ফাইল ছবি
দেড়যুগ ধরে রাষ্ট্র ক্ষমতার বাইরে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি)। এরই মধ্যে ক্ষমতাসীন দলের নানামুখি কৌশলের কাছে বারবার ধরাশায়ী হয়েছে। সরকার পতন আন্দোলনের তরী ডুবছে তীরে এসে। যে তরীর যাত্রী সাধারণ কর্মীরা। তারা মারা যাচ্ছেন, পঙ্গু হচ্ছেন, নিঃস্ব হচ্ছে কর্মীর পরিবার। অন্ধকারে কর্মীর প্রজন্মদের ভবিষ্যত। বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটেছে যুব নেতাদের। শুধুই রাজনৈতিক কারণেই চাকরি মেলেনি মেধাবীদের কপালে।
গত ১৮ বছরে বিএনপির হাজারো মধ্যসারির নেতাকর্মী মারা গেছেন। কেন্দ্রীয় নেতাদের গেছে শুধু অর্থ। দীর্ঘ সময়ে রাজনীতি করে, সব খুইয়ে সুবিচার না পেয়ে দলবিমুখ হচ্ছেন তৃণমূল নেতারা। শীর্ষ নেতাকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে হাঁটছেন নিজের পথে। ইতোমধ্যে স্থানীয় সরকার নির্বাচনে অংশ নিচ্ছেন বিএনপির শত শত নেতা। দলের বহিষ্কার চিঠিকে তারা ‘আর্শীবাদ’ হিসেবেই নিচ্ছেন।
কেন এমন হচ্ছে? আপন দেশ-এর প্রশ্নের জবাব দিয়েছেন নব্বইয়ের দাপুটে এক ছাত্রনেতা। নাম প্রকাশ না করার শর্তে তিনি সাফ বলেন, কাল যিনি আমার কর্মী ছিল, আমার আন্ডারে রাজনীতি করতো। নয়াপল্টনের (কেন্দ্রীয় কার্যালয়) আর্শীবাদে আজ সে আমার চেয়ে বড় নেতা। দল করে আমি নিঃস্ব, আর সে (কর্মী) বিত্তশালী ব্যবসায়ী। এলাকায় দলীয় সভা-সমাবেশে আমার সেই কর্মী হচ্ছেন প্রধান অতিথি, আমি তাতে আলোচক। তার গুণকীর্তন গাইতে বলা হয় আমাকে। যৌবন দিলাম, নিঃস্ব হলাম কিন্তু দলের শীর্ষ নেতাদের সুদৃষ্টি পেলাম না। শুধু আমিই নই। বিএনপির শত শত ছাত্রনেতা বা যুবনেতা আজ রাজনৈতিক বেকারে পরিণত হয়েছে। এখন দল থেকে পালানোর পথ খুঁজছেন। নোটিস করে দল টেকানো যায় না, নেতাকর্মী মূল্যায়ন করতে হবে।
আপনার এ কষ্টের কথা শীর্ষ নেতা জানেন? জবাবে ওই নেতা বলেন, শুনেছি ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান সব খবরই রাখেন। তার সঙ্গে আমার যোগাযোগ নেই। তবে দলের স্থায়ী কমিটির একাধিক নেতা, মহাসচিব জানেন। তাদের কাছে মিলেছে দায়সারা জবাব আর সান্তনার বাণী। নয়াপল্টন নাকি এসবের উৎস। নেতাযোগ-বিয়োগ, লেনদেন, পদ কাঁটছাট, স্বজনপ্রীতি, সাধারণ কর্মীকে তিন থেকে ছয় মাসের মধ্যে কেন্দ্রীয় কমিটির সম্পাদকীয় পদ দেয়ার নজির আছে।
দলীয় সূত্রের খবর, নেতাদের কারও কারও নামে প্রায় অর্ধ হাজার মামলা। সপ্তাহখানেক মুক্ত থাকলেও বছর কাটে কারাগারে। মামলার প্যাঁচে পড়ে নিঃস্ব হয়েছেন অনেকেই। নগদ অর্থ থেকে শুরু করে স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তিও খুইয়েছেন। অর্থের অভাবে নিজ সন্তানের লেখাপড়াটা ঠিকমতো হচ্ছে না। ফলে রাজনৈতিক ছায়ার চেয়ে পরিবারের কথা ভাবছেন। নিজের জীবনকে দলের পেছনে উৎসর্গ করলেও ভবিষ্যত প্রজন্মকে রক্ষার নানা কৌশল অবলম্বন করছেন। তারা এখন আর দলের শীর্ষ নেতার আদেশ মানছেন না। কঠোর হুঁশিয়ারিতেও ভীত হচ্ছেন না। অনেকেই দল ছেড়ে নিজ নিজ সিদ্ধান্তের দিকে হাঁটছেন।
আগামী ৮ মে প্রথম ধাপে উপজেলা পরিষদ নির্বাচন। বিএনপি জাতীয় নির্বাচনের মতো স্থানীয় নির্বাচনও বয়কট করছে। নির্বাচনে অংশ না নিতে দলীয় নেতাকর্মীদের প্রতি বিশেষ এবং কঠোর বার্তাও দেয়া হয়েছে।
দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয় সূত্রমতে, আসন্ন উপজেলা নির্বাচনকে কেন্দ্র করে দলীয় লাগাম ছেড়া নেতার সংখ্যা সারাদেশে প্রায় শতাধিক। তারা নির্বাচন অংশ নিচ্ছেন। উপজেলা চেয়ারম্যান, ভাইস চেয়াারম্যান ও মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান পদে লড়ছেন তারা। দলের তরফ থেকে তাদের ধরে রাখার সব ধরনের চেষ্টা করা হয়েছে, এখনো হচ্ছে। কিন্তু তাতে কাজ হচ্ছে না। ফলে দলছুট নেতাদের বহিষ্কারের মতো কঠোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে শীর্ষ নেতা।
শুক্রবার (২৬ এপ্রিল) বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী স্বাক্ষরিত এক বিবৃতিতে জানানো হয়েছে ৭৩ নেতাকে বহিষ্কারের কথা। দলীয় সিদ্ধান্ত অমান্য করে প্রথম ধাপের উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে অংশ নেয়ায় তাদের বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেয়া হলো। এর মধ্যে উপজেলা চেয়ারম্যান প্রার্থী ২৮ জন, ভাইস চেয়ারম্যান প্রার্থী ২৪ জন ও মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান প্রার্থী ২১ জনকে বহিষ্কার করা হয়েছে।
উপজেলা নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ায় দলের নেতাদের কারণ দর্শানোর নোটিস দেয় গত মঙ্গলবার ও বুধবার। সংশ্লিষ্ট প্রার্থীদের নোটিশ পাওয়ার পর ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে হোয়াটসঅ্যাপে কিংবা ফোনে কারণ দেখিয়ে একটি লিখিত জবাব বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান বরাবর নয়াপল্টন দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে পাঠানোর নির্দেশ দেয়া হয়।
বিএনপির হুঁশিয়ারি বার্তাপ্রাপ্ত একাধিক নেতা জানান, বিএনপির দলের গঠনতন্ত্র মোতাবেক দলের সিদ্ধান্ত অমান্যকারী নেতাদের প্রাথমিক সদস্যপদসহ সব পদ থেকে বহিষ্কার করা হবে এমন সতর্ক বার্তা দেয়া হয়। বৃহস্পতিবার (২৫ এপ্রিল) বহিষ্কৃতদের মধ্যে অনেকেই নোটিসের জবাব দিয়েছেন। তাদের জবাব সন্তোষজনক না হওয়ায় তাদের দল থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে। আবার বহিষ্কৃত অনেক নেতা নোটিশের জবাব দেননি।
দল ত্যাগের কৌশল হিসাবে এমন রাস্তা বেছে নিয়েছেন। বিভিন্ন স্তরের নেতার সঙ্গে আলাপকালে এমন তথ্য উঠে এসেছে।
দলের নেতাকর্মীরা কেনো হাইকমান্ডের নির্দেশ মানছেন না এমন প্রশ্নের ধারণাগত ব্যাখ্যা দিয়েছেন বিএনপির এক যুগ্ম মহাসচিব। তিনি এ প্রতিবেদককে বলেন, দলীয় নেতাকর্মীরা যে আদর্শ ত্যাগ করছে তার জন্য শুধুু যে তারাই দায়ী বিষয়টা এমন না। দেড়যুগ ধরে স্রোতের বিপরীতে লড়াই করছেন।
ওই নেতার ভাষ্য, একদিকে সরকার হামলা, মামলা, জেল-জুলুুমের মাধ্যমে জীবনকে বিষিয়ে তুলেছে। অপরদিকে দলের তরফ থেকেও নানাভাবে হতাশাজনক আচরণ, স্বজনপ্রীতি, বঞ্চনার শিকার হচ্ছেন। দীর্ঘ সময়ে রাজপথের ত্যাগী নেতার পদ কেড়ে নেয়া হচ্ছে। সাধারণ সদস্যকে বসানো হচ্ছে দলের গুরুত্বপূর্ণ পদে। আজ যিনি বড় নেতা, নিকট অতীতে তিনি শুধুই কর্মী ছিলেন। নেতাকে তার কর্মীর আন্ডারে ঠেলে দেয়া হচ্ছে। তার মানে নেতাকে ঘরে পাঠানো হচ্ছে।
এ প্রসঙ্গে বিএনপির স্থায়ী কমিটির এক সদস্য বলেন, অসঙ্গতি কিছুটা আছে। বড় দল। সবার প্রত্যাশা পূরণ নাও হতে পারে। বহিষ্কারই শেষ কথা নয়। মন্দ সময় ক্ষণস্থায়ী হয়। শাসক দলও ২২ বছর রাষ্ট্রক্ষমতার বাইরে ছিল। তার আগেই বর্তমানদের বিদায় হবে, যোগ করেন সাবেক এ মন্ত্রী।
আপন দেশ/এবি/এসএমএ
মন্তব্য করুন # খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, আপন দেশ ডটকম- এর দায়ভার নেবে না।