আপন দেশ। ফাইল ছবি
২০১৮ সালের ঘটনা। আমাকে অগ্নিবীণা হলের ২০১ নম্বর রুমে আটকে রাখা হয়। টানা চার ঘণ্টা নির্যাতন চলে আমার ওপর। ছাড়া পেয়ে ছয়-সাত মাস হাঁটতে পারিনি।
ওইদিন আমাকে উদ্ধার করতে প্রশাসনের কেউ এক মিনিটের জন্যও আসেনি। তখন বিচার চেয়েছিলাম। কিন্তু হল প্রশাসন ও প্রক্টরিয়াল বডি এ ঘটনার কোনো বিচারই করেননি। আমার মতো আরও অনেকেই আছেন যারা নির্মম নির্যাতনের শিকার হয়েছে। কথাগুলো বলছিলেন মো. মোজাম্মেল হক অনিক। সে জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদ শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি ছিলেন অনিক।
আর যার নির্যাতনের শিকার হয়েছেন তার নাম নাঈম। তার হাতে নির্যাতনের শিকার হয়েছেন এ বিশ্ববিদ্যালয়ের মো. ওয়ালিদ নিহাদ, ফরিদ আহমেদসহ অনেকেই। তার লাঠিপেটা থেকে বাদ যায়নি সাংবাদিকরাও। এ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা যাযাবর নাঈমের কথা শুনলে একটু সরে-নড়ে দাঁড়ায়। ভ্রুটাও কুঁচকে নেয়। শুধু শিক্ষার্থীই নয়, শিক্ষকরাও বেকায়দায় পড়ে তার অবৈধ কাজের বৈধতা দেন।
কে এই নাঈম?
পিতামাতার দেয়া নাম আবু নাঈম আবদুল্লাহ। নিজে শর্টকাট করে রেখেছেন যাযাবর নাঈম। কর্মফলে তিনি জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ে আতঙ্কের নাম। প্রায় একদশক ধরে ক্যাম্পাসে ত্রাস হিসেবে পরিচিত। চাঁদাবাজি, ইভটিজিং, নারী কেলেঙ্কারি ও সাধারণ শিক্ষার্থীদের অকারণে নির্যাতনসহ অসংখ্য অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। গত কয়েক বছরে প্রায় অর্ধশত শিক্ষার্থীকে নির্যাতন করেছেন। চাঁদাবাজির ঘটনা বেহিসেবি। নির্যাতন থেকে রেহাই পাননি তার দল ছাত্রলীগের সাবেক নেতাও।
বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে এক বিভাগ থেকে আরেক বিভাগে ভর্তি হয়েছেন নাঈম। ২০১৪-১৫ শিক্ষাবর্ষে ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগে ভর্তি হয়েছিলেন। এখন তিনি ফোকলোর বিভাগের শিক্ষার্থী। দলীয় প্রভাব খাটিয়ে অবৈধ সুবিধা নিয়েছেন। ইংরেজি বিভাগের পরীক্ষায় বছরের পর বছর ফেল করেছেন। তৎকালীন ভিসি অধ্যাপক ড. এ এইচ এম মোস্তাফিজুর রহমান তাকে ‘মানবিক কারণে’ বিভাগ পরিবর্তনের সুযোগ দেন বলে গণমাধ্যমে প্রকাশ।
জানা যায়, ২০১৪-১৫ সেশনে ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগে ভর্তি হয় নাঈম। দুই বছর পরই বিধি ভেঙ্গে তাকে ফোকলোর প্রথম বর্ষে ভর্তি করানো হয়। ফোকলোর বিভাগের শিক্ষকরা সভা করে এ অনিয়মের বিরুদ্ধে প্রশ্ন তুলেন। তবে রাজনৈতিক চাপের মুখে অবৈধ সিদ্ধান্ত বৈধতা পায়।
অভিযোগ রয়েছে, ইংরেজি বিভাগের পরীক্ষায় বহুবার ফেল করা নাঈম ফোকলোর বিভাগের কোনো পরীক্ষাতেই বসেন না। এরপরও তিনি এখন স্নাতক চতুর্থ বষের শিক্ষার্থী। পরীক্ষার সময় এলেই অসুস্থতার ‘নাটক’ সাজান। বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিকেল সেন্টারে ছাত্রলীগের প্রভাব খাঁটিয়ে জোগাড় করেন অসুস্থতার সনদ। ফলে সুযোগ পান বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পরীক্ষা দেয়ার অনুমতি। তবে সে পরীক্ষায় নাঈম নন, অংশগ্রহণ করেন ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগের ২০১৬-১৭ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী আরাফাত হোসেন তীব্র।
আরও পড়ুন>> ক্যাম্পাসের ‘অন্ধকার রীতি’ ঘুচবে কবে?
