Apan Desh | আপন দেশ

রাষ্ট্রায়ত্ত অগ্রণী ব্যাংক এখনো স্বাধীন হয়নি! পদোন্নতি মিলে তার ইশারায়

আফজাল বারী

প্রকাশিত: ০০:২৪, ৩ নভেম্বর ২০২৪

আপডেট: ১৬:১২, ৪ নভেম্বর ২০২৪

রাষ্ট্রায়ত্ত অগ্রণী ব্যাংক এখনো স্বাধীন হয়নি! পদোন্নতি মিলে তার ইশারায়

অগ্রণী ব্যাংক পিএলসির লোগো ও মোহাম্মদ শামস-উল ইসলাম। ফাইল ছবি

জেনারেশন-জেড-এর রক্তে দেশ দ্বিতীয়বার স্বাধীন হয়েছে। কিন্তু এখনো স্বাধীন হয়নি রাষ্ট্রায়ত্ত অগ্রণী ব্যাংক। দু’বছর আগে অবসরে যাওয়া একজন এমডির ইচ্ছার প্রতিফলন ঘটছে ব্যাংকটিতে। তার রেখে যাওয়া এমডির চেয়ারে কে বসবেন। ডিএমডি হবেন কে। পদোন্নতির চিঠি যাবে কার হাতে। বঞ্চিতের বার্তা পাবেন কে। আবার মেধারগুণে কারো পদোন্নতি হয়েই গেলে তা কিভাবে ঠেকাতে হবে-এ সিদ্ধান্ত এখনো আসছে তার কাছ থেকেই।

রীতিমতো দরবেশের ভূমিকায় সাবেক ওই সিইও। ‘বঙ্গবন্ধু কর্নার’ স্থাপনের আইডিয়া দিয়ে স্বৈরশাসক শেখ হাসিনার দোসর বনে যান এই ব্যাংকার। এরপর শ্বৈন শ্বৈন করে উচ্চে উঠে তার প্রভাবের পারদ। দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন অন্য ব্যাংকের সিদ্ধান্তের বেলাতেও। পালিয়েছেন শেখ হাসিনা কিন্তু সেই ব্যাংকপাড়ার দরবেশ তো দূরের কথা তার হুকুম, আহকাম, মুরিদের গায়ে আঁচড় লাগেনি। বহুমাত্রিক গুণের অধিকারী সেই ব্যাংকারের নাম  মোহাম্মদ শামস-উল ইসলাম।

২০২২ সালের ২৬ আগস্ট কাগুজে অবসরে যান মোহাম্মদ শামস-উল ইসলাম। বঙ্গবন্ধু কর্নারের উদ্ভাবক পরিচয় দিয়ে আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে ব্যাংক খাতে দাপিয়ে বেড়িয়েছেন শামস-উল ইসলাম। রাজনৈতিক সখ্যতার কারণে আর্থিক খাতের দুর্বৃত্তরাও হাজিরা দিয়েছেন শামস-উল ইসলামের ‘দরবারে। বেসুমার সুবিধা নিয়েছে, বেপরোয়া ঋণ নিয়েছে ব্যাংকটি থেকে। পাশাপাশি অগ্রণী ব্যাংকের নেতৃত্বে বড় বড় সিন্ডিকেটেড ঋণ নিয়েছে শিল্পগোষ্ঠীগুলো, যেখানে বাকি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলো অর্থায়ন করেছে। এ ঋণগুলো এখন আর্থিক খাতের গলার কাটায় পরিণত হয়েছে। 

দেশের ব্যাংক খাত যেমন গত দুই বছরের বেশি সময়েও শামস-উল ইসলামের অনিয়মের ক্ষত সারিয়ে উঠতে পারেনি, ঠিক তেমনি শামস-উল ইসলামের নিয়ন্ত্রণেরও বাইরে যেতে পারেনি। তিনি অবসরে গেলেও সাবেক চেয়ারম্যান ড. জায়েদ বখতের মাধ্যমে অগ্রণী ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণ নিজের হাতে রেখেছিলেন। চেয়ারম্যানকে দিয়ে নীতিমালা পরিবর্তন করে নিজের পছন্দের লোকদের পদোন্নতি নিশ্চিত করেছেন। যদিও এ সময়ে ব্যাংকটির এমডি ছিলেন মুরশেদুল কবির। জুলাই বিপ্লবে সরকার পতনের পর পদ হারিয়েছেন জায়েদ বখত ও মুরশেদুল কবির। 

আরও পড়ুন<<>> বাংলাদেশ ব্যাংকের তিন কার্যালয় ছিল এস আলমের!

