আপন দেশ। ফাইল ছবি
ক্যাশ রিসিভড বেড়েছিল ৩৬৫ শতাংশ। টার্নওভার বেড়েছিল ২০৬ শতাংশ। শতকরা ৭২ টাকা পোওয়া গেছে মুনাফা। সময়টা ছিল তখন বিশ্ব মন্দার। করোনার পর ২০২৩ সাল। এ চিত্র দেশের একটি জুতা তৈরীর কারখানার কেনা-বেচার। নাম ক্রাফটসম্যান ফুটওয়্যার অ্যান্ড এক্সেসরিজ লিমিটেড। তলানি থেকে আকাশচুম্বি উস্ফালন দেখে দেশের বড় বড় কোম্পানির মালিকরাও হেসে দিয়েছেন।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আপাত দৃষ্টিতে অস্বাভাবিক মনে হচ্ছে। হাল জমানায় কত কিছুই হয়; বানানো যায়। শেয়ারবাজারে আসন্ন ক্র্যাফটসম্যান ফুটওয়্যারের আর্থিক প্রতিবেদন ভালো করে দেখা উচিত। আর সাধারণ বিনিয়োগকারীরা প্রশ্ন রেখে বলছেন, ক্রাফটসম্যানের কারখানায় তৈরি জুতা চামড়ার না ডায়মন্ডের? এতো চাহিদা, এতো লাভের নেপথ্যে কী আছে- প্রশ্ন জনে জনে।
কোয়ালিফাইড ইনভেস্টর অফারের (কিউআইও) মাধ্যমে বাজারে আসছে কোম্পানিটি। এর ইস্যু ম্যানেজার গ্রীণ ডেল্টা ক্যাপিটাল লিমিটেড (জিডিসিএল)। ক্রাফটসম্যানের জুতার চামড়া হলেও কিছু প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারী প্লেসমেন্ট শেয়ার কিনেছেন কোটির অঙ্কে। আছে ব্যক্তি ক্রেতাও। তারা আবার শেয়ারবাজারে কোম্পানিটি আনতে নানা কৌশলী ভূমিকা রাখছেন। ভালো-মন্দ অভিজ্ঞতাসম্পন্ন গ্রীণ ডেল্টাকে সহায়তা করতে প্লেসমেন্ট শেয়ার নিয়েছে এএএ ফাইন্যান্স অ্যান্ড ইনভেষ্টমেন্ট লিমিটেড। দুই ঝানু মার্চেন্ট ব্যাংক তাদের অতীত ক্যারিশম্যাটিক অভিজ্ঞতা কাজে লাগাচ্ছে। বাজারে আনছে জুতা তৈরির কারখানা ক্রাফটসম্যান ফুটওয়্যারকে।
এদিকে সমালোচিত সেই বেসিক ব্যাংকের গ্রাহক ক্রাফটসম্যান ফুটওয়্যার লিমিটেড। শেয়ারব বাজারে কোম্পানিটির সাবস্ক্রিপশন শুরু হবে আগামী ২১ এপ্রিল। যা শেষ হবে আগামী ২৫ এপ্রিল। কিউআইও মাধ্যমে প্রতিটি ১০ টাকা মূল্যে ৫০ লাখ শেয়ার ইস্যুর মাধ্যমে বাজার থেকে ৫ কোটি টাকা উত্তোলন করবে কোম্পানিটি।
