ফাইল ছবি
মাসব্যাপী দেশজুড়ে বয়ে চলে মৃদু থেকে তীব্র তাপপ্রবাহ। চলতি মে মাসে বৃষ্টির দেখা মিলেছে। দেশবাসী তীব্র গরম থেকে রেহাই পেয়েছেন। বৈশাখের ঝড়-বৃষ্টি শুরু হয়েছে। কিন্তু কৃষির বিশেষ করে আম ও লিচুর ফলনের অনেক ক্ষতি হয়ে গেছে এরইমধ্যে। দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে লোভনীয় ফল দুটির গুটি শুকিয়ে গেছে তাপদাহে। ফলে অপরিপক্ব আম-লিচু ঝরে পড়ছে।
এর মাঝে বাড়তি ক্ষতি হয়েছে ঝড় ও শিলাবৃষ্টিতে। এতে করেও আম ও লিচু ঝরে পড়েছে। অনেকে শঙ্কায় অপরিপক্ব আম ও লিচু পেড়ে ফেলছেন। সবমিলিয়ে আম ও লিচুর উদ্দিষ্ট ফলন নিয়ে শঙ্কায় আছেন চাষিরা।
এদিকে, বাগান থেকে শুরু করে পারিবারিক পর্যায়ের বিভিন্ন গাছে যে পরিমাণে আমের মুকুল ও লিচুর গুটি ধরেছে তা বিগত কয়েক বছরের তুলনায় এমনিই অনেক কম। ধারণা করা হচ্ছে, এবার আম ও লিচুর ফলনে বড় রকমের ধস নামতে পারে।
সংশ্লিষ্টদের মত, খরতাপের ফলে বাগান মালিকরা মোটা অঙ্কের লোকসানে পড়বেন বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। বাগান নিয়ে বিপাকে পড়েছেন বাগান মালিক ও ইজারাদাররাও।
বিভিন্ন জেলার বাগান মালিকরা বলছেন, এবার আম ও লিচুর কাঙ্ক্ষিত ফলন মিলবে না। সংশ্লিষ্ট জেলার কৃষি বিভাগ বলছে, প্রকৃতির বিরূপতায় এবার সঠিক ফলন আসবে না। গাছের গোড়া আর গুটিতে পানি দেওয়ার পরামর্শ দিচ্ছেন কৃষি কর্মকর্তারা।
মেহেরপুর, ফরিদপুর, পাবনা, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, নওগাঁ, সাতক্ষীরা, মাগুরা, বগুড়া, রাজশাহী, মেহেরপুর, দিনাজপুর, নরসিংদী, ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে আমাদের প্রতিনিধিরা কৃষকের দুশ্চিন্তার কথা জানান।
সংশ্লিষ্ট চাষিরা বলেন, গরম আবহাওয়ার কারণে যা মুকুল আসছিল সব ঝরে গেছে। এখন বৃষ্টির দেখা পাওয়া গেলেও আগের ক্ষতি পোষানো যাবে না। আর মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘায়ের মতো শিলাবৃষ্টিতেও ফসল বিশেষ করে আম-লিচুর ক্ষতি হচ্ছে; থেঁতলে যাচ্ছে গাছের ফল।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই তাপপ্রবাহ আম-লিচুর সর্বনাশ করেছে। এবার আম-লিচুর উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে ব্যর্থ হতে হবে।
আবহাওয়া অধিদফতর বলছে, গত ৩১ মার্চ দেশে শুরু হয়েছে তাপপ্রবাহ। এরপর থেকে একটানা এতদিন তাপপ্রবাহের ঘটনা ৭৬ বছরে দেখা যায়নি। বলা চলে গনগনে এপ্রিল পার করেছে দেশ।
