আবদুল মালেক ও নাবিলা তাবাসসুম মিকি
বিসিএস ক্যাডার। আলোচনা উঠলেই সামনে আসে ‘আবেদ ক্যাডার’। গাড়ী চালক আবেদ আলীর প্রশ্নপত্র পেয়ে পরীক্ষায় অংশ নিতে হতো। কিন্তু এর চেয়ে ভয়ঙ্কর ক্যাডারের খোজ মিলেছে। ‘উত্তরাধিকার ক্যাডার’। পরীক্ষা না দিয়েই বিসিএস ক্যাডার। ওই ক্যাডারধারীর নাম নাবিলা তাবাসসুম মিকি! মিকির বাবা ১৯৮৪’র প্রশাসন ক্যাডার। আলোচিত মিকি নাম এখন জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদফতরের পিয়ন-পেয়াদারও মুখেমুখে। তিনি জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদফতরের নির্বাহী প্রকৌশলী।
আলোচিত মিকির বাবা ড. আবদুল মালেক ছিলেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার একান্ত সচিব। এরপর তথ্য সচিব। অবসরের মাস পার না হতেই তাকে চুক্তিভিত্তিক চেয়ার দিয়েছিলেন প্রধান তথ্য কমিশনারর হিসেবে। ইতোমধ্যে তার চুক্তি বাতিল করেছে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বতী সরকার।
অভিযোগ রয়েছে, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সেই প্রভাবশালী বাবার কোটায় ক্যাডার হয়েছেন মেয়ে মিকি। আর ড. মালেক স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের সচিব থাকায় মেয়েকে বসিয়েছিলেন জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদফতরের গুরুত্বপূর্ণ পদে। বড় কর্তা হলেও খুব বেশি অফিসে পা ফেলেননি। প্রশিক্ষণ বা সেমিনারেও ছিলেন গরহাজির।
বাংলাদেশ পাবলিক সার্ভিস কমিশনের অধীনে ২০০ নাম্বারের লিখিত (বাংলা, ইংরাজী, সাধারণ জ্ঞান এবং গণিত) পরীক্ষায় অংশ নেয় মিকি। ১০০ নম্বরের মৌখিক পরীক্ষা দিয়ে ২০১৩ সালের ৩ এপ্রিল নাবিলা তাবাসসুম মিকিসহ ৪৪ জন নন-ক্যাডার পদে জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদফতরে সহকারী প্রকৌশলী হিসাবে যোগদান করেন। ওই সময় মিকির বাবা আব্দুল মালেক দাপুটে কর্মকর্তা ছিলেন প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের।
২০২২ সালের ৮ মে ৪৬.০০.০০০০.০৮৩.১৯.০০১.১৭-১৯৬ নং স্মারকে পানি সরবরাহ, স্যানিটেশন ও স্বাস্থ্য শিক্ষা সমাপ্ত প্রকল্পের উপ-প্রকল্প পরিচালক (চ:দা:) পদ হতে ৩২টি পৌর সভার পানি সরবরাহ ও মানব বর্জ্য ব্যবস্থাপনাসহ এনভায়রনমেন্টাল প্রকল্পে নির্বাহী প্রকৌশলী (চ:দা:) পদে পদায়ন লাভ করেন। ওই বছরের ২৫ অক্টোবর ৪৬.০০.০০০০.০৮৩.১৯.০০১.১৭-৬৬২ নং স্মারকে জরিপ অনুসন্ধান ও গবেষণা বিভাগে নির্বাহী প্রকৌশলী (চ:দা:) পদে তিনি বদলি হন।
আরও পড়ুন<> দৈনিক দেড়টাকা বেতনের ব্যাটারি লোকমান এখন হাজার কোটি টাকার মালিক
২০১৫ সালে ড. আবদুল মালেক স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ে পদায়ন লাভ করেন। বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিস নিয়োগবিধি, ১৯৮১ সংশোধন ছাড়াই ২০১৯ সালের ২২ জানুয়ারী স্বজনপ্রীতির মাধ্যমে কন্যা নাবিলা তাবাসসুম মিকিসহ ৯৫ জন কর্মকর্তাকে রাজস্ব বাজেটে যোগদানের তারিখ থেকে ক্যাডারভুক্তির প্রজ্ঞাপন জারি করেন। নিয়ম ভেঙ্গে জারি করা প্রজ্ঞাপনের বিরুদ্ধে হাইকোর্ট ডিভিশনে রিট করে সংক্ষুব্ধরা। হাইকোর্ট ডিভিশনে রিটের প্রেক্ষিতে ২০১৯ সালের ৯ জুন এক আদেশে ২০১৯ সালের ২২ জানুয়ারীর জারিকরা প্রজ্ঞাপনটি স্থানীয় সরকার বিভাগ বাতিল করে। ২০২২ সালের ১৫ জুন স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় ক্যাডার ভূক্তির প্রজ্ঞাপনের মতো একই রকম পৃথক প্রজ্ঞাপন জারি করে নাবিলা তাবাসসুম মিকিসহ ৯০ জন কর্মকর্তাকে বিসিএস (জনস্বাস্থ্য) ক্যাডারভুক্ত করা হয়।
নাবিলা তাবাসসুম মিকি চাকরিতে যোগদানের পর থেকে অফিস, প্রশিক্ষণ বা কোন সেমিনারে অংশ না নিলেও তার বিরুদ্ধে মুখ খোলার কেউ সাহস পেতনা। জনঅভূত্থানে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর নিজেকে নিরাপদ রাখতেই দ্রুত শিক্ষা ছুটি গ্রহণ করেন মিকি।