জানা গেছে, ক্রাফটসম্যান ফুটওয়্যার ২০২১-২২ অর্থবছরে ক্যাশ রিসিভড ফ্রম সেলস অ্যাক্টিভিটিজ অ্যান্ড আদার ইনকাম বাবদ ১৬ কোটি ৯৩ লাখ ৫০ হাজার ৭০৩ টাকা দেখিয়েছে। যা ২০২২-২৩ অর্থবছরে হয়েছে ৭৮ কোটি ৭২ লাখ ২২ হাজার ৮১৪ টাকা। এক বছরের ব্যবধানে এক্ষেত্রে ৬১ কোটি ৭৮ লাখ ৭২ হাজার ১১১ টাকা বেড়েছে। অর্থাৎ ৩৬৫ গুণ বেড়েছে। বাজার সংশ্লিষ্টদের কাছে এটি অস্বভাবিক বলে মনে হয়েছে। যেখানে দেশের খ্যাতনামা ও বড় বড় কোম্পানিগুলোর বর্তমান প্রেক্ষাপটে সেলস বাড়ানো কষ্টকর হচ্ছে, সেখানে ক্রাফটসম্যান ফুটওয়ারের সেলস অতিউর্বর। ক্যাশ রিসিভডও আলোচনাযোগ্য। কোম্পানিটির এমন কর্মকাণ্ডকে শুভঙ্করের ফাঁকি বলছেন তারা।
শেয়ারবাজারে অন্যতম ব্রোকারেজ হাউস শাকিল রিজভী স্টক লিমিটেড। এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক শাকিল রিজভী আপন দেশ’কে বলেন, বর্তমানে ব্যবসায় মুনাফা করা বেশ কঠিন হয়ে পড়েছে। ক্রাফটসম্যান ফুটওয়্যার এক বছরের ব্যবধানে কীভাবে এতো সেলস বাড়াল আমার জানা নেই। কোম্পানিটির আর্থিক প্রতিবেদন দেখলেই বোঝা যাবে, কোথাও ছলচাতুরির আশ্রয় নিয়েছে কিনা।
অর্থনীতিবিদ আবু আহমেদ বলেন, প্লেসমেন্টধারীরা বেশি দামে শেয়ার বিক্রির জন্য কোম্পানিকে তালিকাভুক্তিতে সজাগ থাকে। তালিকাভুক্তির পর বেশি দামে শেয়ার বিক্রি করে বাজার থেকে চলে যায় তারা। কিন্তু দুঃখের বিষয় হচ্ছে, তারা চলে যাওয়ার পর কোম্পানির মুনাফা কমে যায়। উৎপাদন বন্ধ হয়। বাজারে ধ্বস নামে। ভুক্তভোগী হন বিনিয়োগকারীরা। তাই বাজারের স্বার্থে কোনো কোম্পানিকে তালিকাভুক্তির আগে কমিশনকে আরও বেশি সচেতন হওয়া উচিত।
প্রাতিষ্ঠানিক একাধিক বিনিয়োগকারী বলেন, সুবিধা দিয়ে একটা খারাপ কোম্পানিকে নথিপত্রে ভালো কোম্পানি দেখানো সম্ভব। অনেক কোম্পানি, ইস্যু ম্যানেজার, অডিটররা এসব ঘৃণিত কাজ করে থাকেন। অনেক সময় কমিশন এসব জেনেও না জানার ভান করে। আবার অপ্রতিরোদ্ধ কোনো কোনো শক্তির কাছে হারও মেনে যায়। এতে করে ভুক্তভোগী হন বিনিয়োগকারীরা। কমিশনের উচিত ক্রাফসটম্যান ফুটওয়্যার সাবস্ক্রিপশনের আগে আবারও আর্থিক প্রতিবেদন যাচাই-বাছাই করা।
মন্দা বাজারে আপাতত কোনো আইপিও বা কিউআইও না আনতে অনুরোধ জানিয়েছে বিনিয়োগকারীরা। এ দাবিতে তারা কর্মসূচিও পালন করেছে। দাবি মানার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে নিয়ন্তা সংস্থা-বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি)। কিন্তু রহস্যজনক কারণে আলোচিত কোম্পানিটি বাজারে আনতে তৎপর একটি গোষ্ঠী।
প্লেসমেন্ট শেয়ার নিয়েছেন কারা?
এ কোম্পানিটির স্বত্তাধিকারী শাদাত হোসেন সেলিম। তার কোম্পানিটি বাজারে আনতে পাশে নিয়েছেন প্রভাবশালী মার্চেন্ট ব্যাংক এএএ ফাইন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট লিমিটেড, এএএ হোল্ডিংস লিমিটেড, ব্রোকারেজ হাউস প্রিলিংক সিকিউরিটিজ লিমিটেড, রহমান অ্যান্ড অ্যাসোসিয়েটসের লিমিটেড। প্লেসমেন্ট শেয়ারধারী ১০ ব্যক্তির মধ্যে রয়েছেন- শাখাওয়াত হোসেন, মাহফুজা জাহান, সুজিৎ কুমার রায় নন্দি, মোহাম্মদ ফেরদৌস মাজিদ, ফৌজিয়া ফেরদৌস, মোস্তাক আহমেদ সাদিক, মোহাম্মদ মাসুদুজ্জামান, সামসুর রহমান, মোহাম্মদ সাইফুল ইসলাম, ফারহানা চৌধুরী।
প্রসপেক্টাসে উল্লেখ, এএএ ফাইন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্টের চেয়ারম্যান ও এএএ হোল্ডিংস লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক একই ব্যক্তি। নাম খাজা আরিফ আহমেদ। ক্রাফটসম্যান ফুটওয়্যারের প্লেসমেন্ট শেয়ারধারীদের মধ্যে প্রিলিংক সিকিউরিটিজের পরেই এ প্রতিষ্ঠান দুটির শেয়ার বেশি। এএএ ফাইন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট ১২ লাখ শেয়ার প্লেসমেন্ট নিয়েছে। যার মূল্য ১ কোটি ২০ লাখ টাকা। এএএ হোল্ডিংস লিমিটেড নিয়েছে ১৭ লাখ ৫০ হাজার শেয়ার। যার মূল্য ১ কোটি ৭৫ লাখ টাকা। খাজা আরিফ আহমেদের দুই প্রতিষ্ঠান মিলে নিয়েছে মোট ২৯ লাখ ৫০ হাজার প্লেসমেন্ট শেয়ার। যার মোট মূল্য ২ কোটি ৯৫ লাখ টাকা।
প্লেসমেন্ট শেয়ার বাবদ প্রিলিংক সিকিউরিটিজের বিনিয়োগ রয়েছে ৩ কোটি ৪০ লাখ টাকা। রহমান অ্যান্ড অ্যাসোসিয়েটসের লিমিটেডের বিনিয়োগ রয়েছে ১ কোটি টাকার শেয়ার। উল্লেখযোগ্য ব্যক্তির মধ্যে মোহাম্মদ ফেরদৌস মাজিদের বিনিয়োগ রয়েছে ১ কোটি টাকার। অন্যদের বিনিয়োগ এর চেয়ে কম।
এএএ ফাইন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্টের পরিচালক মো. ওবায়দুর রহমান আপন দেশ’কে বলেন, ক্রাফটসম্যান ফুটওয়্যার ভালো কোম্পানি কিনা জানি না। তবে কোম্পানির কোনো দুর্নীতি নেই। এএএ ফাইন্যান্সের কাছে এ কোম্পানির ১২ লাখ শেয়ার আছে।
অভিজ্ঞতা কী বলে?
শেয়ারবাজারে অভিজ্ঞ ব্রোকার হাউজ শাকিল রিজভী স্টক লিমিটেড। এ প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক শাকিল রিজভী। মন্দা বাজারে তার অভিজ্ঞতা উল্লেখ করে বলেন, বর্তমানে ব্যবসায় মুনাফা করা বেশ কঠিন হয়ে পড়েছে। আসন্ন ক্রাফটসম্যান ফুটওয়্যার এক বছরের ব্যবধানে কিভাবে এতো সেলস, ক্যাশ রিসিভড বাড়াল আমার জানা নেই। কোম্পানিটির কোথাও ছলচাতুরির আশ্রয় নিয়েছে কিনা তা আর্থিক প্রতিবেদন দেখলেই বোঝা যাবে।
ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) পরিচালক শাকিল রিজভী আরও বলেন, খারাপ কোম্পানি হলেও শেয়ার বাজারে তালিকাভুক্ত করতে ইস্যু ম্যানেজারদের পাশাপাশি প্লেসমেন্ট শেয়ারধারীরাও ক্ষমতার অপব্যবহার করে। কারণ খারাপ কিংবা ভালো, যেকোনো পারফর্মেন্সের কোম্পানিকে তালিকাভুক্ত করাতে পারলে ইস্যু ম্যানেজাররা একটা কমিশন পায়। পাশাপাশি প্লেসমেন্ট শেয়ারধারীরাও বেশি টাকায় শেয়ার বিক্রি করতে পারে। অধিক মুনাফা করতে পারে। এ লোভেই অনেক সময় খারাপ কোম্পানিকেও বাজারে তালিকাভুক্তির ব্যাপারে তারা যোগসাজশ করে। এ ব্যাপারে কমিশনকে এগিয়ে আসতে হবে। শুধু ধরাবাধা নিয়মে কোম্পানিগুলোকে তালিকাভুক্তির অনুমোদন দেয়া উচিত নয়।
অর্থনীতি বিশেষজ্ঞের ভাষ্য
শেয়ার বাজারের সঙ্গে অতপ্রোতভাবে জড়িত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির সাবেক অধ্যাপক আবু আহমেদ। তিনি বলেন, প্লেসমেন্টধারীরা বেশি দামে শেয়ার বিক্রির জন্য কোম্পানিকে তালিকাভুক্তিতে সজাগ থাকে। তালিকাভুক্তির পর বেশি দামে শেয়ার বিক্রি করে বাজার থেকে চলে যায় তারা। কিন্তু দুঃখের বিষয় হচ্ছে, তারা চলে যাওয়ার পর কোম্পানির মুনাফা কমে যায়। উৎপাদন বন্ধ হয়। বাজারে ধ্বস নামে। ভুক্তভোগী হন বিনিয়োগকারীরা। তাই বাজারের স্বার্থে কোনো কোম্পানিকে তালিকাভুক্তির আগে কমিশনকে আরও বেশি সচেতন হওয়া উচিত।
বিএসইসি’র ব্যাখ্যা
শেয়ার বাজারে তালিকাভুক্ত এশিয়াটিক ল্যাবরেটরিজ। অনিয়মের ওপর ভর করে বাজারে আসার সকল প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছিল। সাবক্রিপশন শুরুর কয়েক ঘণ্টা আগে তা বাতিল করেছিল কমিশন। বিধি মেনে ফের তারা বাজারে এসেছে। ক্রাফটসম্যান ফুটওয়্যারও বাজারে আসার পথে। তবে ইতোমধ্যে তাদের ভয়ঙ্কর চিত্র গণমাধ্যমে ফুটে উঠেছে। এ নিয়ে গত ১৭ ফেব্রুয়ারি ঋণ প্রসঙ্গে আংশিক সংবাদ প্রকাশ করেছে একটি বেসরকারি টিভি চ্যানেল। গত ২৭ মার্চ থেকে ধারাবাহিক চিত্র প্রকাশ করছে আপন দেশ ডটকম।
ক্রাফটসম্যান ফুটওয়্যার প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বিএসইসির মুখপাত্র মোহাম্মদ রেজাউল করিম ব্যাখ্যা করেন। তিনি আপন দেশ’কে বলেন, কমিশন ক্রাফটসম্যান ফুটওয়্যারের নথিপত্র দেখে অনুমোদন দিয়েছে। এর বাইরে কোম্পানির অনিয়ম দেখার সক্ষমতা কমিশনের নেই। তবে এসব ব্যাপারে যদি কেউ কোম্পানির অনিয়ম ধরিয়ে দেয়, সেক্ষেত্রে কমিশন কোম্পানিটিকে জবাবদিহীতার আওতায় নিয়ে আসবে। শুনানিতে ডাকবে।
ক্রাফটসম্যান ফুটওয়্যার শেয়ার বাজারে তালিকাভুক্ত করার জন্য প্লেসমেন্ট শেয়ারধারীদের কোনো চাপ বা প্রভাব আছে কিনা প্রশ্নের জবাবে বিএসইসির মুখপাত্র বলেন, কমিশনের উপর চাপ প্রয়োগ করছে কিনা তা এখন পর্যন্ত আমার জানা নেই।
চলবে...
আপন দেশ/টি/এবি/এসএমএ
মন্তব্য করুন # খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, আপন দেশ ডটকম- এর দায়ভার নেবে না।