ছবি: সংগৃহীত
বিশ্ববিদ্যালয়। লালিত স্বপ্নের স্থাপত্য। উচ্চ আকাঙ্ক্ষা নিয়ে এ আঙিনায় পা রাখেন স্বপ্নবাজ শিক্ষার্থী। শিক্ষাঙ্গনে একে তো র্যাগিং, বুলিংয়ে জীবন অতিষ্ঠ। তারপর এখানকার ‘অন্ধকার রীতি’ বিবর্ণ করে তোলে স্বর্ণালো ভবিষ্যত। কুড়ে কুড়ে ধ্বসে দেয় স্বপ্নচূড়া। কালের আবর্তে র্যাগিং, বুলিং কমেছে কিন্তু নতুন যোগ হয়েছে যৌন হয়রানি। হালে তা মড়কে রূপ নিয়েছে। এটাই যেন উচ্চ শিক্ষালয়ের নিয়মিত দৃশ্য। আর এর শিকার হচ্ছেন ছাত্রীরা। বাদ যায় না নারী শিক্ষকরাও।
ক্ষুব্ধদের মতে, মানুষ গড়ার কারখানায় এসে নিপীড়করা অমানুষ হয়েই ঘরে ফিরছে। অর্জন হিসাবে হাতে জোটে ক’টি কাগুজে সনদ। যার ফলে কর্মজীবনেও সে চর্চার বহিঃপ্রকাশ ঘটায় নারীলোভীরা।
হালচিত্র বলছে, দেশের শীর্ষ পাঁচ বিশ্ববিদ্যালয়ে গত দুই বছরে ২৭টি যৌন হয়রানির ঘটনা পাওয়া গেছে। আর গত এক বছরে প্রায় ২০টি যৌন হয়রানির অভিযোগ পেয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) প্রশাসন। চলতি বছরের ১৩ জানুয়ারি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষক দ্বারা যৌন হয়রানির শিকার হন মাস্টার্সের এক ছাত্রী। ১০ ফেব্রুয়ারি ঢাবির এক অধ্যাপকের বিরুদ্ধে যৌন হয়রানির অভিযোগ ওঠে। ঢাবিতে ওই মাসেই একজন অধ্যাপকের বিরুদ্ধে পরপর দুটি যৌন নিপীড়নের অভিযোগ ওঠে।
চলতি মার্চের শুরুতে জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই শিক্ষকের বিরুদ্ধে যৌন হয়রানির অভিযোগ ওঠে। ভুক্তভোগী ছাত্রীর অভিযোগ, অনৈতিক প্রস্তাবে রাজি না হওয়ায় তার ওপর নেমে আগে একগুচ্ছ অন্যায়-অনাচার। পরীক্ষায় অনুপস্থিত দেখানো হয়। জরিমানা আদায় করা হয়। নম্বর কম দেয়া হয়। আটকানো হয় থিসিস পেপার। তাতেও লালসার ক্ষোভ মেটেনি দুশ্চরিত্র শিক্ষকের। সুযোগ বুঝে শারীরিক হেনস্তা ও যৌন হয়রানি করে।
এদিকে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে (জবি) শিক্ষার্থী ফাইরুজ অবন্তিকা হয়রানি অভিযোগ এনে আত্মহনন করেছেন। অনাকাঙ্ক্ষিত মৃত্যুর জন্য দায়ী করেছেন সহপাঠী ও শিক্ষককে। লিখে গেছেন ‘সুইসাইড নোট’। এরপর ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের আরেক ছাত্রী নিজ বিভাগের শিক্ষকের বিরুদ্ধে যৌন হয়রানির অভিযোগ আনেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের যৌন নিপীড়ন বিরোধী সেল অথর্ব। তাই অভিযোগ নিয়ে হাজির হয়েছের ডিবি পুলিশের কাছে। তাতেও আশ্বস্ত হতে পারেননি। নিজের নিরাপত্তা চিন্তায় দ্বারস্থ হয়েছেন রাষ্ট্রপতির। যিনি সকল বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্য।
বিশ্লেষকরা বলছেন, যৌন নিপীড়নের শিকার হলেও বিশ্ববিদ্যালয়ের ৯০ শতাংশ ছাত্রীই অভিযোগ করেন না। অভিযুক্তরা অধিকাংশই তাদের সহপাঠী ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক।
গবেষণা বলছে, নিপীড়কের তালিকায় ৯ শতাংশ শিক্ষক। আর ৫৬ শতাংশ সহপাঠী। এটি কেবল পরিসংখ্যান নয়, বরং ভীতিকর বার্তা। ঘটনার একটু ভেতরে গেলেই তা উপলব্ধি করা যায়।
আরও পড়ুন>> জবি ছাত্রীর ফেসবুকে পোস্ট দিয়ে আত্মহত্যা
বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বিচারহীনতার সংস্কৃতি, রাজনৈতিক প্রভাব চরম আকার ধারণ করেছে। কোথায় বিচার পাওয়া যাবে—সে সম্পর্কে প্রচারের ঘাটতি রয়েছে। আছে শিক্ষকদের অসহযোগিতা। লোকলজ্জা, সামাজিক ও পারিবারিক চাপ। এমনকি পড়াশোনা বন্ধ হয়ে যেতে পারে—এ শঙ্কায় অনেক ছাত্রী অভিযোগ করেন না। এসব ছাপিয়েই চেষ্টা করেন পড়ালেখা শেষের। ফলে মানসিক যন্ত্রণা নিয়ে সুস্থ জীবনযাপন করতে পারেন না।