আম-লিচুর সূতিকাগার বা মূল উৎপাদনের অঞ্চল হিসেবে বরেন্দ্র অঞ্চলকে গণ্য করা হয়। এবারের তাপপ্রবাহে বরেন্দ্র অঞ্চলের ভূমির অবস্থা নাজেহাল। বিশেষ করে পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়ায় পর্যাপ্ত সেচ দিতে পারেননি কৃষকরা। অন্যদিকে, তীব্র গরমে লাগাতার লোডশেডিংয়েও ব্যাহত হয় সেচ কাজ।
নওগাঁর সাপাহার উপজেলার আমচাষি নুরুল ইসলাম আক্ষেপ করে বলেন, এবার আম থেকে মনে হয় না লাভের মুখ দেখব। মুকুল আসার সময় বৃষ্টি হলো। এতে অনেক মুকল ঝরে গেছে। অল্প মুকুলে যে কয়েকটা গুটি এসেছিল তারও বেশিরভাগ ঝরে গেছে গরমে। এখন শিলাবৃষ্টিতে ক্ষতি আরো বাড়ছে।
দিনাজপুরের উলিপুর উপজেলার লিচুচাষি মোজাফফর হোসেন বলেন, বৃষ্টি না হওয়ায় মাটিতে কোনো রস ছিল না। বোঁটা শুকিয়ে যাওয়ায় লিচু ঝরে গেছে। এবার লিচুতে লাভ তো দূরে থাক উৎপাদন খরচই তুলতে পারব বলে মনে হয় না।
মেহেরপুরের চাষিরা বলছেন, প্রাথমিকভাবে আমের মুকুল এসেছিল, গুটিও হয়। তারপর হালকা বৃষ্টি পরবর্তী সময়ে টানা খরা চলমান থাকায় আম ঝরে পড়েছে। যেগুলো টিকে ছিল, সেগুলো তাপপ্রবাহের কারণে আর বড় হয়নি। ফলে মেহেরপুরের বাগানগুলোতে এবার অল্প কিছু আমের ফলন হবে। কিন্তু দাম হবে আকাশছোঁয়া।
সদর উপজেলার আমঝুপি গ্রামের আমচাষি বুলবুল হোসেন বলেন, ঝরে পড়ার পড় যা আছে, তাতে পরিচর্যা খরচ উঠবে না।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের প্রশিক্ষণ কর্মকর্তা সামসুল আলম বলেন, বিকালের দিকে পরিমিত মাত্রায় বোরন স্প্রে করলে ঝরেপড়া রোধ করা সম্ভব।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপ-পরিচালক বিজয় কৃষ্ণ হালদার বলেন, তীব্র তাপের কারণেই আমের গুটি ঝরে গেছে। কৃষি বিভাগের পক্ষ থেকে চাষিদের পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। যেসব বাগানের আম ও লিচুর গুটি ঝরে যাচ্ছে, বিকালের দিকে পরিমিত মাত্রায় বোরন স্প্রে ও গাছের গোড়ায় পানি দিতে হবে। তাহলে গুটি ঝরা রোধ করা যাবে। এ ছাড়া নিয়মিত সেচ দিতে হবে।
সাতক্ষীরার বৃহত্তম আমচাষি ও ব্যবসায়ী কবির হোসেন বলেন, আম্পানের পর থেকে দুই একবার আমের ফলন এসেছে সুষ্ঠু ও স্বাভাবিক। কিন্তু আম্পানে যেমন গাছ পড়ে আম ব্যাবসায়ীদের ক্ষতিগ্রস্ত করেছে; ঠিক তেমনি অতি গরমের কারণে নানা রোগে আক্রান্ত হয়ে ক্ষতির শিকার হয়েছে জেলার আমচাষিরা।
সাতক্ষীরা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপ-পরিচালক সাইফুল ইসলাম বলেন, হিট ওয়েভের ফলে এ জেলায় এবার আমের ফলন বিগত যে কোনো বছরের তুলনায় কম হয়েছে। এমনিতে অব সিজন তার ওপর হিটওয়েভে নষ্ট হয়েছে আমের ফলন। গরমের মধ্যে সকাল থেকে সন্ধ্যার মধ্যে আম গাছে পানি না দেওয়ার যে নির্দেশনা রয়েছে তা আমচাষিরা যথাযথভাবে না মানার কারণে আম নষ্ট হয়েছে। সিদ্ধ বা শুকিয়ে তা নষ্ট হয়েছে। এই হিট ওয়েভে আমগাছে কেবল পানি দেওয়ার উপযুক্ত সময় মধ্যরাত থেকে ভোরের আগে।