এছাড়া অভিযোগ রয়েছে, ছাত্রলীগের নাম ভাঙ্গিয়ে ক্যাম্পাসজুড়ে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছেন নাঈম। তিনি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কৃত। তারপরও কীভাবে নাঈম এখনো আবাসিক হলে থাকেন। এসব বিষয়ে নীরব প্রশাসন। ফলে দিনকে দিন আরও বেপরোয়া হয়ে উঠেছে তার ‘সন্ত্রাসী’ কার্যক্রম।
নাঈমের নির্যাতনের শিকার একাধিক শিক্ষার্থী এ প্রতিবেদককে বলেন, বিভিন্ন সময়ে নাঈমের বিরুদ্ধে মামলা করার জন্য আমরা ত্রিশাল থানায় গিয়েছি। কিন্তু থানা মামলা নেয়নি। উল্টো এগুলো বিশ্ববিদ্যালয়ের অভ্যন্তরীণ বিষয় হিসেবে উল্লেখ করে অভ্যন্তরেই সমাধানের পরামর্শ দেয়া হয়। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বিষয়টি বারবার এড়িয়ে যাওয়ায় আরও বেপরোয়া হয়ে উঠেছেন তিনি।
লোক প্রশাসন ও সরকার পরিচালনা বিদ্যা বিভাগের ২০১৯-২০ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী মো. ওয়ালিদ নিহাদ। ২০২২ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি তাকে বঙ্গবন্ধু হলের ৩২৪ নম্বর কক্ষে আটকে রাখেন এ নাঈম। টানা চার ঘণ্টা অমানবিক নির্যাতন করেন। এ ঘটনায় ক্যাম্পাসজুড়ে চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়। ঘটনায় জড়িত নাঈমসহ অন্য তিনজন সাময়িক বহিষ্কৃত হন। বাতিল হয় হলের সিটও। কিন্তু তাতে কিছু যায়-আসেনি। নাঈম ক্যাম্পাসে বহাল তবিয়তে।
ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগের শিক্ষার্থী ফরিদ আহমেদ বলেন, যাযাবর নাইম কোটা সংস্কার আন্দোলনের সময় আমাকেও মারধর করেছিল। কারণ ছিল, আমি কেন কোটা সংস্কার আন্দোলনের সঙ্গে ছিলাম। কেন ছাত্রলীগের রাজনীতি করতাম না। গালিগালাজ ও অত্যাচার করে আমাকে, খুন করে অগ্নিবীণা হলের নিচে চাপা দেয়ার হুমকিও দেয়। এজন্য পিস্তল নিয়ে এসে গুলি লোড করে আমার সামনেই। পরে আমার হাতে পিস্তল দিয়ে ছবি তুলে নিজের মোবাইলে রাখে সে। এ ছবি দিয়ে সে আমাকে শিবির প্রমাণ করতে চায়।
আরও পড়ুন>> নিরাপত্তা চান নজরুল বিশ্ববিদ্যালয়ের ২৭ সাংবাদিক
গত ৫ ফেব্রুয়ারি বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের দুই গ্রুপের মধ্যে সংঘর্ষ চলছিল। এ সময় সংবাদ সংগ্রহ করতে গেলে কর্মরত সাংবাদিকদের ওপর সন্ত্রাসী কায়দায় হামলা চালান যাযাবর নাঈমের অনুসারী লোভন মোখলেস, তানভীর তুহিন (ওয়ালিদ নিহাদ মারধরের ঘটনায় বহিষ্কৃত), মো. শাহরিয়ার, রায়হান, মোস্তফা ফাহিম সিরাজী, আরাফাত হোসেন তীব্র, সৌমিক জাহানসহ ২০-২৫ জন।
বিভিন্ন সময়ে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে নির্মাণ ঠিকাদারদের কাছ থেকেও চাঁদাবাজির অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। চাঁদা না দিলে কাজ বন্ধ করে দেয়াসহ শ্রমিকদের মারধর করার কথাও জানান একাধিক ঠিকাদার।
এদিকে বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগে সক্রিয় এমন বেশ কয়েকজন বলছেন, নাঈমের কারণে ছাত্রলীগের সুনাম ক্ষুণ্ন হচ্ছে। বাংলাদেশ ছাত্রলীগে সন্ত্রাসের কোনো ঠাঁই নেই। কোনো ব্যক্তির বিতর্কিত কর্মকাণ্ডের দায়ভার সংগঠন নেবে না। আমরা চাই যাযাবর নাঈমের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ও প্রশাসনিক পদক্ষেপ নেয়া হোক।
বিভাগ বদলানো প্রসঙ্গে ফোকলোর বিভাগের প্রধান ড. মোহাম্মদ মেহেদী উল্লাহ আপন দেশ’কে বলেন, সেসময় তার বিভাগ পরিবর্তন নিয়ে আমরা বিভাগ থেকে আপত্তি করেছিলাম। কারণ এটি বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়মবর্হিভূত কাজ।
নাঈমের নিজের পরীক্ষায় অন্যকে দিয়ে প্রক্সি দেয়ানোর অভিযোগ আছে। তবে এ বিষয়টি স্বীকার করেননি বিভাগীয় প্রধান মেহেদী উল্লাহ। তিনি বলেন, ‘তার হাতে সমস্যা রয়েছে। বিধায় বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুমতি সাপেক্ষে শ্রুতিলেখক নিয়োগের মাধ্যমে সে পরীক্ষায় অংশ নেয়। এটা বিভাগের সব শিক্ষকই জানেন।’
বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর সঞ্জয় কুমার মুখার্জী আপন দেশ’কে বলেন, গত ৫ ফেব্রুয়ারি বিশ্ববিদ্যালয়ে সাংবাদিক মারধরের একটি অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটেছে। সে বিষয়ে তদন্ত কমিটি হয়েছে। তদন্ত শেষের দিকে। শীঘ্রই তদন্ত প্রতিবেদন জমা হবে। এরপরে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হবে।
‘শিক্ষার্থী মারধরের অভিযোগ প্রক্টর বডি আমলে নেয়নি’ এ বিষয়ে অবগত নন বলেও জানান প্রক্টর সঞ্জয় কুমার মুখার্জী।
আপন দেশ/এসএমএ/এবি
মন্তব্য করুন # খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, আপন দেশ ডটকম- এর দায়ভার নেবে না।