Apan Desh | আপন দেশ

ভয়ঙ্কর এনাম-শিশির দম্পতি: হুণ্ডি, পাচার-সম্পদের তালাশে দুদক

বিশেষ প্রতিবেদক

প্রকাশিত: ২৩:০৫, ৭ নভেম্বর ২০২৪

আপডেট: ১২:২৪, ১১ নভেম্বর ২০২৪

ভয়ঙ্কর এনাম-শিশির দম্পতি: হুণ্ডি, পাচার-সম্পদের তালাশে দুদক

এনাম আহমেদ চৌধুরী। ছবি: সংগৃহীত

এনাম আহমেদ চৌধুরী। তার সহধর্মীনি শিশির রহমান। জনশক্তি রফতানির জন্য করেছেন ‘নোমান এসোসিয়েটস লি:’ (আর.এল-৮৫৪), ‘স্মার্ট কেয়ার করপোরেশন’ এবং ‘এনাম ট্যুরস অ্যান্ড ট্রাভেলস’সহ একাধিক প্রতিষ্ঠান। এসব প্রতিষ্ঠানে তেমন কোনো কাজকর্ম নেই তবে এর অন্তরালে হুণ্ডি ব্যবসা ও অর্থ পাচার কাণ্ড। অবৈধ ব্যবসায় মেতে দু’য়ে মিলে গড়ে তোলেছেন তুলেছেন ভয়ঙ্কর রাজ্য।

ব্যাংকের বিকল্প হিসেবে ব্যবহার করছেন ‘নিজস্ব চ্যানেল’। এতে সরকার হারাচ্ছে রাজস্ব। চুপিসারে নয় প্রশাসনের নাকের ডগায় চলছে এহেন অপকর্ম। তাতে আশির্বাদ ছিল আওয়ামী লীগের পলাতক সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের, সাবেক এমপি ডা. এইচবিএম ইকবাল, বিতর্কিত ব্যবসায়ি নূর আলীর মতো রাঘব-বোয়ালদের। প্রশাসনের বাইরেও স্থানীয়ভাবে সৃষ্ট প্রতিবাদ ঠেকাতে লাঠিয়ালবাহিনীও আছে এ চৌধুরীর। নিজ কর্মচারিকে জিম্মি করে ফ্ল্যাট নিজের নামে লিখে নিয়েছেন, এফডিআর ভেঙ্গে সে টাকা নিয়েছেন নিজের অ্যাকাউন্টে। হুণ্ডির টাকা নিরাপদ লেনদেনে ডা. ইকবালের মালিকানাধীন প্রিমিয়ার ব্যাংকে হিসাব খুলেন এনাম চৌধুরী। লম্বাহাতি এ দম্পতির ‘রাজ্য’র খোঁজে মাঠে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, অস্বাভাবিক লেনদেনের অভিযোগে বাংলাদেশ ব্যাংকের আর্থিক গোয়েন্দা ইউনিট (বিএফআইইউ) এ দুই জনের ব্যক্তিগত এবং প্রতিষ্ঠানের ব্যাংক হিসাবের ওপর কড়া নজরদারি রাখছিলো। বিষয়টি ‘খতিয়ে দেখা’র জন্য কিছুদিন আগে এ বিষয়ক একটি প্রতিবেদন দুদকে পাঠায়। সে প্রতিবেদনের আলোকে দুদক এনাম আহমেদ চৌধুরী ও তার স্ত্রী শিশির রহমানের বিষয়ে গোপন অনুসন্ধান অনুমোদন করেন। এরপর কমিশনের মানিলন্ডারিং বিভাগ একজন পরিচালকের (সহকারি) নেতৃত্বে একটি টিম গঠন করে। গঠিত শক্তিশালী টিম সদস্যরা নেমেছে এনাম দম্পতির অবৈধ সম্পদের খোঁজে।

দুদকের একই সূত্র বলছে, বিএফআইইউ তাদের প্রতিবেদনে এনাম-শিশির দম্পতির ব্যক্তিগত এবং প্রতিষ্ঠানের নামে পরিচালিত ব্যাংক হিসাব নম্বর উল্লেখ করে এসবে বিভিন্ন সময় সম্পাদিত লেনদেনের তথ্য দেয়। হিসাবগুলোর হলো-

(1)Noman Associates Ltd. Account Number: 104 111 0008 2318 Primier Bank PLC, Branch: Banani

(2) Noman Associates Ltd. Account Number: 2045067510002 Brac Bank PLC, Branch: Banani,

(3) Noman Associates Ltd, Account Number: 150 720 450 675 1001 (Closed), Brac Bank PLC, Branch: Banani

(4) Enam Ahmed Chowdhury RFCD –USD Account Number: 104 157 000 03713 Primer Bank PLC, Branch: Banani

(5) Enam Tours & Travles, Account Number: 150 720 422 497 2001 (Closed), Brac Bank PLC, Branch: Banani

(6) Enam Tours & Travles, Account Number: 026 33 100881 (Closed), Standard Bank PLC, Branch: Banani.

