ছবি: আপন দেশ
দীর্ঘ দেড়যুগ রাষ্ট্র ক্ষমতার বাইরে। শুধু ক্ষমতার বাইরেই নয় এ সময়ে ক্ষয় হয়েছে সর্বশক্তি। হারিয়েছে হাজারো নেতাকর্মী। অগুনতি ছাত্র-যুব নেতাকর্মীর চাকরির বয়স তামাদি হয়েছে। স্বামীহারা নারীরাই যেনো গঠন করতে পারে সহযোগী ‘বিধবা নারী সংগঠন’। হারানো পিতার গুচ্ছ ছবিতে সন্তানের রিডিং রুম যেনো ‘জাদুঘর’। কিন্তু ওই পিতার ঠিকানা ছিল অপ্রকাশিত ‘আয়না ঘর’। অনেক শিশুরই জন্মের পর দেখা হয়নি পিতার মুখ। নিঃস্ব-পলায়নপর জীবন থেকে চলে গেছে অনেক নেতাকর্মীর স্ত্রীও। মোটাদাগের এ চিত্র বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল বিএনপির।
গত ১৫ বছরে দলটি তাদের নেতাকর্মীদের পরিবারের পাশে দাঁড়ানোর নজির কম। জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ফোরাম নামের সংগঠন বিনালাভে শুধু জিয়া পরিবারের দাঁড় টেনেছে। অন্যদের বেলায় উল্টো। আইনজীবীদের খোরাক মেটাতেই হিমশিম খেয়েছেন, নিঃস্ব হয়েছেন মামলার জালে আটকা পড়া বিএনপির প্রায় সবাই। দলীয় প্রধান সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার শেষ সময়টাও কাটাতে হয় ‘ভাড়া করা কারাগারে’ বন্দিদশায়। ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানকে সপরিবারে দেশান্তরী করতে হয়। দলের প্রবীণ নেতাদের মৃত্যু হয়েছে বন্দিদশায়, হয় কারাগারে নয় গৃহবন্দি অবস্থায়।
মিত্রদল জামায়াতের অবস্থাও অনেকটাই কাছাকাছি। তবে রাষ্ট্রীয় বাহিনীর টর্চারের শিকার হলেও নিজ সংগঠনের আইনজীবীদের কড়িগুনতে হয়নি। বিপর্যস্ত পরিবারের পাশে ছিলো সংগঠন। ফলে গা ঢাকাতেই নিরাপত্তা মিলেছে তাদের। আনুপাতিক হারে তাদেরও মরদেহ নিতে হয়েছে অনেক। বিএনপির নেতৃত্ব কবুল করায় ছোট ছোট দলের শীর্ষ নেতাকে হারাতে হয়েছে জমানো টাকা, ব্যবসা-বাণিজ্য। মামলার স্রোতে ভাসতেও হয়েছে।
দীর্ঘ ১৬ বছর আন্দোলনে ফল পায়নি আওয়ামী লীগ বিরোধীরা। তবে শেষ ধাক্কাটা পেয়েছে বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনে। ছাত্র-জনতা একাকার হয়ে স্বৈরাচার হটানোর আন্দোলনে রসদ দিয়েছিল রাজনৈতিক দল বিএনপি-জামায়াতসহ সরকার বিরোধীরা। হাজার প্রাণের বিনিময়ে স্বৈরসরকারের পতন ঘটেছে, পালাতে বাধ্য হয়েছে স্বৈরসরকার প্রধান। সাধারণ মানুষ পেয়েছে মুক্তি, মুক্ত হয়েছে গণতন্ত্র। না বলা কথা বলার মাঠ পেয়েছে রাজনীতিবিদরা। তবে শহীদের রক্তের দাগ শুকানোর আগেই শুরু হয়েছে দুই দলের টানাটানি। তারা ভোটের খাতায় যোগ-বিয়োগ কষছে আওয়ামী লীগকে নিয়ে। তাতে দিনে দিনে গরমিল হচ্ছে অনেক হিসাব। পরিবেশ হচ্ছে বেশ ঘোলাটে। নানা শঙ্কার ধ্বনি বাজছে সীমানার বাইরে।
চলমান পরিস্থিতিতে আগামী সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নৌকা প্রতীক থাকবে কিনা তা এখনই বলা যাচ্ছে না। থাকলেও ওই দলের প্রতীক নৌকা নিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার প্রার্থী সংখ্যাইবা কতো হবে সেটাও বলা মুশকিল। তবে হত্যা, উস্কানি, দুর্নীতির মামলার বান দেখে মনে হচ্ছে আগামী ভোটের মাঠে দলটির প্রথম সারির নেতাদের দেখা নাও মিলতে পারে। যদি তা-ই হয় তাহলে দলটির ভোটাররা যে প্রার্থীকে নিরাপদ মনে করবেন তাকেই ভোট দিবেন। আর নিজেদের নিরাপদ প্রমাণ করতেই মরিয়া বিএনপি-জামায়াত।
