খলিলুর রহমান ভুঁইয়া ও নাজমুল আলম শাহীন
অর্থ লোপাট চলছে বাংলাদেশ ডাক বিভাগে। একের পর এক ধরা পড়ছে লোপাটের ঘটনা। কিন্তু একটিরও সঠিক তদন্ত এবং বিচার হয়নি। এতে উৎসাহিত হচ্ছে দফতরটির দুর্নীতিবাজরা।
সাধারণ মানুষের দৃষ্টি শত শত কিংবা হাজার কোটি টাকার দিকে। ফলে গুরুত্ব হারাচ্ছে কোটি কোটি টাকা লোপাটের ঘটনা। এসবের বিরুদ্ধে যাদের ব্যবস্থা নেয়ার কথা-তাদের বিরুদ্ধেই রয়েছে কখনো গাফিলতি, কখনোবা আশ্রয়-প্রশ্রয় দেয়ার অভিযোগ। ফলে অধরাই থেকে যাচ্ছে ডাক বিভাগে সরকারি অর্থ হরিলুটকারীরা। ছোট ছোট অঙ্কের এই লুণ্ঠনকে একত্রিত করলে যোগফল যা দাঁড়াবে তা মোটেও মামুলি নয়। অথচ সরকারি কর্মচারিদের অর্থ আত্মসাতের বিরুদ্ধে ব্যবস্থাগ্রহণকারী কর্তৃপক্ষ দুর্নীতি দমন কমিশনকে (দুদক) এ বিষয়ে মনযোগী হতে দেখা যায় না।
ডাক অধিদফতর থেকে প্রাপ্ত রেকর্ডপত্র অনুযায়ী, রাজধানীসহ সারাদেশের বিভিন্ন পোস্ট অফিসে মাঝে মধ্যেই নানা কৌশলে গ্রাহকের অর্থ হাতিয়ে নেয়ার ঘটনা ধরা পড়ছে। ধরা পড়ার প্রথম চেষ্টা চলে বিষয়টি চেপে যেতে। সেটি সম্ভব না হলে চলে কিছু লোক দেখানো বিভাগীয় ব্যবস্থা। অভ্যন্তরীণ তদন্ত কমিটি গঠন। দীর্ঘ সময় পর তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল। আর কথিত সেই ‘তদন্ত প্রতিবেদন’ এমনভাবে দেয়া হয় সেগুলোর ভিত্তিতে দৃষ্টান্তমূলক ও কার্যকর কোনো ব্যবস্থাই নেয়া সম্ভব হয় না। ফলে সরকারি অর্থ হরিলুট চলছেই।
ডাক কর্মকর্তা-কর্মচারিরা নিজেরাই অর্থ লোপাটে জড়িত-এই বিষয়টির স্বীকারোক্তি রয়েছে গত ৫ জুলাই দেয়া ডাক বিভাগেরই চিঠিতে।
সাব-পোস্ট অফিসের অর্থ আত্মসাতের বিষয়টি স্বীকার করে বিভিন্ন পোস্ট অফিস ও সাব পোস্ট অফিস বরাবর একটি নির্দেশনা দেয়া হয়। ‘বিষয়বস্তু’ হিসেবে উল্লেখ করা হয়, ‘ঢাকার মিরপুর সাব পোস্ট অফিসের পোস্টার জনাব নাজমুল ইসলাম শাহীনের বিরুদ্ধে ৩,৫৫,০০,০০০/= সরকারি টাকা দুর্নীতির মাধ্যমে আত্মসাতের অভিযোগের বিষয়ে তদন্ত সংক্রান্ত’।
চিঠিতে বলা হয়, তদন্ত কমিটির রিপোর্টের প্রেক্ষিতে নির্দেশক্রমে জানানো যাচ্ছে যে, ঢাকা জিপিও’র হিসাবাধীন বিভিন্ন উপ-ডাকঘর/উপজেলা হতে প্রতিদিন প্রাপ্ত ডেইলি একাউন্টে সাব অফিসে হাতে থাকা অপরিশোধিত চেকের নম্বর ও টাকার অঙ্ক বাধ্যতামূলকভাবে উল্লেখ করতে হবে।সকল উপ-ডাকঘর সমুহকে পুরোপুরি নির্দেশনা পালন করার জন্য নির্দেশনা প্রদান করতে হবে।