ছবি: আপন দেশ
শিক্ষা প্রকৌশল অধিদফতরের (ইইডি) প্রধান প্রকৌশলী মো. দেলোয়ার হোসেন মজুমদারের শেষ কর্মদিবস ১৩ ফেব্রুয়ারি। চাকরি জীবনের ইতি টানবেন ভালোবাসা দিবসে। তাকে ২০২২ সালের ১৬ অক্টোবর ইইডির প্রধান প্রকৌশলীর রুটিন দায়িত্ব দেয় শিক্ষা মন্ত্রণালয়। এরপর অন্তত তিন দফা পদোন্নতি বাগিয়ে তিনি প্রধান প্রকৌশলীর পূর্ণ দায়িত্ব পান। সুবিধা নিচ্ছেন গ্রেড-২ এর।
অন্যদিকে বিসিএস সাধারণ শিক্ষা ক্যাডারের সর্বোচ্চ সংস্থা মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদফতরের (মাউশি) মহাপরিচালকের পদটি গ্রেড-১। তবে বর্তমান মহাপরিচালক প্রায় চার বছর ধরে গ্রেড-৩-এর সুবিধা নিচ্ছেন। তার পদোন্নতি হচ্ছে না। কারণ এই সংস্থার সঙ্গে আর্থিক ব্যয় বা কেনাকাটার কোনো সম্পৃক্ততা নেই।
প্রধান প্রকৌশলীর বিরুদ্ধে যত অভিযোগ:
মো. দেলোয়ার হোসেন মজুমদার ইইডির প্রধান প্রকৌশলীর দায়িত্ব নেয়ার পরই সুবিধা আদায়ের জন্য মোটাদাগের অন্তত ১৫টি অনিয়মে জড়িয়ে পড়েন। এর মধ্যে রয়েছে- ১. দুর্নীতির সিন্ডিকেট গড়ে তোলা, ২. বদলি ও পদোন্নতিতে সিন্ডিকেট, ৩. সরকারিভাবে অর্থ ছাড় বন্ধ থাকা সত্ত্বেও নির্ধারিত পারসেন্টেজের বিনিময়ে শত শত টেন্ডার আহ্বান, ৪. ডিজাইন ড্রয়িং ছাড়া টেন্ডার আহ্বান, ৫. প্রত্যেক ঠিকাদারের কাছ থেকে ডিজাইনের জন্য টাকা আদায়, ৬. টাকা ছাড়া কোনো ডিজাইন না দেয়া (এতে ঠিকাদার নির্ধারিত সময়ে কাজ সম্পন্ন করতে পারেন না), ৭. ডিজাইন পরিবর্তন করে ১০ থেকে ১৫ শতাংশ ঘুষ আদায়, ৮. অতিরিক্ত টাকা দিয়ে রিভাইজ এস্টিমেট পাস করা, ৯. চলতি বিল উত্তোলনে পাঁচ শতাংশ ঘুষ আদায়, ১০. চূড়ান্ত বিল উত্তোলনের ক্ষেত্রেও নির্ধারিত অংকের টাকা আদায়, ১১. আগে ঘুষ-আগে বিল পাস এবং বেশি ঘুষে বিল দ্রুত পাস করা, ১২. উন্নয়নের জন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের নাম তালিকাভুক্তিতে পাঁচ থেকে ১০ শতাংশ ঘুষ আদায়, ১৩. পেনশনের ফাইল আটকিয়ে টাকা আদায়, টাকা না দিলে অডিট আপত্তির দোহাই দিয়ে পেনশন আটকে রাখা, অডিট আপত্তি নিষ্পত্তির জন্য মোটা অংকের ঘুষ আদায়, ১৪. বদলির ভয় দেখিয়ে সিন্ডিকেটের মাধ্যমে নির্বাহী প্রকৌশলীদের কাছ থেকে টাকা আদায় এবং ১৫. অগ্রিম টাকা না দিলে পদোন্নতির ফাইল আটকে রাখা অন্যতম।
এছাড়া প্রধান প্রকৌশলী হওয়ার পর নিয়ম-নীতির তোয়াক্কা না করে অন্তত আটজনকে ডিঙ্গিয়ে একজন জুনিয়র কর্মকর্তাকে ইইডির হিসাবরক্ষক কর্মকর্তার দায়িত্ব দিয়েছেন দেলোয়ার। এ নিয়ে সংস্থাটিতে দীর্ঘদিন ধরেই অসন্তোষ বিরাজ করছে বলে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন।