এদিকে আওয়ামী লীগ সরকার পতনের প্রায় ৩ মাস হয়ে গেলেও ব্যাংকটিতে নিয়ন্ত্রণ খর্ব হয়নি শামস-উল ইসলামের। যা বিস্মিত করেছে খাত সংশ্লিষ্টদের। সম্প্রতি ব্যাংকটির এমডি পদে তিনি সুকৌশলে নিজের পছন্দের লোককে নিয়ে এসেছেন। নির্ভরযোগ্য সূত্রগুলো বিষয়টি নিশ্চিত করেছে। জানা গেছে, আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের একজন প্রভাবশালী অতিরিক্ত সচিবকে দিয়ে ব্যাংক খাতে এখনও ছড়ি ঘুড়াচ্ছেন শামস-উল ইসলাম। 

অন্তর্বর্তী সরকার ২১ অক্টোবর মো. আনোয়ারুল ইসলামকে এমডি পদে নিয়োগ দিয়েছে। অগ্রণী ব্যাংকের সাবেক এ ডিএমডি শামস-উল ইসলাম ও ড. জায়েদ বখতের অধিকাংশ আনিয়মের সহযোগী বলে বহুল কথিত। এর প্রমাণও মিলেছে সম্প্রতি। আনোয়ারুল ইসলামের অনিয়মের বিষয়ে একাধিক গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশ হলে এগুলো বন্ধ করার জন্য শামস-উল ইসলামকে তদবির করতে দেখা গেছে। 

পদোন্নতিতে অনিয়ম  
সীমাহীন দুর্নীতির মাধ্যমে সম্প্রতি অগ্রণী ব্যাংকে সহকারী মহাব্যবস্থাপক থেকে উপ-মহাব্যবস্থাপক পদে পদোন্নতি দেয়া হয়েছে। ব্যাংকটির সাবেক এমডি শামস-উল ইসলামের পরামর্শ ও পরোক্ষ সহযোগিতায় সাবেক চেয়ারম্যান জায়েদ বখত উদ্যোগ নিয়ে এ প্রশ্নবিদ্ধ পদোন্নতির ব্যবস্থা করেছেন। এরা দুজনেই বিগত সরকারের আস্থাভাজন ছিলেন। জায়েদ বখত দীর্ঘ ৯ বছর ব্যাংকটির চেয়ারম্যান পদে ছিলেন। আর শামস-উল ইসলাম এমডি পদে ছিলেন ৬ বছর। 

অগ্রণী ব্যাংকের একটি অভ্যন্তরীণ সূত্র জানিয়েছে, ২০২৩ সালকে ভিত্তি ধরে ২০২৪ সালে সহকারী মহাব্যবস্থাপক হতে উপ-মহাব্যবস্থাপক পদে পদোন্নতি প্রদান করা হয়েছে। এ পদোন্নতিতে আর্থিক লেনদেনের সুযোগ তৈরি করা হয়েছে সুকৌশলে। সুযোগ তৈরি করা হয়েছে নিজেদের পছন্দের লোকদের পদোন্নতি দেয়ার। এজন্য চলতি বছরের শুরুতেই পদোন্নতির নীতিমালায় কিছু পরিবর্তন আনে অগ্রণী ব্যাংকের বোর্ড। শামস-উল ইসলামের পরামর্শে এ নীতিমালা পরিবর্তনে উদ্যোগী হয়েছিলেন সাবেক চেয়ারম্যান জায়েদ বখত। এসময় মুরশেদুল কবির এমডি পদে থাকলেও এ প্রক্রিয়া আটকে দিতে পারেননি, এমনকি প্রতিবাদও করতে পারেননি। ব্যাংকটির শীর্ষ পর্যায়ের একাধিক কর্মকর্তা এসব তথ্য নিশ্চিত করেছেন। 
অগ্রণী ব্যাংকের নিয়োগ কিংবা পদোন্নতি, সবই পরিচালিত হয় ‘কর্মচারি চাকুরি প্রবিধানমালা-২০০৮’-এর আলোকে। এ প্রবিধানমালার ৬ষ্ঠ পৃষ্ঠায় বলা আছে, পদোন্নতি জ্যেষ্ঠতা, মেধা এবং কার্যসম্পাদনের ভিত্তিতে দেয়া হবে। শুধু জ্যেষ্ঠতার ভিত্তিতে কেউ পদোন্নতি দাবি করতে পারবেন না। 
এ প্রবিধানমালার আলোকেই পদোন্নতির নীতিমালা তৈরি করে ব্যাংকটির পরিচালনা পর্ষদ। ২০২৩ সালের পদোন্নতির নীতিমালাও কর্মচারি চাকুরি প্রবিধানমালার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ ছিল। কিন্তু ২০২৪ সালের ৬ মে জারিকৃত পদোন্নতির নীতিমালায় উল্লেখিত ধারাগুলো তুলে দেয় ব্যাংকটির পর্ষদ। এ পরিবর্তিত নীতিমালার মাধ্যমে শুধু জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তাদের একতরফাভাবে পদোন্নতি দেয়া হয়, যা ব্যাংকটির প্রবিধানমালার স্পষ্ট লঙ্ঘন। এর মাধ্যমে মেধাবি ও কর্মদক্ষ জনবল পদোন্নতি থেকে বঞ্চিত হয়। 