রোডম্যাপ না দিলেও জাতীয় নির্বাচন নিয়ে ধারণা দিয়েছেন অন্তর্বর্তী সরকার প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। জানিয়েছেন ২০২৫সালের শেষে না হলেও ২৬ সালের প্রথম দিকেই সংসদ নির্বাচন সম্ভব হবে। আর প্রধান নির্বাচন কমিশনার এ এম এম নাসির উদ্দীন বলেছেন, তার কমিশন সব ধরনের নির্বাচনের জন্য প্রস্তুত। ইতোমধ্যে একটি অডিও বার্তা দিয়েছেন হবু ভোটারদের উদ্দেশ্যে। আগামী জানুয়ারিতে নতুন তালিকা প্রকাশ করা হবে।
এদিকে রাজনৈতিক দলগুলোও ভোটের হিসাব কষছে। প্রধান দলের কাছ থেকে আসন বাগানোর কৌশল চালছে জোটের শরিকরা। আর মনোনয়ন পাবার পরিবেশ তৈরি করছেন আসন ভিত্তিক নেতারা।
আয়না দেখছে আওয়ামী লীগ
দিন বদল হয়েছে। পালিয়েছে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের দলনেত্রী। যদিও তার দোসরবনের বাসিন্দারা বহাল তবিয়তে। এর আগে ২২ বছর ক্ষমতার বাইরে ছিল আওয়ামী লীগ। রাজপথে আন্দোলন করেছে, কিন্তু তাদের নেতাকর্মী গুম-খুনের নজির কম। ফাঁসির রশিতে ঝুলার মতো ঘটনা ঘটেনি। এবার ক্ষমতা পেয়ে তারা হাজার হাজার নেতাকর্মী গুম-খুন করেছে। ফাঁসিতে ঝোলিয়েছে প্রায় ডজন মানুষকে। বিচারের নামে কী গয়েছে তা নিজেরাই ভালো জানেন। দুর্নীতির চিত্র কেমন ছিল তা দলীয় প্রধান তার পিয়নের উদাহরণ টেনে আংশিক চিত্র প্রকাশ করেছেন। রাজপথে প্রতিপক্ষকে কতটুকু জায়গা দিয়েছে তা নতুন করে হুস করার দরকারও নেই। এমন পরিস্থিতিতে মোটামুটি ন্যায় বিচার হলে পরিণতি কী হবে তার হিসাব কষতে বিজ্ঞ-প্রাজ্ঞ হবার দরকার নেই। বিষয়টি আন্দাজ করেই ৫ আগস্টের পর সেনানিবাসের ভেতরে প্রাণ রক্ষার্থে রাজনৈতিক ব্যক্তিসহ বিভিন্ন শ্রেণীপেশার ৬২৬ জন আশ্রয় নিয়েছিল। এরমধ্যে ২৪ জন রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব, ৫ জন বিচারক, ১৯ জন অসামরিক প্রশাসনের কর্মকর্তা, ২৮ জন পুলিশ অফিসার, ৪৮৭ জন পুলিশের বিভিন্ন পর্যায়ের সদস্য, বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মকর্তাসহ বিবিধ ১২ জন ও ৫১ জন পরিবার নিয়ে। একে একে প্রায় সবাই নিরাপদে চলে গেছেন। হাতেগোনা ক’জন সিদ্ধান্তের ভুলে গ্রেফতার হয়েছেন। দলটির বাকিরা দেশেই। কী করেছেন আর এখন কী হতে পারে তার হিসাবটা মোটাদাগেই কষছেন। বলা চলে নিজের ঘরের আয়নাটায় মুখটা দেখছেন দলটির নেতাকর্মীরা। এহেন পরিস্থিতির মেয়াদ কতোদিন বা বছর তার সীমানা নেই। তাই আখের গোছাচ্ছেন অনেকেই। স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি বিক্রি করছেন। ভিনদেশে থাকার বন্দবস্ত করছেন স্বালম্বীরা। কোনো কোনো নেতা মাশুলগুণে প্রতিপক্ষের কাছে নিজেকে সমর্পন করছেন। সপে দিচ্ছেন ব্যবসা-বাণিজ্যের চাবি। এ সুযোগ গ্রহণ করছেন বিএনপি-জামায়াতসহ তাদের মিত্ররা।
দোসরদের জিম্মাদার এখন বিএনপি!
