ফাইল ছবি। আপন দেশ
শেয়ার বাজারে চলছে মাতম। বাজারে নতুন শেয়ার ছিল আর্শীবাদ। এখন তা অভিশাপ। নতুন আইপিও’কে গলার কাটা আখ্যায়িত করে তা বন্ধের জন্য দাবি তুলেছে বিনিয়োগকারীরা। নানা কর্মসূচি পালন করছে। বাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) বিনিয়োগকারীদের আশ্বস্তও করেছে। এরইমধ্যে নানা অনিয়মের উপর ভর করে বাজারে আসছে ভয়ঙ্কর ক্রাফটসম্যান ফুটওয়্যার অ্যান্ড এক্সেসরিজ লিমিটেড। আপাতত ৫ কোটি টাকা উত্তোলন করবে এসএমই প্ল্যাটফর্ম থেকে। বাকিটা অবস্থা বুঝে ব্যবস্থা।
ক্রাফটসম্যান ফুটওয়্যার নিয়ে আপন দেশ’র অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে উঠে এসেছে ভয়ঙ্কর জাল-জালিয়াতির চিত্র। এ কোম্পানিটি বাংলাদেশে বির্তকিত ব্যাংক বেসিক ব্যাংকেও ঘোলা পানি খাইয়েছে। ঋণ নিয়ে রয়েছে তুঘলকি কাণ্ড। জুতার কারখানাটির দায়িত্বে যেন আলাদিনের চেরাগ। টার্নওভার দেখলে যেকারোর চোখ কপালে উঠবেই। দেশের সর্ববৃহৎ প্রতিষ্ঠান বসুন্ধর, যমুনা, বেক্সিমকো এমনকি স্কয়ার গ্রুপও যেন এ কারখানাটির কাছে নাবালক প্রতিষ্ঠান। ক্রাফটসম্যানের মুনাফা অর্জনের ধারে কাছেও যেতে পারেনি তারা।
দুনিয়াজুড়ে যখন ব্যবসায় মন্দা তখন এ প্রতিষ্ঠানটি মুনাফা করেছে ৭২ শতাংশ। অর্থাৎ মোট মূল্যের প্রায় সমান লাভ।টার্নওভার বাড়িয়েছে ২০৬ শতাংশ। ঘাপলা রয়েছে ইপিএসেও। প্রতিষ্ঠানটির মালিক শাদাত হোসেন সেলিম। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে চাকরি করতেন, এখনও করেন। ক্রাফটসম্যান ফুটওয়্যারে তার বেতনকড়ির ধরন আন্তর্জাতিক মানের। ঋণ জালিয়াতি, প্লেসমেন্ট শেয়ার, পারিবারিক পরিচালনা পর্ষদ, শ্রম আইন লঙ্ঘনসহ প্রতিষ্ঠানটির খাতে খাতে রয়েছে অনিয়মের দাগ। এ পর্বে আংশিক চিত্র তুলে ধরা হলো।
জানা গেছে, অসংখ্য কোম্পানি তাদের প্রসপেক্টাসে বিনিয়োগকারীদের চোখে ধুলো দিয়েছে। ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে আয়, টার্নওভার, সম্পদের পরিমাণ দেখিয়েছে। শেয়ার বাজারে তালিকাভুক্ত হয়ে হাজার হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। সাধারণ বিনিয়োগকারীদের সর্বশান্ত করেছে। অলটেক্স ইন্ডাস্ট্রিজ, আজিজ পাইপস, নুরানি ডাইং অ্যান্ড সোয়েটার, পিপলস লিজিং, রিং শাইন টেক্সটাইল, স্ট্যান্ডার্ড সিরামিক, সাফকো স্পিনিংস, সুহৃদ ইন্ডাস্ট্রিজ এবং ইয়াকিন পলিমার লিমিটেডের কথা শুনলে ভ্রু কুঁচকে যায় বিনিয়োগকারীদের। নিয়ন্ত্রক সংস্থার আর্শীবাদে কোম্পানিগুলো সুঁচ হয়ে ঢুকে ফাল হয়ে বেরিয়েছে। সুঁচ-ফালের আঘাতে ক্ষত-বিক্ষত শেয়ার বাজার। সব হারিয়ে অনেকে উন্মাদ হয়েছেন। অনেকে বেছে নিয়েছেন আত্মহননের পথ।
বাজার বিশ্লেষক ও গণমাধ্যমের খবরমতে ক্রাফটসম্যান ফুটওয়্যার তেমনি একটি প্রতিষ্ঠান।
আলোচিত কোম্পানিগুলোর উদ্দেশ্যেই ছিল সাধারণ বিনিয়োগকারীদের অর্থ হাতিয়ে নেয়া। বাজারে তালিকাভুক্তির পরে কোন প্রতিষ্ঠানের মালিক উধাও হয়েছেন। উৎপাদন বন্ধ। লভ্যাংশ তো দূরের কথা এজিএমের খবর নেই। এদের নিয়ে শুধু বিনিয়োগকারী নয়, বেকায়দায় বিএসইসি’ও।
আরও পড়ুন>> শেয়ার কেলেঙ্কারিতে দণ্ডপ্রাপ্ত সেই এনআরবি ব্যাংক বাজারে!
