তালিম করা।
রাসূলুল্লাহ্ (সা.) ইতিকাফ পালনকালে আল্লাহর স্মরণে পূর্ণ মনোনিবেশ করতেন। তিনি সারাক্ষণ মসজিদে অবস্থান করতেন। প্রাকৃতিক প্রয়োজন ছাড়া মসজিদ থেকে বের হতেন না। হযরত আয়েশা (রা.) হতে বর্ণিত এক হাদিসে তিনি বলেন, যখন তিনি ইতিকাফে থাকতেন তখন প্রয়োজন ছাড়া বাসায় আসতেন না। (সহিহ বুখারি: ২০২৯)।
ইতিকাফকারী এক নামাজের পর অন্য ওয়াক্ত নামাজের অপেক্ষায় থাকে, আর এ অপেক্ষার অনেক ফজিলত রয়েছে। রাসূলুল্লাহ্ (সা.) বলেছেন, নিশ্চয় ফেরেশতারা তোমাদের একজনের জন্য দুআ করতে থাকেন যতক্ষণ সে কথা না বলে, নামাজের স্থানে অবস্থান করে। তারা বলতে থাকে, আল্লাহ তাকে ক্ষমা করে দিন, আল্লাহ তার প্রতি দয়া করুন, যতক্ষণ তোমাদের কেউ নামাজের স্থানে থাকবে এবং নামাজ তাকে আটকে রাখবে, তার পরিবারের কাছে যেতে নামাজ ছাড়া আর কিছু বিরত রাখবে না, ফেরেশতারা তার জন্য এভাবে দুআ করতে থাকবে। (সহিহ্ মুসলিম: ৬০১১)।
পরিশেষে বলা যায় যে, আত্মার পরিশুদ্ধি অর্জন এবং আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভ করার উত্তম পন্থা হলো ইতিকাফ। মানবিক সব চিন্তা-চেতনার ঊর্ধ্বে অবস্থান করে একজন মানুষ ইতিকাফে একান্তে আল্লাহ ধ্যানে বসার সুযোগ লাভ করেন। এ একান্ত যাপন প্রক্রিয়ার প্রভাব সীমাহীন। ইতিকাফ একজন মানুষের ওপর এমনভাবে নৈতিক ও আধ্যাত্মিক প্রভাব বিস্তার করে, যা তাকে দীর্ঘদিন আল্লাহ পথে পরহেজগারির সঙ্গে পরিচালিত হতে সহযোগিতা করে। ইতিকাফের ফজিলত সম্পর্কে হযরত ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত হাদিসে তিনি বলেন, যে ব্যক্তি আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে ইতিকাফ করবে, আল্লাহ তাআলা তার এবং জাহান্নামের আগুনের মধ্যে তিনটি পরিখার দূরত্ব সৃষ্টি করবেন। প্রত্যেক পরিখার প্রশস্ততা দুই দিগন্ত তথা আসমান ও জমিনের মধ্যবর্তী দূরত্বের চেয়েও বেশি। (শুআবুল ইমান, বায়হাকি: ৩৬৭৯)।
লেখক: কবি, প্রাবন্ধিক ও সহকারী অধ্যাপক, ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগ, শেরপুর সরকারি মহিলা কলেজ, শেরপুর।
আপন দেশ/জেডআই
মন্তব্য করুন # খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, আপন দেশ ডটকম- এর দায়ভার নেবে না।