Apan Desh | আপন দেশ

অস্তিত্ব সঙ্কটে পাবনার ঐতিহ্যবাহী মৃৎশিল্প

আলমগীর হোসাইন (নাবিল)

প্রকাশিত: ১১:৩৯, ১৪ জুলাই ২০২৪

আপডেট: ১২:০৭, ১৪ জুলাই ২০২৪

অস্তিত্ব সঙ্কটে পাবনার ঐতিহ্যবাহী মৃৎশিল্প

ছবি: আপন দেশ

এক সময় মাটির তৈরি তৈজসপত্র, দেবদেবীর মূর্তি ও ঝাঝরের বিকল্প ছিল না। হাতের কাছেই মিলতো হাঁড়ি-পাতিল, থালা-বাসন, ঘটি, মটকা, সরা, চারি, কাসা, কলস, ব্যাংক, প্রদীপ, পুতুল, কলকি। আধুনিকতার ছোঁয়ায় মানুষের রুচির পরিবর্তন ঘটেছে। মাটির তৈরি সামগ্রীর স্থান দখল করে নিয়েছে প্লাস্টিক, মেলামাইন, স্টিল আর অ্যালুমিনিয়ামের তৈরি আধুনিক সামগ্রী। 

তাই মাটির তৈরী জিনিষের বর্তমানে বাজারে চাহিদা কম। কাঁচামালের চড়ামূল্য। পুঁজির অভাব। ফলে এ পেশায় টিকতে পারছেন না ঐতিহ্যবাহী মৃৎশিল্পীরা। এ চিত্র পাবনা চাটমোহর উপজেলার নিমাইচড়া ইউনিয়নের গৌড়িপুর পালপাড়া গ্রামের। তবে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা পেলে ঘুরে দাঁড়াতে পারে এ শিল্প।

মৃৎশিল্পীরা জানান, বর্তমান মানুষের ব্যবহারিক জীবনে মৃৎশিল্পের তেমন আর গুরুত্ব নেই। চলছে প্রযুক্তি বিকাশের যুগ। মৃৎশিল্পের প্রযুক্তিগত উন্নয়ন সাধিত না হওয়ায় এ পেশায় টিকে থাকা দায় হয়ে পড়েছে। বাবা-দাদার পেশা কালের আবর্তে হারানোর পথে। তবে এখনোও টিকিয়ে রাখার চেষ্টায় পাবনা গৌড়িপুর পালপাড়া গ্রামের মৃৎশিল্পীরা।

গৌড়িপুর পালপাড়ায় সরেজমিনে দেখা যায়, ভোরের আলো ফুটতেই মাটির হাঁড়ি পাতিল তৈরি করে রোদে শুকাতে দিচ্ছে কুমাররা। কেউ বা ব্যস্ত সময় পার করছেন বিভিন্ন সামগ্রী তৈরীতে। কেউবা করছেন রং। এভাবেই সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত চলছে তাদের কর্মব্যস্ততা।

পালপাড়ার মায়া রাণী জানান, দীর্ঘ ৫০ বছর ধরে মাটির তৈজসপত্র তৈরী করছেন তিনি। আগে মাটির সামগ্রীর প্রচুর চাহিদা ছিল। এখন আর তেমন কোন চাহিদা নেই। তাই শীত মৌসুমে পিঠাপুলির সামগ্রী তৈরী করেই কোনোমতে চলছে তার সংসার। 
তিনি জানান, এমনিতেই ব্যবসা চলে কম তার উপরে নেই রাস্তাঘাট তাই গৌড়িপুর পালপাড়া থেকে নিমাইচড়া বাজার পর্যন্ত পাকা সড়কের দাবি জানান তিনি।

কাঁচা মাটির পাত্রকে পুড়িয়ে পরিণত করতে ব্যস্ততা দুলাল পালের। এ ব্যস্ততার ফাঁকে তিনি জানান, প্রায় ৪০ বছর ধরে বাবা-দাদার শেখানো পেশায় কাজ করছেন। আগের দিনে বাজারে মৃৎপাত্রের প্রচুর চাহিদা ছিল। এখন অনেকটাই কম। অন্য কোন কাজ না জানায় এ পেশাই আঁকড়ে জীবিকা নির্বাহ করছেন তিনি। 
দুলাল পাল জানান, পেশাগত প্রয়োজনে ব্যাংক ঋণ পাননা তারা। সহজ শর্তে ব্যাংক ঋণ পেলে নতুন করে ঘুরে দাঁড়ানোর স্বপ্ন দেখেন তিনি।