ক্রাফটসম্যান ফুটওয়্যার অ্যান্ড অ্যাক্সেসরিজ লিমিটেডের প্রসপেক্টাস সূত্রে জানা গেছে, ৩০ জুন ২০২২ সমাপ্ত বছরে কোম্পানিটির রেভিনিউ বা টার্নওভার ছিল ২৩ কোটি ৯৬ লাখ ১৬ হাজার ১৯৫ টাকা। আর ৩০ জুন ২০২৩ সমাপ্ত বছরে কোম্পানিটির টার্নওভার হয়েছে ৭৩ কোটি ৪২ লাখ ৫৮ হাজার ৭০১ টাকা। মাত্র এক বছরের ব্যবধানে কোম্পানির টার্নওভার বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪৯ কোটি ৪৬ লাখ ৪২ হাজার ৫০৬ টাকা। শতাংশের হিসেবে বেড়েছে ২০৬ শতাংশ। এক্ষেত্রে ৩০ জুন ২০২২ সমাপ্ত বছরে কোম্পানিটির প্রফিট হয়েছিল ২ কোটি ৪৮ লাখ ২৯ হাজার ২৩৩ টাকা। আর ৩০ জুন ২০২৩ সমাপ্ত অর্থ বছরে প্রফিট হয়েছে ৪ কোটি ২৭ লাখ ৩৯ হাজার ৯০০ টাকা। বছরের ব্যবধানে প্রফিট বেড়েছে ১ কোটি ৭৯ লাখ ১০ হাজার ৬৬৭ টাকা। বেড়েছে ৭২ শতাংশ।
বিনিয়োগকারীরা বলছেন, সাধারণত এসএমই প্ল্যাটফর্মে ছোট কোম্পানিগুলো তালিকাভুক্ত হয়। তাদের ম্যানপাওয়ার থেকে উৎপাদন সব কিছুর সীমাবদ্ধতা থাকে। এসব কোম্পানির বছরের ব্যবধানে শতভাগ টার্নওভার বাড়ানো কষ্টসাধ্য ব্যাপার; সেখানে ক্রাফটসম্যান ফুটওয়্যারের ২০০ শতাংশের বেশি টার্নওভার বাড়িয়েছে। যা অত্যন্ত অস্বাভাবিক।
ক্রাফটসম্যান ফুটওয়্যারের প্রধান অর্থ কর্মকর্তা (সিএফও) ফেরদৌস হোসেন জানান, গ্রাহকদের কাছে আমাদের গ্রহণযোগ্যতা হঠাৎ করেই বেড়ে গেছে। যে কারণে তারা অর্ডারও বাড়িয়ে দিয়েছিল। ফলে প্রতিষ্ঠানের টার্নওভারও বেড়েছে।
এদিকে প্রসপেক্টাসে দেখা গেছে, কোম্পানিটি বেসিক ব্যাংক থেকে ৩৭ কোটি ৩৯ লাখ ৫৩ হাজার ৫৯১ টাকা দীর্ঘ মেয়াদী ঋণ নিয়েছে। সম্প্রতি একটি বেসরকারি টিভি চ্যানেলে ক্রাফটসম্যান তথ্য গোপন করে বেসিক ব্যাংক থেকে ঋণ নেয়ার সংবাদ প্রচারিত হয়েছে। তাতে বলা হয়, পর্যাপ্ত জামানত না থাকার পরেও ক্রাফটসম্যান ফুটওয়্যার বেসিক ব্যাংক থেকে মোটা অঙ্কের এ ঋণ নিয়েছে। তথ্য গোপনসহ নানা অনিয়ম করে ব্যাংকটি থেকে এ অর্থ হাতিয়ে নিয়েছে কোম্পানিটি। এখন তাদের টার্গেট শেয়ার বাজার।
বিএসইসির মুখপাত্র মোহাম্মদ রেজাউল করিম আপন দেশকে বলেন, কোম্পানিটির অস্বাভাবিক টার্নওভার বা মুনাফা বৃদ্ধি সম্পর্কে আমি কোনো মন্তব্য করতে পারব না। এ ব্যাপারে কোম্পানির সঙ্গে যোগাযোগ করতে বলেন তিনি।
উল্লেখ্য, এর আগে এসএমই খাতে তালিকাভুক্ত হতে ক্রাফটসম্যান ফুটওয়্যারের কোয়ালিফাইড ইনভেস্টর অফার (কিউআইও) অনুমোদন দেয় বিএসইসি। ৯০০তম কমিশন সভায় এ অনুমোদন দেয়া হয়। কোম্পানিটি কিউআইও’র মাধ্যমে প্রতিটি ১০ টাকা মূল্যে ৫০ লাখ শেয়ার ইস্যুর মাধ্যমে ৫ কোটি টাকা উত্তোলন করবে। কোম্পানিটির ৩০ জুন, ২০২৩ সমাপ্ত বছরে শেয়ারপ্রতি আয় (ইপিএস) হয়েছে ২ টাকা ৩৫ পয়সা। শেয়ারপ্রতি নিট সম্পদ মূল্য (এনএভিপিএস) দাঁড়িয়েছে ১৬ টাকা ৭২ পয়সা। কোম্পানিটির ইস্যু ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে নিয়োজিত রয়েছে গ্রীণ ডেল্টা ক্যাপিটাল লিমিটেড। আগামী ২১ এপ্রিল কোম্পানিটির সাবস্ক্রিপশন শুরু হবে। যা শেষ হবে ২৫ এপ্রিল ২০২৪।
চলবে...
আপন দেশ/টি/এবি/এসএমএ
মন্তব্য করুন # খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, আপন দেশ ডটকম- এর দায়ভার নেবে না।