অনুসন্ধানে জানা গেছে, প্রবিধানমালার আলোকে পূর্বে ব্যাংকটিতে মেধা ও কর্মদক্ষতার ভিত্তিতে ৭০ শতাংশ এবং জ্যেষ্ঠতার ভিত্তিতে ৩০ শতাংশ পদোন্নতি দেয়া হতো। এছাড়া এসাইনমেন্ট, কম্পিউটার দক্ষতা পরীক্ষা এবং মৌখিক পরীক্ষায় পৃথকভাবে কৃতকার্য হওয়ার নিয়ম ছিল। কিন্তু বর্তমান পদোন্নতির নীতিমালায় প্রাপ্ত নম্বরের গড়ের ওপর ভিত্তি করে কৃতকার্য হওয়ার নিয়ম রাখা হয়েছে। পছন্দের ব্যক্তির পদোন্নতি নিশ্চিত করার লক্ষ্যেই এ পরিবর্তন আনা হয়েছে। নতুন নিয়মে কম্পিউটার টেস্ট বা এসাইনমেন্টে কেউ খারাপ করলেও মৌখিক পরীক্ষায় নিজেদের পছন্দের প্রার্থীকে বেশি নম্বর প্রদান করে তাকে পদোন্নতি প্রদান করা সহজ হয়। এর কারণ হিসেবে জানা গেছে, কম্পিউটার টেস্ট বা এসাইনমেন্টের জালিয়াতি নিরূপণ করা সম্ভব। কিন্তু মৌখিক পরীক্ষার জালিয়াতি নিরূপণ করা সম্ভব নয়। 

পদোন্নতি নীতিমালায় পরিবর্তন এনে মেধা ও কর্মদক্ষতাকে মূল্যায়নে না নিয়ে শুধু জ্যেষ্ঠতার ভিত্তিতে গত ১৩ জুন পদোন্নতি দেয়া হয় ১৯ কর্মকর্তাকে। সহকারী মহাব্যবস্থাপক (এজিএম) থেকে উপমহাব্যবস্থাপক (ডিজিএম) হন তারা। 
জানা গেছে, পদোন্নতির জন্য পরীক্ষায় ডাকা হয়েছিল ১২৭ জন কর্মকর্তাকে। শুরুতে ১ম থেকে ৩৮তম ক্রমের মধ্য থেকে ১৯ জনকে পদোন্নতি দিয়েছে ব্যাংকটি। এরপর বাকিদের থেকে নিজেদের পছন্দের লোকদের প্রতিমাসেই পদোন্নতি দিয়েছে, এমন তথ্য পাওয়া গেছে। 

পদোন্নতি পাওয়া ১৯ কর্মকর্তার মধ্যে ৮ নম্বরে রয়েছেন ডা. ইন্দিরা চৌধুরী। সোর্স জানিয়েছে, বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে এ কর্মকর্তা সরাসরি প্রিন্সিপাল অফিসার হিসাবে নিয়োগ পেয়েছিলেন। এ নিয়োগো কর্মচারি নিয়োগ প্রবিধানমালা সরাসরি ভঙ্গ করা হয়। এ ধরনের নিয়োগে একটি নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি দেয়া হয়। প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার মাধ্যমে অনেক পরীক্ষার্থীর অংশগ্রহণের মাধ্যমে নির্দিষ্ট সংখ্যক প্রার্থীকে নিয়োগ দেয়ার নিয়ম রয়েছে। তবে এগুলোর কোনোকিছুই অনুসরণ না করে ইন্দিরা চৌধুরীকে নিয়োগ দেয়া হয়েছিল। বিগত সরকারের সময়ে তিনটি পদোন্নতি পেয়ে তিনি ডিজিএম হয়েছেন। 