স্থানীয় মৃৎশিল্পীরা মনে করেন, ঐতিহ্যবাহী মৃৎশিল্পকে বাঁচাতে সরকারের বহুমুখী উন্নয়ন কর্মসূচি গ্রহণ করা প্রয়োজন। এ ব্যাপারে বিকাশ পাল, সম্বল পাল, দরদী পাল ও সুবর্ণা পাল জানান, এক সময়ে এ গ্রামে মৃৎশিল্পের রমরমা ব্যবসা ছিল। আগে গৌড়িপুর গ্রামে প্রায় ১১০টি ঘর মৃৎশিল্পের কাজ করতো। কিন্তু বর্তমানে বেশির ভাগ পালরা দেশ ছেড়ে চলে যাওয়ায় এখন ১০-১৫ টি ঘরে প্রায় ৩০-৩৫ জন পাল এ কাজে নিয়োজিত। 

তারা আরও জানান, মৃৎশিল্পের সঙ্গে জড়িতরা সরকারি কোনো সুযোগ-সুবিধা বা প্রণোদনা কোন দিন পেয়েছেন কি না তা জানা নেই। তারা বলেন, এ শিল্পকে টিকিয়ে রাখতে হলে সরকারকে এগিয়ে আসতে হবে। এছাড়াও মৃৎশিল্পীদের শিল্প জ্ঞান এবং অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে যদি আধুনিক করে গড়ে তোলা যায় তা হলেই কেবল গ্রাম-বাংলার ঐতিহ্যবাহী এ মৃৎশিল্পকে বাঁচিয়ে রাখা সম্ভব বলে তারা মনে করেন।


এ ব্যাপারে গোপাল চন্দ্রপাল বলেন, আগের দিনে মৃৎশিল্পের প্রয়োজনীয় উপকরণ যেমন এঁটেল মাটি, রঙ, যন্ত্রপাতি ও জ্বালানি ছিল সহজলভ্য। কিন্তু বর্তমানে এসব প্রয়োজনীয় উপকরণের দাম বেড়ে যাওয়ায় তারা এখন হিমশিম খাচ্ছেন। আগে যেখানে বিনামূল্যে মাটি সংগ্রহ করা যেতো বর্তমানে সে মাটি ১০-১২ হাজার টাকায় কিনতে হয়। আগে খড় কিনতে তাদের কোন টাকা পয়সা লাগতো না, এখন সেই এক আঁটি (বড় সাইজ) খড় ৩০০ টাকায় কিনতে হয়। 
গোপালচন্দ্র পাল বলেন, বর্ষা মৌসুমে তাদের হাতে তেমন কোন কাজ থাকে না। সে সময় বিভিন্ন জায়গা থেকে মাটি সংগ্রহ করে থাকেন। তবে অনেক সময় মাটি কিনতে আইনি জটিলতায় পড়তে হয় তাদের।

বাড়ির উঠোনে পাত্রগুলোতে রং করতে করতে উজ্জ্বল কুমার পাল জানান, সাধারণত মৃৎপাত্রগুলো কুমার পরিবারের নারী-পুরুষ উভয়ে মিলেমিশে তৈরি করে থাকেন। এ তৈরিকৃত সামগ্রী বিভিন্ন এলাকার পাইকাররা এসে কিনেন। অনেকে আবার বাড়ি বাড়ি ফেরি করেও বিক্রি করেন। 
তিনি বলেন, শুধু পাবনা নয়, গোটা দেশে এ পেশায় নেমে এসেছে চরম বিপর্যয়। এ ঐতিহ্যকে ধরে রাখতে কারও যেন কোন মাথাব্যথাই নেই।

প্রার্থনা পাল জানান, আগের দিনে তাদের ব্যবসা অনেক ভালো চলতো বর্তমানে মানুষ প্লাস্টিক, এ্যালুমিনিয়াম ব্যবহার করায় এখন কম চলে। আগে কলসিসহ বিভিন্ন তৈজসপত্র তৈরী করলেও বর্তমানে তা ব্যবহার কম। এখন শুধু ঝাঁঝর, কাসা, হাঁড়ি পাতিল তৈরী করেন তারা।

বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশন (বিসিক) পাবনার উপ-মহাব্যবস্থাপক রফিকুল ইসলাম বলেন, অধিকাংশ ক্ষুদ্র কুটির শিল্পের এখন দুর্দিন চলছে। বিশেষ করে মৃৎশিল্প অনেকটাই হারিয়ে যেতে বসেছে। যেটি কোনোভাবেই আমাদের কাম্য নয়। এ শিল্প বাঁচিয়ে রাখতে আমরা কারিগরদের সঙ্গে ছিলাম এবং থাকব। তাদের অর্থনৈতিকভাবে সহায়তার ক্ষেত্রে সহজ শর্তে ঋণ ব্যবস্থা রয়েছে। তারা যোগাযোগ করলে আমরা অবশ্যই সহায়তা দেব। এছাড়া স্থানীয় কোনো আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে ঋণ নিতে চাইলে সেব্যাপারেও আমরা সহযোগিতা করব।

আপন দেশ/এবি

মন্তব্য করুন # খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, আপন দেশ ডটকম- এর দায়ভার নেবে না।

শেয়ার করুনঃ

সর্বশেষ

জনপ্রিয়