(7) Enam Tours & Travles ,Account Number: 1503992933001 City Bank PLC, Branch: Basundhara|

(8)Ishtiyaq Medical Center, Account number: 104 111 000 79122 Primier Bank PLC, Branch: Banani

(9) Smart Medical Centre, Account Number: 104 111 000 82447, Primier Bank PLC, Branch: Banani

(10) Nazowa Medical Centre , Account Number: 105 111 000 82542, Primier Bank PLC, Branch: Banani

সূত্রমতে, এসব হিসাবে দীর্ঘদিন ধরে হুন্ডির টাকা রাখা হচ্ছে। প্রিমিয়ার ব্যাংকের গুলশান শাখায় ‘ নোমান এসোসিয়েট লি:’ এবং ‘স্মার্ট কেয়ার করপোরেশন’ নামক হিসাব দু’টিতে এনাম আহমেদের ট্রানজেকশন লিমিট মাত্র ৭/৮ কোটি টাকা। উত্তোলনকৃত টাকা কোন খাতে খরচ করেন-তার কোনো হিসাব তার কাছে নেই। খরচের উপযুক্ত খাত কিংবা ভাউচার নেই। আসলে এ টাকাই হুন্ডির টাকা। টাকাগুলো উত্তোলন করে তিনি বিশ্বস্ত কর্মচারিদের মাধ্যমে প্রবাসীদের স্বজনদের নিরাপদ ঠিকানায়। আর বিদেশ থাকা তারই প্রতিনিধি ওই রিসিভ করেন।

গত আগস্টেও তার সিটি ব্যাংকের বসুন্ধরা শাখার হিসাবে (নং- ১৫০৩৯৯২৯৩৩০০১) দুই কোটি টাকা স্থিতি ছিলো। এ টাকা তার মেডিকেল সেন্টারের আয় বলে দাবি করা হয়। কিন্তু তিনি এ টাকা আয়কর নথিতে (টিআইএন নং- ৪৭৮২ ৭২৪২ ৮৬২০) দেখাননি। মন  আয়ের কোনো অর্থই তিনি ট্যাক্স ফাইলে দেখান না।

কয়েক বছর আগে রাজধানীর ৩শ’ফিটের সঙ্গে প্রায় ২৪ কাঠা আয়তনের প্লট কেনেন। এটাকাও কালো। কোন উৎস থেকে তিনি এ অর্থ উপার্জন করেছেন, ট্যাক্স ফাইলে তার উল্লেখ নেই। ভয়ঙ্কর হলো পুরো সম্পত্তিটির অস্তিত্বই ট্যাক্স ফাইলে গোপন রাখা হয়েছে।

আলোচিত দম্পত্তি হুন্ডি ব্যবসাই নয়-এ অপরাধলব্ধ অর্থে গড়ে তুলেছেন অর্ধডজন প্রতিষ্ঠান। এসব প্রতিষ্ঠানে জালিয়াতির মাধ্যমে ভুয়া মেডিকেল সনদ বিক্রি করে হাতিয়েছেন অগুন্তি অর্থ। এসব অবৈধ কর্মকাণ্ডের দায়ে কোনো বিপদে পড়লে সেফা নিতেন আওয়ামী লীগের পলাতক সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের। কখনো ডা: এইচবিএম ইকবাল আবার কখনো নূর আলীর প্রভাব ব্যবহার করতেন। স্থানীয় কোনো সমস্ তৈরী হলে এলাকার যুবলীগ নেতা কামরুল হাসান হান্নানের সহযোগিতা নিতেন। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার জমানার পুরোটায় তিনি হুন্ডি ও জাল মেডিকেল ফিটনেস সার্টিফিকেট বাণিজ্য চালিয়েছেন দেদারছে। নামে-বেনামে গড়েছেন সম্পদের পাহাড়।

