ফাইল ছবি
প্রজাতন্ত্রের কর্মচারিদের ক্ষমতার অপব্যবহার, প্রতারণা এবং জাল-জালিয়াতি দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) তফসিলভুক্ত অপরাধ। অনুসন্ধানে প্রাথমিক সত্যতা প্রতীয়মানহলে এ বিষয়ে মামলা করাই সংস্থাটির কাজ।তদন্তকালে সাক্ষ্য-প্রমাণে প্রমাণিত হলে দাখিল করে চার্জশিট।দাখিলকৃত চার্জশিটের ভিত্তিতে বিশেষ আদালতের চলে অপরাধের বিচার।
দুর্নীতি দমন কমিশনের জন্য এটি স্বাভাবিক ও মৌলিক কার্যক্রম। কারণ এ ধরণের অপরাধ দমনের লক্ষ্যে দুদকের প্রতিষ্ঠা। কিন্তু লক্ষ্যনীয় বিষয় হচ্ছে যে, সাম্প্রতিক সময়ে প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তি বিশেষের ক্ষেত্রে এই মৌলিক কাজ থেকে দুদক নিজেকে নিবৃত রাখছে। নিজের দায়-দায়িত্ব ঠেলে দিচ্ছে অন্যের ঘাড়ে। এবং এমন সব প্রতিষ্ঠানের ঘাড়ে দায় ঠেলে দিচ্ছেন যেসব প্রতিষ্ঠানের কোনো এখতিয়ার নিয়ে অভিযোগ সংশ্লিষ্ট বিষয়টি নিয়ে কাজ করার। বিশ্লেষকরা দুদকের এই সাম্প্রতিক প্রবণতাকে দায়মুক্তির ভিন্ন কৌশল বলেই বিবেচনা করছেন। সাম্প্রতিক এমন একটি ঘটনাতেই রয়েছে এর প্রমাণ।
পেট্টো বাংলার অধীনস্থ প্রতিষ্ঠান কর্ণফুলি গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেডে (কেজিডিসিএল) ২০১১ সালে একটি নিয়োগ প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়। বেশ কিছু কর্মকর্তার সঙ্গে সহকারি ব্যবস্থাপক (সাধারণ) হিসেবে নিয়োগ লাভ করেন মহিউদ্দিন চৌধুরী এবং উপ-ব্যবস্থাপক (কারিগরি) আশেক উল্লাহ চৌধুরী। এ নিয়ে তখনই ব্যাপক প্রশ্ন ওঠে। বিতর্কেও জন্ম দেয়। কারণ এ দুই কর্মকর্তা সম্পর্কে পরষ্পর সহোদর। উভয়ের পিতা- আইয়ুব খান চৌধুরী।যিনি তখন পেট্টোবাংলার জেনারেল ম্যানেজার (জিএম) ছিলেন। পরবর্তীতে পরিচালক (পরিকল্পনা) হিসেবে অবসরে যান। কেজিডিসিএল আইয়ুব খানের অধীনস্থ প্রতিষ্ঠান। ক্ষমতার অপব্যবহার করে তিনি নিজের দুই পুত্রকে পেট্টো বাংলায় চাকরি দেন। এ ক্ষেত্রে আশ্রয় নেন ভয়ঙ্কর জালিয়াতির।
আরও পড়ুন<<>> লুট হচ্ছে ডাক বিভাগের অর্থ, ধরা পড়লেও বিচার হয় না