সবমিলিয়ে দেড় বছরের কাছাকাছি সময় প্রধান প্রকৌশলীর দায়িত্ব পালন করেও চাকরির খায়েশ মিটছে না দেলোয়ার হোসেন মজুমদারের। তিনি এখন দুই বছরের চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ বাগাতে নতুন শিক্ষামন্ত্রীর কাছে নিয়মিত ধর্না দিচ্ছেন। নানা জায়গা ম্যানেজও করছেন। এ নিয়ে অধীনন্থ প্রকৌশলীদের মধ্যে ক্ষোভ বিরাজ করছে।
দেলোয়ারের আমলনামা:
২০১৫ সালে ভোলা সরকারি কলেজের ভবনটির পাঁচতলা ভিতবিশিষ্ট প্রথম তিনতলা পর্যন্ত নির্মাণ কাজটি সম্পন্ন করে হস্তান্তর করা হয়। এরপরই ভবনে নিম্নমানের নির্মাণ কাজ শনাক্ত হয়। নিম্নমানের সিমেন্ট ও নির্ধারিত মাপের চেয়ে কম মাপের রড ব্যবহার করা হয়।
গুরুতর অভিযোগের প্রেক্ষিতে ২০১৮ সালে ইইডি কর্তৃপক্ষ উচ্চ পর্যায়ের একটি কমিটি গঠন করে। ওই সময় ভবনের চতুর্থ তলার ছাদ ঢালাই সম্পন্ন হয়। ইইডির পরিদর্শন ও তদন্ত কমিটি ২০১৮ সালের ২২ ডিসেম্বর একটি প্রতিবেদন জমা দেয়। তাতে নির্মাণ কাজে বড় ধরনের অনিয়ম চিহ্নিত হয়। তদন্ত কমিটি মত দিয়েছে, ‘ভবনটি পাঁচতলা পর্যন্ত সম্প্রসারণ না করে চারতলা পর্যন্ত সম্প্রসারণ করে কাজটি সমাপ্ত করা।’
ওই কমিটি নিম্নমানের অবকাঠামো নির্মাণের ঘটনায় ভোলা জোন অফিসের তৎকালীন নির্বাহী প্রকৌশলী দেলোয়ার হোসেন মুজমদারকে দায়ী করে।
তবে ওই সময় দেলোয়ার দাবি করেন, এ ঘটনায় তিনি ‘ষড়যন্ত্রের’ শিকার। তাকে উদ্দেশ্যমূলকভাবে হয়রানি করা হচ্ছে। যা বিভাগীয় মামলায় প্রমাণিত হয়েছে। সর্বশেষ তদন্ত প্রতিবেদনেও তাকে অব্যাহতি দেয়া হয়েছে বলে জানান দেলোয়ার হোসেন।
অথচ ওই ভবনটি পড়েই রয়েছে। সম্প্রতি কয়েকজন প্রকৌশলীর কাছ থেকে প্রায় ২৬ লাখ টাকা চাঁদা তুলে ওই ভবনটি কিছুটা মেরামত করে কাজ চারতলা পর্যন্ত ‘সম্পন্ন’ করা হয়েছে। পাঁচতলা হয়নি।
এর আগে বিভাগীয় মামলার অংশ হিসেবে ২০১৯ সালের ২৮ এপ্রিল দেলোয়ার হোসেনকে কারণ দর্শানো নোটিশ দেয় শিক্ষা মন্ত্রণালয়। এতে বলা হয়েছিল, ‘আপনি সরকারি নিয়মনীতির কোনোরূপ তোয়াক্কা না করে ব্যক্তিগত সুবিধা হাসিল করার লক্ষ্যে ঠিকাদারের সঙ্গে যোগসাজসপূর্বক সরকারি স্বার্থ ক্ষুন্ন করেছেন, যা ‘পাবলিক প্রকিউরমেন্ট আইন-২০০৬ ও পাবলিক প্রকিউরমেন্ট বিধিমালা-২০০৮’র এর ৬৪ ধারার বিধান মতে পেশাগত অসদাচরণ ও দুর্নীতির শামিল।’
রহস্যজনক কারণে দেলোয়ার হোসেনকে অব্যাহতি দেন তৎকালীন একজন সচিব। পরবর্তীতে মন্ত্রণালয়ের শীর্ষ পদে কর্মকর্তা বদলি হলে ঘটনার পুনঃতদন্তের সিন্ধান্ত হয়।
২০১৮ সালের ৩১ ডিসেম্বর ইইডির তৎকালীন অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী মজিবুর রহমান সরকারের নেতৃত্বে ভোলা কলেজের অবকাঠামো পরিদর্শনে যান প্রধান কার্যালয়ের নির্বাহী প্রকৌশলী মীর মুয়াজ্জেম হোসেন, বরিশাল জোনের তৎকালীন নির্বাহী প্রকৌশলী (বর্তমানে তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী) সমীর কুমার রজক দাস ও ভোলা জোনের ওই সময়কার নির্বাহী প্রকৌশলী হাদিউজ্জামান খান।