দুদক সংশ্লিষ্ট সূত্রমতে, এনাম চৌধুরী শিশির দম্পতির সম্পদের লিষ্টে আছে- রাজধানীর বসুন্ধরা আবাসিক এলাকায় ফ্ল্যাট। যার ঠিকানা: ক-১১। রোড-১৩, কালাচাঁদপুর, গুলশান-১২১২, ঢাকা। বাড়ির নাম ‘শিশির’। প্লট নং-২০/১/৪, ব্লক-জি, রোড। সোনিয়া ফেরদৌসী সোবহান রোড, বসুন্ধরা আবাসিক, ঢাকা। বসুন্ধরা আবাসিক এলাকায় (ইষ্ট-ওয়েষ্ট মিডিয়া) ভবনের বিপরীতে কিনেছেন ফ্ল্যাট। ২০১৮ সালে জনৈক শাওন নামের কর্মীর কাছ থেকে নামমাত্র অর্থে জোরপূর্বক ছিনিয়ে নিয়েছেন-মর্মে অভিযোগ রয়েছে। রাজধানীর বনানী কামাল আতাতুর্ক এভিনিউস্থ ৩৪, আউয়াল সেন্টারের ১৫ তলায় কমার্শিয়াল স্পেস। উত্তরায় ২টি বাড়ি। বাড়ি-১৯, রোড-৭, সেক্টর-৪। জসীম উদ্দিন সার্কেল, উত্তরা, ঢাকা। এটিতে অটবির শো-রুম হিসেবে ভাড়া দিয়ে রাখা হয়েছে। উত্তরার ১৩ নম্বর সেক্টরে রয়েছে আরেকটি বাড়ি। গুলশান-১২১২,কালাচাঁদপুর, রোড-১৩, ক-১১-নম্বরে রয়েছে বাড়ি। রাজধানীর বসুন্ধরা সংলগ্ন ৩শ’ ফিট এলাকায় রয়েছে ৩০ কাঠার বাণিজ্যিক প্লট। রাজধানীর বনানীতে ১০ কাঠার প্লটের ওপর বাড়ি। লক্ষ্মীপুর সদরে দালালবাজার এলাকায় রয়েছে তার বেনামী অনেক সম্পত্তি। গ্রামের বাড়ি রংপুরের মাহীগঞ্জ দেওয়ানটুলিতে পৈত্রিক ভিটায় ভবন। নিজ এলাকায় নামে- বেনামে বিপুল সম্পদের কথা স্থানীয়দের কাছে বহুল আলোচিত।

অনুসন্ধান সম্পর্কে দুদক সচিব খুরশিদা ইয়াসমিন বলেন, সুনির্দিষ্ট অভিযোগ এসে থাকলে কমিশন নিশ্চয়ই বিষয়টি খতিয়ে দেখবে। প্রয়োজনবোধ করলে অনুসন্ধান কর্মকর্তা আদালতের অনুমোদন সাপেক্ষে বিদেশযাত্রায় নিষেধাজ্ঞা, ব্যাংক অ্যাকাউন্ট জব্দসহ প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবেন। যদিও মানিলন্ডারিং শাখা এ বিষয়ে কনসার্ন।

এনাম আহমেদের বক্তব্য:

যোগাযোগ করা হলে এনাম আহমেদ চৌধুরী আপন দেশ’কে বলেন, আমি কোনো অসৎ ব্যবসা করিনা। আমার কোনো সম্পদই অবৈধ নেই বা রাষ্ট্রকে ফাঁকি দিয়ে করিনি। যা যা আছে তা ট্যাক্স ফাইলে প্রদর্শন করেছি।

তিনি বলেন, আমি অতি ছোট্ট প্রতিষ্ঠান চালাই কিছু লোক পাঠাই। দেশ-বিদেশের কোনো লোক আমার বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ করার মতো নাই। বায়রায় খোঁজ নিন, আমার প্রতিষ্ঠান কতো সুনামের, আমি ভালো মানুষ কিনা।

কর্মচারী শাওনের ফ্ল্যাট নেয়া প্রসঙ্গে বলেন, আমার টাকা মেরে দিয়েছিল। হিসেবের পর সে তার ফ্র‌্যাট লিখে দিয়েছে, এফডিআর ভেঙে এবং আরও নগর কিছু মিলিয়ে টাকা পরিশোধ করেছে। ফলে তার বিরুদ্ধে আইনগত কোনো ব্যবস্থা নেই।

তবে শাওনের সঙ্গে যোগাযোগ করতে নম্বর চাইলে তিনি বলেন, ২০১৮ সালের ঘটনা। তার নম্বর আমার কাছে নেই।

তার এক হিসাব রক্ষক গোপন এসব ব্যক্তিগত ও প্রাতিষ্ঠানিক তথ্য ফাঁস করে দিচ্ছে বলে ধারনার কথা জানান এনাম চৌধুরী।

 

আপন দেশ/এবি

মন্তব্য করুন # খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, আপন দেশ ডটকম- এর দায়ভার নেবে না।

শেয়ার করুনঃ

সর্বশেষ

জনপ্রিয়