বিষয়টি অনুসন্ধানের জন্য আসে দুর্নীতি দমনকমিশনে।কিন্তু কমিশনের একজন সাবেক কমিশনার এবং একজন নিকটাত্মীয়ের সহযোগিতায় আইয়ুব খান অনুসন্ধানটি দুদকে ধামাচাপা দেন। এখতিয়ারভুক্ত না হওয়া সত্ত্বেও বিষয়টি ‘তদন্ত’র জন্য পাঠিয়ে দেন (স্মারক নং-০০.০১.০০০০.৫০৩.২৬.৩৬৬.২৩-৩২২০৪) পেট্টোবাংলায়। গত ৩ সেপ্টেম্বর নথিটি হাতে পেয়ে ২৫ সেপ্টেম্বর তদন্তের জন্য ৩ সদস্যেও একটি কমিটি করে। প্রতিষ্ঠানটির মহা-ব্যবস্থাপক (উৎপাদন ও বিপণন), আনোয়ারুল ইসলামকে আহ্বায়ক করে গঠন করা হয় তদন্ত কমিটি। অপর দুই সদস্য হলেন- একই প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপক ( হিসাব) তারিকুল ইসলাম এবং ব্যবস্থাপক (প্রশাসক) মুহাম্মদ লুৎফর রহমান। কমিটিকে তদন্তপূর্বক সুনির্দিষ্ট মতামত দিয়ে প্রতিবেদন দাখিল করতে ২০ দিনেরসময় বেধে দেয়া হয়।
নিয়োগে জালিয়াতি হয় যেভাবে: প্রাপ্ত রেকর্ডপত্র মতে, সনদ জালিয়াতির মাধ্যমে বড় ছেলে আশিক উল্লাহ চৌধুরী ও মেজো ছেলে মহিউদ্দিন চৌধুরীকে নিজ প্রতিষ্ঠান পেট্টো বাংলায় চাকরি দেন আইয়ুব খান চৌধুরী। ২০১৬ সালে উপ-ব্যবস্থাপক (কারিগরি) পদে চাকরি পান আশিক উল্লাহ চৌধুরী।
কেজিডিসিএল’র অর্গানোগ্রাম অনুযায়ী ২০১৫ সালে ২২টি উপ-ব্যবস্থাপক (সাধারণ) পদের মধ্যে ১৭টি, ২০টি উপ-ব্যবস্থাপক (হিসাব) পদের মধ্যে ৭টি, ৩৮টি উপ-ব্যবস্থাপক (কারিগরি) পদের মধ্যে ১০টি পদ শূন্য ছিল। এ ধরণের পদ সাধারণত: পদোন্নতির মাধ্যমে পূরণ করা হয়। এমন উচ্চ পদে সরাসরি নিয়োগের কোনো নজির নেই। কিন্তু সরাসরি নিয়োগের জন্য উপ-ব্যবস্থাপক (কারিগরি) এবং উপ-ব্যবস্থাপক (হিসাব) পদে নিয়োগের লক্ষ্যে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হয়। এসব নিয়োগ নিয়ে ভবিষ্যতে প্রশ্ন উঠতে পারে তাই সহকারি ব্যবস্থাপক (সাধারণ) পদের কোনো নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করেননি কেজিডিসিএল’র তৎকালিন ব্যবস্থাপনা পরিচালক আইয়ুব রখান চৌধুরী।
বিজ্ঞপ্তিরর শর্ত অনুযায়ী আশেক উল্যাহ চৌধুরীর চাকরির অভিজ্ঞতা ৫ বছরপূর্ণ না হওয়ায় আইয়ুব খান চৌধুরী ৭ মাস নিয়োগের নথি আটকে রাখেন। এর আগে প্রার্থীদের যোগ্যতা যাচাইয়ের জন্য কারিগরি পদগুলোর লিখিত পরীক্ষা বুয়েট কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে নেয়া হবে-মর্মে কেজিডিসিএর বোর্ডের ৭৪ তম সভায় সিদ্ধান্ত হয়। কিন্তু আশিকউল্লাহ চৌধুরীর চাকরি নিশ্চিত করার জন্য ৭৪তম বোর্ড সভার সিদ্ধান্তকে তোয়াক্কা না করে সাবেক এমডি তার অধীনস্থ মহা-ব্যবস্থাপকদের দিয়ে প্রশ্নপত্র তৈরি করে পেট্টোবাংলার অফিস পেট্টো সেন্টারে লিখিত পরীক্ষা গ্রহণ করান। দ্রুততম সময়ের মধ্যে উপ-ব্যস্থাপক (কারিগরি) ক্যাডারে নিয়োগ প্রক্রিয়া সম্পন্ন করেন। অথচ একই বিজ্ঞপ্তিতে অন্যান্য পদের নিয়োগ সম্পন্ন করতে অনেক দেরি হয়। এমনকি উপ-ব্যবস্থাপক (অর্থ ও হিসাব) ক্যাডারে শেষ পর্যন্ত কোনো নিয়োগই দেয়া হয়নি। ক্ষমতার অপব্যবহার করে আইয়ুবখান চৌধুরী এভাবেই নিজ পুত্রের নিয়োগ নিশ্চিত করেন।
আরও পড়ুন <<>> বেস্ট হোল্ডিংসের ভয়ঙ্কর জালিয়াতি! শেয়ার বাজারে আসছে
তবে ঘটনার ধারাবাহিকতা এবং রেকর্ডপত্র বলছে আশিকউল্লাহ চৌধুরীকে চাকরি দেয়া হয়েছে জালিয়াতির মাধ্যমে। কারণ, নিয়োগবিজ্ঞপ্তির ৭ শর্ত ও কর্ণফুলি গ্যাসের চাকরি প্রবিধানমালার/সার্ভিস রুলের শর্ত অগ্রাহ্য করে অভিজ্ঞতার সনদ ছাড়াই ২০১৬ সালে উপ-ব্যবস্থাপক (কারিগরি) পদে তাকে নিয়োগ দেয়া হয়। নিয়োগের পর ১২/০১/২০১৬ তারিখে উত্থাপিত অভিজ্ঞতার সনদ ও ছাড় পত্র প্রত্যয়ন’ সংক্রান্ত নোটটি পর্যালোচনা করলে স্পষ্টতই প্রমাণিত হয় যে, আশিকউল্লাহ চৌধুরীর অভিজ্ঞতার সনদ জালিয়াতির আশ্রয় নিয়ে সনদ ইস্যুকারী প্রতিষ্ঠানে যাচাইয়ের জন্য পাঠানো হয়নি।
জালিয়াতির মাধ্যমে নিশ্চিত করা হয় মেজো ছেলে মহিউদ্দিন চৌধুরীর নিয়োগও। ২০১১ সালের ৩ জানুয়ারি মহিউদ্দিন চৌধুরী চাকরির আবেদনে মিথ্যা তথ্য দেন। শিক্ষাগত যোগ্যতার কলামে তিনি ‘২০১০ সালে বিবিএপাস’ মর্মে উল্লেখ করেছেন। অথচ তিনি তখন বিবিএতে পড়াশুনা করছেন মাত্র। তিনি ইন্ডিপেন্ডেন্ট ইউনিভার্সিটির যে সনদ দাখিল করেছেন সেটির ইস্যু তারিখও ০৩/০১/২০১১। নিয়ম অনুযায়ী কেজিসিডিএল’যখন চাকরির আবেদন প্রাথমিকভাবে বাছাই করে-তখনই মহিউদ্দিনের আবেদনটি বাতিল হয়ে যাওয়ার কথা। কারণ আবেদনকালিন সময় পর্যন্ত মহিউদ্দিনের শিক্ষাগত যোগ্যতা ছিলো এইচএসসি। কিন্তু পেট্টোবাংলার তৎকালিন জিএম (প্রশাসন) আইয়ুব খান চৌধুরী ক্ষমতার অপব্যবহার করে নিজ পুত্রের নামে ইন্টারভিউ কার্ড ইস্যু করান। ইন্টারভিউতে ‘উত্তীর্ণ’ করান এবং ২০১১ সালের সেপ্টেম্বরে সহকারি ব্যবস্থাপক পদে চাকরিতে যোগদান নিশ্চিত করেন। অর্থাৎ বিবিএ পাস করার আগেই তিনি আবেদন করে কর্ণফুলিতে চাকরি লাভ করেন।