গত ২২ আগস্ট যথাযথ কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে স্থানীয় সরকার বিভাগের সচিব বরাবর শিক্ষা ছুটির আবেদন করেন নাবিলা তাবাসসুম মিকি। পড়তে যাবেন কানাডিয়ান ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ নামক একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে। ছটি লাগবে ১ বছর ৮ মাস। চলতি বছরের ২৫ আগস্ট ২০২৬ সালের ২৪ এপ্রিল নাগাদ। ২২ আগস্ট আবেদনের প্রেক্ষিতে নাবিলা তাবাসসুম মিকির শিক্ষা ছুটি মঞ্জুরের অনুরোধ করে আবেদনে সুপারিশ করেন জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদফতরের প্রধান প্রকৌশলী তুষার মোহনসাধু খাঁ। যার স্মারক নং ৪৬.০৩.০০০০.০০১.১২.৬২৭.১২-৯৫২।
আরও পড়ুন<> জয়েন্ট স্টকে হারুনের দুর্নীতি, ফাইলবন্দি একযুগ
মিকির আবেদন ও প্রধান প্রকৌশলীর অনুরোধপত্রে অধ্যয়নের ব্যয়ভার নিজে বহন করবেন মর্মে উল্লেখ করা হয়। অথচ, ‘জনপ্রশাসন প্রশিক্ষণ ও উচ্চ শিক্ষা নীতিমালা ২০২৩’ অনুযায়ী উচ্চ শিক্ষা সম্পন্ন করার লক্ষ্যে পূর্ণবৃত্তিপ্রাপ্ত হলে বৃত্তিপ্রাপ্ত মেয়াদের জন্য প্রেষণ মঞ্জুর করা হয়। প্রেষণে থাকলে পূর্ণবেতন- ভাতা পাওয়া যায় কিন্তু শিক্ষা ছুটিতে কেবলমাত্র মূল বেতন পাওয়া যায়।
কে এই আব্দুল মালেক?
‘বিসিএস’ ক্যাডার মিকির বাবা বিসিএস ক্যাডার ড. আব্দুল মালেক। জন্ম পটুয়াখালী জেলার বাউফল উপজেলার সাবুপুরা গ্রামে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের লোক প্রশাসন বিভাগ থেকে বিএসএসসহ (অনার্স) এমএসএস ডিগ্রী অর্জন করেন। ১৯৮৬ সালের জানুয়ারিতে কর্মজীবন শুরু করেন। বগুড়া জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে সহকারী কমিশনার ও ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে যোগদানের মাধ্যমে তার কর্মজীবন শুরু। এর পরে একই পদে সিরাজগঞ্জ জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে, উপজেলা ম্যাজিস্ট্রেট পদে শাহজাদপুর, সিরাজগঞ্জ সদর ও দূর্গাপুর (রাজশাহী) এবং সিনিয়র সহকারি কমিশনার পদে রাজশাহী, জামালপুরে দায়িত্ব পালন করেন। উপজেলা নির্বাহী অফিসার হিসেবে ময়মনসিংহ জেলার ধোবাউড়া ও রংপুর সদর এবং পরে ঢাকা মহানগরীর মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে কর্মরত ছিলেন। দুর্নীতি দমন ব্যুরোর উপ-পরিচালক ও জেলা পরিষদ সচিব, মাগুরা পদে তিনি প্রেষণে দায়িত্ব পালন করেন। সংস্থাপন মন্ত্রণালয়, খুলনা জেলার অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক, ভূমি রেকর্ড জরিপ অধিদফতরে তিনি কাজ করেছেন। উপসচিব হিসেবে শ্রম মন্ত্রণালয় এবং ভূমি মন্ত্রণালয়ে, পরে কুমিল্লার জেলা প্রশাসক ও জেলা ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে দায়িত্ব পালন শেষে স্থানীয় সরকার বিভাগের যুগ্ম-সচিব, অতিরিক্ত সচিব পদে কর্মরত ছিলেন।
এর পরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার একান্ত সচিব-১ পদে দায়িত্ব পালন করেন। তিনি স্থানীয় সরকার বিভাগ সচিব এবং তথ্য সচিব পদে কর্মরত থেকে ২০১৯ সালের ৩০ ডিসেম্বর অবসরে যান। অবসরের মাত্র ১ মাসের মাথায় ২০২০ সালের ৩০ জানুয়ারী তাকে তথ্য কমিশনার (সিনিয়র সচিব) হিসাবে চুক্তি ভিত্তিক নিয়োগ দেয়া হয়। ২০২৩ সালের ২১ মার্চ পর্যন্ত তিনি তথ্য কমিশনার (সিনিয়র সচিব) হিসাবে কর্মরত থাকার পর ২২ মার্চ প্রধান তথ্য কমিশনার হিসাবে যোগদান করেন।
ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বতী সরকার দায়িত্ব গত ৮ আগস্ট নেয়ার পর চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ বাতিল করছে। মন্ত্রণালয়সূত্রের খবর সকল চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ বাতিল করা হবে।
আপন দেশ/এবি
মন্তব্য করুন # খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, আপন দেশ ডটকম- এর দায়ভার নেবে না।