অথরাইজড ব্যালেন্সের অতিরিক্ত ক্যাশ ব্যালান্স হাতে রাখতে হলে ইসিবি মেমো প্রদান করা আবশ্যক। ঢাকা জিপিও কর্তৃক প্রতিনিয়ত যাচাই ও এসও স্লিপে অবশ্য পালনীয় নির্দেশনা প্রদান হলেও অথরাইজড ব্যালেন্সের অতিরিক্ত ক্যাশ না রাখার বিষয়টি সুনিশ্চিতকরণের প্রশাসনিক ইউনিটের কঠোর নজরদারি ও প্রতিনিয়ত প্রয়োজনীয় নির্দেশপত্র জারি করতে হবে। এ ছাড়া বর্তমান প্রেক্ষাপটে সনাতনি অথরাইজড ব্যালেন্স বৃদ্ধি করাও আবশ্যক। উপ-ডাকঘরসমুহের বিপরীতে নিকটস্থ ব্যাংকে হিসাব খুলে উক্ত হিসাবে রেমিট্যান্সের মাধ্যমে অর্থ প্রেরণ ও সংরক্ষণ অধিকতর নিরাপদ এবং তা অবিলম্বে বাস্তবায়ন করতে হবে। হিসাব অফিস হিসেবে ঢাকা জিপিও থেকে উপ-ডাকঘরকে অতিরিক্ত ক্যাশ ব্যালেন্স হাতে রাখার ক্ষেত্রে ইসিবি মেমো প্রদানের জন্য এসও স্লিপে নির্দেশনা প্রদান করতে হবে।
ডাক বিভাগ সূত্র জানায়, এই চিঠিতে উঠে আসা বিষয়গুলো দীর্ঘদিন ধরেই ডাক বিভাগে বিরাজমান। অথচ এসবের বিষয়ে কার্যকর কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয় না। নেবেনই বা কে? অতিরিক্ত মহাপরিচালক, মহাপরিচালকরা ক্ষমতার স্বাদ নিতে কিছু দিনের জন্য চেয়ারে আসীন হন। এরই মধ্যে কেউ কেউ আখের গোছান। সরকারের সর্বোচ্চ সুবিধাধি উপভোগ করে ‘মহাপরিচালক’ তকমা লাগিয়ে চলে যান অবসরে। গ্রাহক সেবা বৃদ্ধি এবং ডাক বিভাগের সার্বিক উন্নয়নে তারা কিছুই করেন না। তাদের ‘আসা-যাওয়া’র কোনো ধরণের ‘ঝামেলা’য় জড়াতে চান না। বাড়াতে চান না নিজেদের মধ্যে শত্রুতাও। সুযোগসন্ধানী অর্থ আত্মসাৎকারীচক্র এমন নিয়ন্ত্রণহীন অবস্থার অপেক্ষায়ই ওঁৎ পেতে থাকে। মওকা বুঝে থাবা বসান সরকারের কোষাগারে। মিরপুরের সাব-পোস্টমাস্টার নাজমুল ইসলাম শাহীনেরও শেষ পর্যন্ত কিছু হবে না বলে মনে করেন বিভাগটির সংশ্লিষ্টরা। কারণ, তাকে সুরক্ষা দেয়ার জন্য রয়েছে ‘গড ফাদার’। শাহীনের বিরুদ্ধে ডাক বিভাগ এখন পর্যন্ত কোনো ফৌজদারি ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। বরং তার যেন কোনো ধরনের অসুবিধা না হয় সেটি নিশ্চিত করার জন্য উঠেপড়ে লেগেছেন কোনো কোনো কর্মকর্তা।
জানা গেছে, নাজমুল আলম শাহীনের অর্থ আত্মসাতের ঘটনা প্রথম ধামাচাপা দেয়ার চেষ্টা করা হয়। কিন্তু কম্পিউটার হ্যাকের মাধ্যমে ডাক বিভাগে জমা রাখা গ্রাহকের অর্থ গায়েব হয়ে যাওয়ার একটি ঘটনা তদন্তকালে বিষয়টি সামনে আসে। কিন্তু শাহীন অতিরিক্ত পোস্টমাস্টার জেনারেল খান হাসান মোহাম্মদ ইকবাল মাসুদের ‘স্নেহধন্য’ হওয়ায় তার গায়ে এখন পর্যন্ত এতোটুকুন আঁচড় লাগেনি।
শাহীনের অর্থ আত্মসাতের বিষয়টি পূর্বতন ঘটনাসমুহের ধারাবাহিকতা মাত্র। বছর দুই আগে ২০২১ সালে ঢাকা জিপিও থেকে ছয় কোটি টাকা ‘নাই’ হয়ে যায়। অত্যন্ত নিপূণ কৌশলে হাতিয়ে নেয়া হয় এ অর্থ। সে সময় ঢাকা জিপিও’র দায়িত্বে ছিলেন তৎকালিন অতিরিক্ত পোস্টমাস্টার খন্দকার শাহনূর সাব্বির। ভ্যালু পেয়েবল মানি অর্ডারের (ভিপিএম) মাধ্যমে সরানো হয়েছিল