তারিক আফজাল, এবি ব্যাংকের লোগো। ফাইল ছবি
বাংলাদেশের প্রথম বেসরকারি ব্যাংক। নাম এবি ব্যাংক। আশির দশকে সাধারণ জনতা চিনতো আরব বাংলাদেশ ব্যাংক নামে। দেড় যুগ আগে পরিবর্তিত হয়ে ইংরেজির প্রথম দুই বর্ণ নিয়ে এখন শুধুই এবি ব্যাংক।
আধুনিক সেবার কারণে এবি ব্যাংকের জুড়ি ছিল না। ইসলামি ব্যাংকিং শাখা করায় গ্রাহক বেড়েছিল হু হু করে। কালের আবর্তে নতুন পুরোনো ঘটন-অঘটনের কারণে এ ব্যাংকের জৌলুস এখন ইতিহাস।
চার দশকের পথচলায় ঘরে-বাইরে নানামুখী চক্রান্তে বদল হয়েছে ব্যাংকটির চালিকা শক্তি। সর্বদিক থেকে প্রশংসিত হওয়ায় এতে নজর পড়েছিল স্বৈরাচারের। উদ্যোক্তাদের অতি-লোভ আর দখলদার চক্রের কারণে এবি ব্যাংক হয়েছে চিঁড়েচেপটা।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বিচারে এককালের জৌলুসপূর্ণ এবি এখন রুগ্ণ প্রায় ব্যাংকের উদাহরণ। ব্যাংকটির পেছনে ঘুরতে হচ্ছে দুর্নীতি দমন কমিশন দুদকের তদন্ত কর্মকর্তাদের, গ্রেফতারি পরোয়ানা নিয়ে আসছেন থানা পুলিশ। এমন দৃশ্যে ভবিষ্যৎ নিয়ে উদ্বিগ্ন আমানতকারীসহ গ্রাহকদের আনাগোনা বাড়ছে ব্যাংকের শাখাগুলোতে।
বিএনপি নেতা এম মোরশেদ খানের উদ্যোগে ১৯৮২ সালে এবি ব্যাংক প্রতিষ্ঠিত হয়। অপ্রতিরোধ্য গতিতে চলছিল ২০০১ সাল নাগাদ। ঐ বছর এম মোরশেদ খান পররাষ্ট্রমন্ত্রীর শপথ নিয়ে ব্যাংকের দায়িত্ব দেন ছেলে ফয়সাল মোরশেদ খানের হাতে। তখন থেকেই অনিয়ম ভর করে ব্যাংকটিতে।
২০০৭ সালে চেয়ারম্যান পদ ছাড়েন ফয়সাল মোরশেদ খান। কিন্তু নেপথ্য কল-কাঠি ছিল তারই হাতে। ওয়ান-ইলেভেনের পর একে একে দুর্নীতির পাহাড়ের খোঁজ মেলে এবি ব্যাংকে।
ক্ষমতায় আসে আওয়ামী লীগ। চোখ পড়ে বিএনপি নেতার এ ব্যাংকটিতে। অদৃশ্য ইশারায় দুদকের ফাইল চলছিল রকেট গতিতে। দুদকে অর্ধডজন মামলা। ফলে ব্যাংকটির প্রতি গ্রাহকদের আস্থা ধসে যাচ্ছিল বালুর বাঁধের মতো।
এ পরিস্থিতিতে এবি ব্যাংকের পাশে দাঁড়ায় বাংলাদেশ ব্যাংক। একজন সাবেক ডেপুটি গভর্নরকে চেয়ারম্যানের চেয়ারে বসায়। তবে এ সুযোগ হাতছাড়া করেনি শেখ হাসিনা সরকার। দলীয় নেতা তারিক আফজালকে বসান প্রধান নির্বাহীর (ভারপ্রাপ্ত) আসনে। এরপর ব্যবস্থাপনা পরিচালক। শুরু হয় ফ্যাসিবাদের দোসরদের পুনর্বাসন। এ অবস্থা চলমান জুলাই বিপ্লবের পরেও।
কে এই তারিক আফজাল?
সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের সভানেত্রী শেখ হাসিনাকে ১৯৯৯ সালে ‘রং হেডেড’ আখ্যায়িত করেছিলেন প্রধান বিচারপতি এ. টি. এম. আফজালের নেতৃত্বাধীন পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চ। এ. টি. এম. আফজাল ছিলেন স্বাধীন দেশের অষ্টম প্রধান বিচারপতি। তারই ছেলে এবি ব্যাংকের এমডি তারিক আফজাল। আশির দশকের শেষের দিকে যুক্তরাজ্যে তার ব্যাংকিং কর্মজীবন শুরু হয়। এরপর কানাডায় ছিলেন তিনি। দেশি-বিদেশি ব্যাংক-বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানে চাকরির সুবাদে সখ্যতা হয়েছিল বিদেশিদের সঙ্গে। দেশে ফিরে সক্রিয় হয়ে উঠেন রাজনীতিতে।
বাবার দেয়া 'মাথা খারাপ' খ্যাতিপ্রাপ্ত শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগের সঙ্গেই যুক্ত হন তিনি। সিঁড়ি বেয়ে তারিক আফজাল উপহার পান আওয়ামী লীগের আন্তর্জাতিক উপ-কমিটির ৯ নম্বর সদস্যপদ। ২০২৩ সালের ২৪ জুলাই সোমবার গঠিত হয় এ কমিটি। যার মেয়াদ এখনো আছে।
স্বৈরাচারী সরকারে আরও প্রভাব বিস্তার করতে ট্যাগ লাগান বঙ্গবন্ধু শিশু-কিশোর মেলার প্রধান পৃষ্ঠপোষক পদের। এবি ব্যাংকের পদে থেকেই রাজনৈতিক পরিচয়ে গেছেন বিভিন্ন অনুষ্ঠানে, মঞ্চে বসেছেন অতিথি হয়ে, বক্তৃতাও দিয়েছেন। বঙ্গবন্ধুর জন্ম-মৃত্যু,শেখ মুজিব কন্যা শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগ কেন্দ্রিক রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে সরব ছিলেন তিনি।
ব্যাংকের একাধিক কর্মকর্তার মতে, তারিক আফজাল রাজনীতি নিয়ে ব্যস্ত থাকায় ব্যাংকের সূচকে মারাত্মক অবনতি হয়েছে। তার আমলে খেলাপি ঋণ বেড়ে এমন অবস্থা হয়েছে যে, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্ধারিত নিরাপত্তা সঞ্চিতি রাখলে ব্যাংকটিকে এখন ৮ হাজার কোটি টাকা লোকসান গুনতে হবে।
বিচারপতির ছেলে হলেও জাল-জালিয়াতি থেকে বাইরে আসতে পারেননি তারিক আফজাল। দিয়েছেন কাগুজে প্রতিষ্ঠানের নামে বড় অঙ্কের ঋণ। আবার বুদ্ধিমত্তা দিয়ে ব্যাংকের ১৬ হাজার কোটি টাকার খেলাপি ঋণ গোপন করে নজির স্থাপন করেছিলেন।
তারিক আফজাল দায়িত্ব পাবার পর থেকে আওয়ামী লীগের বহু নেতাকর্মীকে পুনর্বাসন করেছেন এবি ব্যাংকে। চাউর হলো- বিএনপি নেতার এবি ব্যাংক যেন আওয়ামী লীগ নেতাদের অঘোষিত আস্তানা।
তার নিয়োগকৃত কর্মকর্তা (ইভিপি) সাবেক ছাত্রলীগ নেতা সৈয়দ মহররম হোসেন। চাকরির পাশাপাশি রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের জড়িয়ে পড়েছিলেন। জুলাই বিপ্লবে ছাত্র হত্যা মামলার আসামি হয়েছেন। সর্বশেষ ১০ নভেম্বর মতিঝিলে ঝটিকা মিছিলের আয়োজন করে হয়েছেন মতিঝিল থানায় দায়ের করা মামলার আসামি।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার চোখ এবি ব্যাংকের দিকে
জুলাই বিপ্লবে এ ব্যাংকের কর্মকর্তা গণহত্যায় উস্কানি দেন। তার বিরুদ্ধে যাত্রাবাড়ি থানায় হত্যা মামলা রয়েছে। ১০ নভেম্বর মতিঝিলে ঝটিকা মিছিলের সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকায় আরও একটি মামলা হয়েছে ওই কর্মকর্তার নামে। ব্যাংকটির দাবি ঝটিকা মিছিলের আগেই ওই কর্মকর্তাকে পদত্যাগে বাধ্য করা হয়।
তবে এ দাবির স্বপক্ষে কোনো নথিপত্র বা বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করেনি এবি ব্যাংক। এছাড়াও ব্যাংকটির ওই কর্মকর্তা এবি ব্যাংকের হয়েই আর্থিক বিষয়ে কাজকর্ম করে যাচ্ছেন। ফলে এখানেও রহস্য রেখেছে ব্যাংকটির পরিচালনা পর্ষদ।
এদিকে শীর্ষ পদে থাকা তারিক আফজাল স্বৈরাচারী আওয়ামী লীগের দোসর হিসেবে পরিচিত। ওই দলের গুরুত্বপূর্ণ কমিটিতে থেকে টুঙ্গিপাড়াসহ নানা স্থানে সভা-সমাবেশ, অনুষ্ঠান করে আসছেন। ৫ আগস্টের পরও তিনি এমডি পদে বহাল তবিয়তে আছেন। ২০২৭ সালের ৭ জুলাই নাগাদ আছে তার মেয়াদ। বৈষম্যবিরোধীরা মনে করে এবি ব্যাংকে বসে তিনি পতিত সরকারের নানা অ্যাজেন্ডা বাস্তবায়ন করছেন। অন্তর্বর্তী সরকারের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছেন। যার প্রমাণ তার হাত দিয়ে ইভিপি হিসেবে নিয়োগপ্রাপ্ত সৈয়দ মহররম হোসেন। তিনি মামলার আসামি।
তারিক আফজালের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নিলে উত্তরা ব্যাংকের মতো ‘দোসর এমডি’ খেদানোর মতো কর্মসূচি আসতে পারে বলে ব্যাংক সংশ্লিষ্টরা ধারণা করছে।
এসব অভিযোগ প্রসঙ্গে এমডি তারিক আফজালকে একাধিবার ফোন করা হলেও তিনি রিসিভ করেননি। হোয়াট্সঅ্যাপে মেসেজ দিলেও তাতে সাড়া দেননি।
আপন দেশ/এমবি/এবি
মন্তব্য করুন # খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, আপন দেশ ডটকম- এর দায়ভার নেবে না।