আরও পড়ুন<<>> বিতর্কিত দুই ডেপুটি গভর্নরের কারিশমা, ঝুঁকিতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক

এদিকে অপেক্ষমান তালিকা থেকে পদোন্নতি দেয়া হয়েছে সেন্ট্রাল একাউন্টস ডিভিশনের বর্তমান ডিজিএম ওমর ফারুককে। আগে তিনি এ বিভাগের এজিএম পদে ছিলেন। ওমর ফারুক সিঙ্গাপুর এক্সচেঞ্জ হাউসে থাকাকালে সাবেক চেয়ারম্যান জায়েদ বখত ও সাবেক এমডি শামস-উল ইসলামের অর্থ পাচারে সহযোগিতা করেছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। পরবর্তীতে নারীঘটিত কেলেংকারির কারণে সিঙ্গাপুর থেকে দেশে ফিরিয়ে আনতে বাধ্য হয়েছিল ব্যাংক কর্তৃপক্ষ। পরবর্তীতে তাকে প্রধান কার্যালয়ের কেন্দ্রীয় হিসাব বিভাগে পদায়ন করা হয়। এসময় থেকে তিনি শামস-উল ইসলাম ও জায়েদ বখতের শেয়ারবাজারের ব্যবসা দেখভাল করতেন বলে জানা গেছে। 
এদিকে পদোন্নতির জন্য অপেক্ষমান তালিকায় রয়েছে জায়েদ বখত ও শামস-উল ইসলামের আরেক সহযোগী শারমিন আখতারের নাম। তিনি ব্যাংকটির গুলশান এজিএম হিসেবে কর্মরত। গুলশান শাখার মাধ্যমে শামস-উল ইসলামের অনিয়মের ঋণগুলো বের করতে এ ব্যাংক কর্মকর্তা সহযোগিতা করেছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। এছাড়া সাবেক চেয়ারম্যান ও এমডির অনিয়মের সহযোগী শহীনূর বেগম ও মশিউল ইসলাম পদোন্নতির অপেক্ষায় রয়েছেন। মশিউল ইসলাম শিল্পঋণ বিভাগের এজিএম হিসেবে কর্মরত থাকা অবস্থায় দুর্নীতির কারণে খুলনায় বদলি হয়েছিলেন সূত্র জানিয়েছে। 

এদিকে একটি হিসাবে দেখা গেছে, পদোন্নতির জন্য যে ১২৭ জন পরীক্ষা দিয়েছিলেন তাদের মধ্যে হিন্দু ধর্মাবলম্বি ছিলেন ১২ শতাংশ। কিন্তু এ তালিকা থেকে এখন পর্যন্ত পদোন্নতি পাওয়া ২৬ কর্মকর্তার মধ্যে হিন্দু ধর্মাবলম্বি ৩৭ শতাংশ। জানা গেছে, অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের একজন প্রভাবশালী কর্মকর্তা স্ব-ধর্মের এই কর্মকর্তাদের পদোন্নতি দেয়ার জন্য ব্যাংককে চাপ দিয়েছিলেন। এ কর্মকর্তাকে দিয়েই শামস-উল ইসলাম তার পছন্দের ব্যাংকার আনোয়ারুল ইসলামকে এমডি বানিয়েছেন। 

প্রভাব বিস্তারের মাধ্যমে অগ্রণী ব্যাংকের পদোন্নতিতে অনিয়মের সঙ্গে জড়িত থাকার প্রসঙ্গে জানতে সাবেক এমডি মোহাম্মদ শামস-উল ইসলামের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তার বক্তব্য পাওয়া যায়নি। তবে ব্যাংকটির সাবেক চেয়ারম্যান ড. জায়েদ বখত বলেছেন, এসব অনিয়মের সঙ্গে আমি জড়িত ছিলাম না। উল্টো পদোন্নতির ক্ষেত্রে হওয়া অনিয়মগুলো পুরোপুরি বন্ধ করতে আমি সক্ষম হয়েছিলাম।

আপন দেশ/এবি

মন্তব্য করুন # খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, আপন দেশ ডটকম- এর দায়ভার নেবে না।

শেয়ার করুনঃ

সর্বশেষ

জনপ্রিয়