এই অর্থ। এ সময় পোস্টমাস্টার (ট্রেজারি) হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন আব্দুল বাতেন। ট্রেজারার ছিলেন মো. এমদাদুল হক। তারা ট্রেজারির নিয়ন্ত্রণ করতেন। ছয় কোটি টাকা আত্মসাতের ঘটনায় মামলা হয়। ওই মামলায় বেছে বেছে আসামি করা হয় খন্দকার শাহনূর সাব্বিরের রোষানলে পড়া ব্যক্তিদের। কারাগারে পাঠানো হয় এমদাদুল হককে। অথচ ঘটনার দায়-দায়িত্ব খন্দকার শাহনূর সাব্বির, ট্রেজারি পোস্ট মাস্টার আব্দুল বাতেনকে রাখা হয়েছে ধরা-ছোঁয়ার বাইরে। বর্তমানে মামলাটি তদন্ত করছে দুদক। সেখানেও মূল হোতাদের সুরক্ষায় ব্যাপক তদবির চলছে বলে জানা গেছে। এ ছাড়া পদ্ধতিগত দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে একই বিভাগ থেকে এরোলাইট জৈব সারের অনুকূলে অন্তত ৬৭টি ভিপিএম জার্নাল বহি বিধি বহির্ভুতভাবে ইস্যু করে অন্তত ৭০ লাখ টাকা হাতিয়ে নেয়ার অভিযোগটি রীতিমতো ধামাচাপা দেয়া হয়। নিরপেক্ষ কর্তৃপক্ষ দিয়ে রিকনসিলিয়েশন করলে লোপাট হওয়া অর্থের পরিমাণ কয়েকগুণ বেশি হতে পারে বলে জানান ডাক সংশ্লিষ্টরা।
এ ছাড়া উত্তরা পোস্ট অফিস, বনানী পোস্ট অফিস, গুলশান পোস্ট অফিসেও রয়েছে লাখ লাখ টাকা আত্মসাতের ঘটনা। ঢাকা জিপিওর জুনিয়ার পোস্টমাস্টার পারভেজ আনোয়ার নেতৃত্বে একটি সিন্ডিকেট জালিয়াতির মাধ্যমে অর্থ হাতিয়ে নেয়ার সঙ্গে জড়িত-মর্মে জানা গেছে। বনানীর পোস্টমাস্টার খলিলুর রহমান ভুইয়া, উত্তরার সাব পোস্টমাস্টার আব্দুল হান্নান, সেগুনবাগিচার সাব পোস্ট অফিসের মো. ইসমাইল এই সিন্ডিকেটের অন্যতম সদস্য।
চলতিবছর জুলাই মাসে পটুয়াখালির বগা সাব পোস্ট অফিসে পোস্টমাস্টার আব্দুল ওয়াহাবের বিরুদ্ধেও উঠেছে গ্রাহকের অর্থ হাতিয়ে নেয়ার অভিযোগ। গ্রাহকের টাকা পোস্ট অফিসের সাদা স্লিপে সিল সাক্ষর নিয়ে মাত্র এক বছরে আব্দুল ওয়াহাব আত্মসাৎ করেন এই অর্থ। প্রাথমিক আত্মসাৎকৃত অর্থের পরিমাণ এক কোটি টাকা বলে জানা গেছে। গভীর তদন্তে এই সংখ্যা আরও বাড়ার শঙ্কা রয়েছে। পটুয়াখালি জেলা খুলনা পোস্টমাস্টার জেনারেল সামশুল আলমের দায়িত্বে রয়েছে। আত্মসাতের ঘটনা তাই এই কর্মকর্তাও এড়াতে পারেন না।
এ প্রসঙ্গে মহাপরিচালক (চলতি দায়িত্ব) হারুন অর রশিদ এ প্রতিবেদককে বলেন, ডাক বিভাগের প্রতি সাধারণ মানুষের যে আস্থা সেটি বজায় রাখাতে আমি বদ্ধ পরিকর। আমাকে সার্বিক দেখতে হয়। সব কিছুতেই যেন সঠিকতা থাকে সেটিই আমি চাই। অনিয়ম বা দুর্নীতির বিষয়গুলো পরিদর্শক (তদন্ত) তিনি দেখছেন। অনিয়মের বিচার অবশ্যই হতে হবে।
আপন দেশ/এবি
মন্তব্য করুন # খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, আপন দেশ ডটকম- এর দায়ভার নেবে না।