পাবনা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপ-পরিচালক ড. জামাল উদ্দিন বলেন, ফল মৌসুমে বিশেষ করে আগাম জাতের লিচু ও আম হয়ে থাকে এ জেলায়। এই বছর বৈরী আবহাওয়ার কারণে ফলনে কিছুটা সমস্যা দেখা দিয়েছে। তবে সেটি কাটিয়ে উঠতে কৃষক ও কৃষি বিভাগ কাজ করছে।
রাজধানীর শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের এগ্রোবোটানি বিভাগের চেয়ারম্যান ইলিয়াস হোসেন বলেন, গত কিছুদিন দেশে যে তাপপ্রবাহ বয়ে চলেছে তা কোনো ফসলের জন্যই ভালো না। বিশেষ করে আমের মুকুলের পুরুষ রেণু এ গরমে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। এতে করে আমের ফলন কম হবে।
ইলিয়াস হোসেন আরও বলেন, যেসব ফসল ফুল বা মুকুলকেন্দ্রিক, তাপপ্রবাহে স্বাভাবিকভাবে সেসব ফসলের ক্ষতি হওয়ার আশঙ্কা থাকে। অনেকে বলেন, তীব্র তাপেও আমের ফলনে ক্ষতি হয় না। এটি ভুল কথা। আমের মুকুলের পোলেন গ্রেইন ৬০ ডিগ্রি সেলসিয়াস অবধি তাপ সহ্য করতে পারলেও, স্টিগমা বেশি তাপে কার্যকর ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে। এতে করে মুকুলোদ্গম হওয়ার সম্ভাবনা কমে আসে।
কৃষি অর্থনীতি বিশ্লেষক রিপন কুমার মণ্ডল বলেন, একমাত্র যারা বাণিজ্যিকভাবে আমের চাষ করেন তারাই রিং পদ্ধতিতে প্রতিনিয়ত সেচের ব্যবস্থা করতে পারেন। তবে দেশে আমের বড় একটি মাধ্যম বাণিজ্য বহির্ভূত। এখানে সেচ নিশ্চিত করা সম্ভব না হওয়ায় আর্দ্রতার অভাবে আম ঝরে পড়ছে।
লিচু প্রসঙ্গে রিপন বলেন, এখন লিচুর ফুল মাত্র পাকতে শুরু করেছে। এ অবস্থায় আর্দ্রতা নিশ্চিত করা না যাওয়ার কারণে হয় ফুলের শিষে পচন ধরছে আর না হলে ঝরে পড়ছে। বিশেষ করে রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, নওগাঁর মতো বরেন্দ্র এলাকায় পানির অভাব থাকায় সেখানে লিচুর ফলন এবার কম হবে বলে শঙ্কা আছে।
আরও পড়ুন <> লিচুর গুটি তাপদাহে শুকিয়ে যাচ্ছে
এবার গ্রীষ্মে ফলন কতটা কমবে জানতে চাইলে রিপন বলেন, এবার বিরূপ তাপমাত্রার কারণে ফলন ২০ শতাংশ কম হবে। আম-লিচুর ফলন এই তাপপ্রবাহের কারণে অনেকটাই কমে আসবে। গত কয়েক বছরে যে পরিমাণে আম-লিচুর ফলন হয়েছিল তাতে করে দেশের রপ্তানির নতুন একটি দ্বার উন্মোচিত হয়েছিল, যা এবার শঙ্কার মুখে পড়বে।