ছাত্রীদের অভিযোগ, অভিযুক্ত ব্যক্তিরা প্রভাবশালী। শিক্ষকরাও ভুক্তভোগীদের তেমন আমলে নেন না। বিপরীত লিঙ্গ হওয়ায় সহযোগিতাপূর্ণ মনোভাবও দেখান না। এ অবস্থায় অসহায় বোধ করেন তারা।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উইমেন অ্যান্ড জেন্ডার স্ট্যাডিজ বিভাগের অধ্যাপক ড. সৈয়দ শাইখ ইমতিয়াজ বলেন, ‘প্রথমত যখন কোনো ঘটনা ঘটে তার দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হওয়া প্রয়োজন। আরেকটি হলো এটা যাতে না ঘটে তার ব্যবস্থা নেয়া। এর কোনোটিই আমরা দেখি না।’
২০০৯ সালে নারীদের যৌন হয়রানি রোধে হাইকোর্ট শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও কর্মস্থলে সেল গঠনের নির্দেশ দেন। ওই নির্দেশে অভিযোগ গ্রহণ ও ব্যবস্থা নেয়ার জন্য কমিটি গঠনের কথাও বলা হয়। কোনো অভিযোগ পেলে সয়ংক্রিয়ভাবে সেল কাজ করার কথা। কিন্তু অনেক প্রতিষ্ঠানেই এখনো যৌন নিপীড়ন বিরোধী সেল গঠন করা হয়নি। কিছু কিছু বিশ্ববিদ্যালয়ে যৌন নিপীড়ন বিরোধী সেল থাকলেও কার্যত ভূমিকা রাখতে ব্যর্থ বা নিষ্ক্রিয়।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. স্নিগ্ধা রেজওয়ানা বলেন, ‘আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে এ কমিটি থাকলেও তা ঠিক মতো কাজ করে না। কমিটির সদস্যরাই বিষয়টি ঠিকমতো বোঝেন না।’
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. সাদেকা হালিম বলেন, হাইকোর্টের নির্দেশনা অনুযায়ী করা যৌন হয়রানি প্রতিরোধে কমিটির নির্দেশনা যথাযথভাবে মানা হচ্ছে না। কমিটি নেই বেশির ভাগ বিশ্ববিদ্যালয়ে, থাকলেও তা কার্যকর নয়।
আরও পড়ুন>> রাষ্ট্রপতির শরণাপন্ন যৌন হয়রানির শিকার ছাত্রী
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক অধ্যাপক আব্দুল আলীম বলেন, শিক্ষার্থীকে কোথায় অভিযোগ করতে হবে, সেটি জানানো বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের দায়িত্ব। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের বাইরে নিপীড়নের ঘটনা ঘটলেও সেল বিচার করতে পারবে। ক্যাম্পাসের বাইরে ঘটেছে বলে এড়ানোর সুযোগ নেই।
তিনি আরও বলেন, বিচার না হওয়ার দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতি আছে। এতে অনেক ছাত্রী আত্মহত্যাপ্রবণ হয়ে ওঠেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিটি বিভাগে ভুক্তভোগী ছাত্রীদের সহায়তা দিতে পরামর্শক কেন্দ্র খোলা উচিত। বিচার যেন ধামাচাপা না পড়ে, সেজন্য ১৫ দিনের মধ্যে প্রতিবেদন সিন্ডিকেটের সভায় তোলার পরামর্শ তার।
লেখক ও কলামিস্ট চিররঞ্জন সরকার মনে করেন, নারীকে মানুষ হিসেবে না দেখে কেবল নারী বা ভোগ্যবস্তু হিসেবে দেখার মানসিকতার কারণে তারা সবখানে হয়রানির শিকার হয়। আমাদের সামাজিকীকরণে এখানেই একটা মস্ত গলদ। আর এখান থেকেই আসে নারীদের হয়রানি, অশ্রদ্ধা করার মানসিকতা। আইন-বিচার দিয়ে ক’জনকে নিয়ন্ত্রণ করা যাবে, যদি মন-মানসিকতা না পাল্টায়?
আপন দেশ/এসএমএ/এবি
মন্তব্য করুন # খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, আপন দেশ ডটকম- এর দায়ভার নেবে না।