ওই নিয়োগ বিজ্ঞপ্তিতে এ পদের জন্য শিক্ষাগত যোগ্যতা চাওয়া হয়েছিলো প্রথম শ্রেণীতে স্নাতকোত্তর। অথবা দ্বিতীয় শ্রেণীতে স্নাতকোত্তর সমেত সম্মানে দ্বিতীয় শ্রেণী। অথবা ৪ বছর মেয়াদী ডিগ্রিতে ২য় শ্রেণী বা সমমানের স্নাতক সম্মান ডিগ্রি। এসব ‘অথবা’ অপশন যুক্তই করা হয়ে ছিল আইয়ুব খান চৌধুরীর ছেলের চাকরি নিশ্চিত করার লক্ষ্যে। কারণ কেজিডিসিএল’র সার্ভিস রুলে শিক্ষাগত যোগ্যতার সর্বশেষ অপশন রাখার কোনো বিধান নেই। এখানে স্পষ্টতই প্রমাণিত হয় যে, ‘৪ বছর মেয়াদী’ শব্দটি যথোপযুক্ত নয়। কারণ ২০০৮ সালের স্প্রিং সেমিস্টাওে বিবিএ ভর্তি হয়ে কোনোভাবেই ২০১২ সালের সেপ্টেম্বেরের আগে ৪ বছর মেয়াদ পূর্ণ হয় না। অথচ ইন্ডিপেন্ডেন্ট ইউনিভার্সিটি কর্তৃক ২০ ফেব্রুয়ারি ২০১৯ সালে ইস্যুকৃত মহিউদ্দিন চৌধুরীর বিবিএ সনদ থেকে প্রমাণিত হয়।
আরও পড়ুন <<>> পেট্রোবাংলার দুর্নীতি, ‘তদন্ত’ কমিটির তদন্ত করবে কে?
এটিই শেষ নয়। মহিউদ্দিন চৌধুরীকে যখন ২০১৭ সালে উপ-ব্যবস্থাপক পদে পদোন্নতি দেয়া হয় তখনতার রেটিং শীটে বিবিএ’র কাল্পনিক পাসের সন দেখানো হয় ২০১১ সাল। তার ছেলের নিয়োগ নিয়ে একদিন না একদিন প্রশ্ন উঠতে পারে-এমনিটি নিশ্চিত হয়ে আইয়ুবখান চৌধুরী ২০১৪ সালে কেজিডিসিএল’র ব্যবস্থাপনা পরিচালক পদে আসীন হয়ে নিয়োগ প্রক্রিয়ার সব নথি গায়েব করে দেন।
আইয়ুব খানের দুই পুত্রকে নিজ প্রতিষ্ঠানে নিয়োগ দুর্নীতির অভিযোগটি দুদকে দীর্ঘ দিন পড়ে থাকে। এক পর্যায়ে সাবেক জ্বালানি সচিব ড. মোজাম্মেল হক খান দুদকের কমিশনার হলে তিনি সেটি ধামাচাপা দিয়ে রাখেন। কারণ মোজাম্মেল হক খানের ছেলেকেও পেট্টোবাংলায় চাকরি দিয়েছেন আইয়ুব খান চৌধুরী। ফলে অনুসন্ধানটি আলোর মুুখ দেখেনি। মোজাম্মেল হক খান অবসরে চলে গেলে বিষয়টি কৌশলে তদন্তের জন্য ফেরত পাঠানো হয় পেট্টোবাংলায়। অর্থাৎ যে প্রতিষ্ঠান দুর্নীতি ও জালিয়াতির সঙ্গে যুক্ত সেই প্রতিষ্ঠানকেই দায়িত্ব দেয়া হয় তদন্তের।
তদন্তের অগ্রগতি সম্পর্কে জানতে চেয়ে যোগাযোগ করা হয় তদন্ত কমিটির আহ্বায়ক মহাব্যবস্থাপক আনোয়ারুল ইসলামের সঙ্গে। একাধিক বার ফোন করলেও তিনি সাড়া দেননি।
দুদকের তফসিলভুক্ত অপরাধের তদন্ত অন্য প্রতিষ্ঠান কিভাবে করে-জানতে চাইলে দুদক সচিব মো: মাহবুব হোসেন বলেন, প্রজাতন্ত্রের কর্মকর্তা-কর্মচারির বিরুদ্ধে জালজালিয়াতির বিষয়টি হলে এটি দুদকের এখতিয়ার। এ ক্ষেত্রে তথ্যগত কোনো গ্যাপ আছে কি না খোঁজ নিয়ে দেখতে হবে।
আপন দেশ/এবি
মন্তব্য করুন # খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, আপন দেশ ডটকম- এর দায়ভার নেবে না।