ওই কমিটির প্রতিবেদনে মতামত দেয়া হয়, ‘তৃতীয় তলা ছাদে রেট্রোফিটিংয়ের মাধ্যমে স্লাব থিকনেসের সমাধান করা। ভবনটি পাঁচতলা পর্যন্ত সম্প্রসারণ না করে চার তলা পর্যন্ত সম্প্রসারণ করে কাজটি সমাপ্ত করা।’
এক জেলায় চাকরি করে অন্য জেলায় বিলে স্বাক্ষর:
একটি অভিযোগপত্রে বলা হয়েছে, কুমিল্লা জেলার সহকারী প্রকৌশলী (ইইডি) থাকা অবস্থায় ২০১১ সালের ২ ফেব্রুয়ারি দেলোয়ার হোসেন মজুমদারকে ভোলা জোনের নির্বাহী প্রকৌশলীর চলতি দায়িত্ব দেয় শিক্ষা মন্ত্রণালয়।
ওই আদেশে আটজন কর্মকর্তা নতুন কর্মস্থলে যোগদান করলেও দেলোয়ার হোসেন যোগদান করেননি। তিনি ২০১১ সালের জুন মাসেও কুমিল্লা জেলার সকল উন্নয়ন কাজের বিলে স্বাক্ষর করেন। সকল দাপ্তরিক কাজে (কুমিল্লা) তার স্বাক্ষরের কাগজপত্র বিদ্যমান আছে। ২০১১ সালের ১৪ জুলাই পর্যন্ত কুমিল্লা জোনের যাবতীয় কাগজপত্রে স্বাক্ষর করেন দেলোয়ার হোসেন।
সেই সময়ে ভোলা জোনের দায়িত্বে থেকে ইউনুস আলী ২০১১ সালের জুন পর্যন্ত উন্নয়ন কাজের সকল বিল প্রদানসহ দাফতরিক কাজ পরিচালনা করেন। দেলোয়ার হোসেন মজুমদার ওই সময়ে ভোলা জোনের কোনো বিলে স্বাক্ষর করেননি বা তার স্বাক্ষরে কোনো বিল পাশ হয়নি। অথচ তিনি ‘অসততার’ আশ্রয় নিয়ে পুরোনো তারিখে ২০১১ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি যোগদানপত্র দাখিল করেন বলে অভিযোগপত্রে উল্লেখ করা হয়েছে।
মো. দেলোয়র হোসেন মজুমদারের বক্তব্য:
সরকারি অর্থ বরাদ্দ কখনোই বন্ধ ছিল না। টেন্ডার যত কম সময়ের মধ্যে টেন্ডার আহ্বান ও কাজ শেষ করা যায়, সরকারের তত খরচ কমে। আমি আসার পরে, যেটা তিন মাসে হতো, সেটা রিভ্যালুয়েশন করে ১০-১৫ দিনেই সেটেল করে দিতাম।
ডিজাইনের জন্য আলাদা ইউনিট করে দিয়েছি। সব সিদ্ধান্ত আমার কাছে আসে না। চিফ ইঞ্জিনিয়ার কখনো ডিজাইন ইস্যু করেন না। শুধু ডিজাইনগত পরিমাণটা সই করে দেন।
অডিটের ফয়সালা না হলে পেনশন দেয়া যায় না। কর্মরত প্রতিষ্ঠান থেকে কাপজপত্র আসলে সেগুলো আমরা মিনিস্ট্রিতিতে পাঠাই। মিনিস্ট্রি সেটা শিক্ষা অডিট অধিদফতরে পাঠায়। সেখান থেকে নিষ্পণ্নযোগ্য পত্র পেলে পেনশন ক্লিয়ার করে দেই। আগে পেনশনের কাগজ পাস হতে দুই-তিন মাস লাগতো। আমি আসার পর কাগজপত্র কেউ আটকাতে পারে না।
আমি নিয়ে আসছি, এটা সত্য। দুটো কারণে। প্রযুক্তিগত ও কারিগরি যোগ্যতা। প্রধান কার্যালয়ে চৌকস কর্মকর্তাদের জায়গা, এবং দরকারও। কিন্তু তার উপর যারা ছিল তারা কেউ এসব বিষয়ে দক্ষ নয়। বিধায় তাকে অ্যাকাউন্টসে এনেছি।
তবে ঘুষ লেনদেনে বিষয়ের সব প্রশ্নের জবাব এড়িয়ে যান দেলোয়ার হোসেন।
আপন দেশ/এবি/এসএমএ
মন্তব্য করুন # খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, আপন দেশ ডটকম- এর দায়ভার নেবে না।