তিনি বলেন, আম-লিচুর মতো ফলে স্বাদ কেমন হবে, তার সঙ্গে আর্দ্রতার সরাসরি সম্পর্ক আছে। বিশেষ করে এবার লিচু যেভাবে আর্দ্রতা সংকটে আছে, তাতে করে ফলের গুণগত মানে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের হর্টিকালচার বিভাগের পরিচালক আব্দুল আউয়াল বলেন, আমের ফলনে তাপপ্রবাহের যতটা না প্রভাব পড়েছে, তার চেয়ে বেশি প্রভাব পড়েছে প্রলম্বিত শীতের কারণে। এবার শীত শেষে হঠাৎ করে তাপমাত্রা কমে যাওয়ার কারণে আমের মুকুলের ব্যাপক ক্ষতি হয়। এতে করে গত বছরের তুলনায় এবার ৪০ শতাংশ আমের ফলন কম হয়েছে। বিশেষ করে ব্যক্তিগত পর্যায়ে যেসব আমের গাছ আছে তাতে এ বছর ফলন নেই বললেই চলে। যে সময়ে কীটনাশক দেওয়ার কথা তখন কীটনাশক প্রয়োগ করে লাভ হয়নি। জলবায়ুর এ হুটহাট পরিবর্তনের কারণে গাছে পোকা আসার সময় পর্যন্ত বদলে গেছে বলে জানান এ কৃষি কর্মকর্তা।
আউয়াল বলেন, এবার বাজারে আমের ফলন কম হওয়ার পাশাপাশি এই ফল পাকতেও অন্যান্য বছরের তুলনায় কমপক্ষে ১৫ দিন দেরি হবে। মে মাসের প্রথম সপ্তাহেই বাজারে সাতক্ষীরার গোবিন্দভোগ আম চলে আসার কথা। তার কয়দিন পরেই আসার কথা গোপালভোগ। এসব আম বাজারে আসতে আসতে মে মাসের মাঝামাঝি সময় চলে আসবে।
ফল গবেষণা কেন্দ্রের (বিএআরআই) প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. শফিকুল ইসলাম বলেন, দীর্ঘস্থায়ী খরা হলে আম-লিচুসহ সব ধরনের ফসলেরই ক্ষতি হয়। এসময় মাটিতে রস না থাকার কারণে আম-লিচুর বোঁটা শুকিয়ে যায়, এতে সেগুলো ঝরে যায়।
বিএআরআইর প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা জানান, কয়েকদিন বৃষ্টির পর যদি আবার খরা হয় তাহলে আম-লিচুর হার্ভেস্টিং পিরিয়ড খাটো হয়ে যায়। অর্থাৎ আম-লিচু একটু আগাম পেকে যায়। এতেও ফলের আকার ছোট হয়।
তিনি বলেন, এখন আম-লিচুর বাড়ন্ত সময়, তাই খরা এমন দীর্ঘ হওয়ায় সেগুলো ঝরে পড়ার প্রবণতা বেড়েছে। অর্থাৎ আম-লিচু যে পরিমাণ ঝরার কথা ছিল তার চেয়ে একটু বেশি ঝরেছে।
শফিকুল ইসলাম বলেন, চাষিরা হতাশ তো হবেনই। কারণ স্বাভাবিকের তুলনায় আম-লিচু তো একটু বেশি ঝরেছে। এটি তো তাদের ক্ষতি।
তিনি বলেন, লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয় গত বছরের উৎপাদনের হিসাব অনুসারে। গত বছর তো আম-লিচুর বাম্পার ফলন হয়েছে। আর এবার তো মুকুলই ঠিকমতো আসেনি। গত বছরের হিসাবে যে হারে মুকুল আসার কথা তার ৬০ শতাংশ মুকুল এসেছে এবার। এতেই লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে একটা চ্যালেঞ্জ এসেছে। তার ওপর এবারের দীর্ঘ তাপদাহেও অনেক আম-লিচু ঝরে গেছে। এটিও লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে আরেকটি চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখা দিয়েছে।
আপন দেশ/এমআর
মন্তব্য করুন # খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, আপন দেশ ডটকম- এর দায়ভার নেবে না।