লুটপাট-দুর্নীতির মাধ্যমে অর্জিত সম্পদই নিরাপত্তা দিচ্ছে আওয়ামী লীগ নেতাদের। গত সাড়ে চারমাসের চিত্র বলছে, দেশের বিভিন্ন এলাকায় বহুদোষে দোষী আওয়ামী লীগের নেতাদের আশ্রয়-প্রশ্রয় দিচ্ছে বিএনপি নেতারা। বিনিময়ে কী পাচ্ছে তা জন্রেসাতি আছে। ঠিকাদারী, ঘাট-বাজার নিয়ন্ত্রণ, বদলি-তদবির সব চলমান। কীভাবে? তা খোলাসা করেছে বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের বর্তমান নেতা হাসনাত আব্দুল্লাহ। তিনি বলেছেন, চাঁদাবাজি, দখলদারি সব চলছে আগের মতোই শুধু পরিবর্তন হয়েছে চাঁদাবাজ-দখলদার। এর লাগাম ধরতে ৫ আগস্টের পরপরই বিএনপির শীর্ষ নেতা প্রথমদিকে দলীয় চাঁদাবাজদের বহিষ্কার করে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করতে পেরেছিলেন। কিন্তু এখন তা নিয়ন্ত্রণের বাইরে।
হাটে-ঘাটে-মাঠে এখন কমন বাক্য ‘আগে ওরা ছিলো এখন এরা’। ওরা মানে আওয়ামী লীগ তা পরিষ্কার করলেও এরা কারা তা বলতে নারাজ। অফিস-আদালত, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান কিংবা অন্য সেক্টরে দোসরদের দিকে আঙ্গুল তুলতেই বিএনপির দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতা বলেন ‘এরা আমার লোক’। আর দলটির শীর্ষ নেতাদের বক্তব্যে সোজাসাপ্টা মনে হচ্ছে- অতীত ভুলে নতুন হিসাব কষছেন তারা। মাঠ ফাঁকা। আগত সরকার তারাই গঠন করবেন। শুধু নির্বাচনের বাকি। তাই বাক্স ভরতে চাই ভোট। দেশের ৩৫/৪০ভাগ ভোট ১৪ দলীয় জোটের। তাই কথায় কাজে জোটটি বিরাগভাজন না হয়। আওয়ামী লীগ-জাপার ভোট যেনো অন্যের বাক্সে না পড়ে। এতে বিরক্তির সুর অন্তর্বর্তী সরকার প্রধানেরও। পদে পদে বাধা। ফলে ‘এ বস্তার চাল ও বস্তায়, এ ঘাটের জল ও ঘাটে ঢালা’-এ হচ্ছে সংস্কার।
জামায়াতের চোখ দূরে
৫ আগস্ট স্বৈরাচার পালানোর পরপরই ‘বাসর রাতে বিড়াল মারা’র গল্পের মতোই সব কিছু নিয়ন্ত্রণে নিয়েছে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী। ব্যাংক-বীমা কোম্পানি, বিশ্ববিদ্যালয়, ফাউন্ডেশন, হাউজিং কোম্পানি, টেলিভিশনসহ যা যা হাতছাড়া হয়েছিল কড়ায়-গণ্ডায় তা ফিরিয়ে নিয়েছে। সংস্কার প্রক্রিয়ায় শরিক হয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি, প্রশাসনের গুরুত্বপূর্ণ পদে বসিয়েছেন পছন্দের লোক। তারা এখন সংগঠনের পরিধি বাড়ানোর কাজে ব্যস্ত। জামায়াতের আমীর ইতোমধ্যে দেশের প্রায় অর্ধেক জেলা-মহানগরে হাজির হয়েছেন। ভোটের চিন্তা মাথায় রেখে প্রস্তুত করছেন সম্ভাব্য প্রার্থীদের।
দলটির কোনো নেতাই চাঁদাবাজির দায়ে বহিষ্কৃত হয়নি। আগামীতে ভোট টানতে পতিত আওয়ামী লীগকে ক্ষমা করে দিয়েছেন জামায়াত আমীর। সংগঠনের প্রতি সমর্থন পেতে ভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের সঙ্গেও মতবিনিময় সভা করছেন। প্রতিবেশী দেশ ভারত রুষ্ট হয়-এমন বাক্যও ছাড়ছেন না সংগঠনটির শীর্ষ নেতারা। তবে দেশের মাটিতে এ সময়ে বিএনপিকেই ভোটের মাঠের প্রতিপক্ষ মনে করছে জামায়াত। যে কারণে আকারে-ইঙ্গিতে সমালোচনার পিন ঠুকে দিচ্ছে বিএনপির গায়ে। হিসাবটা এমন - দাঁড়িপাল্লায় যেনো পড়ে আওয়ামী লীগ সমর্তিত ভোটারদের সীল।
ভারত তোষণ নীতি
সময় সময়ে প্রতিবেশী দেশ ভারতের প্রতি ক্ষোভ প্রকাশ করে বিএনপি-জামায়াত। পানির ন্যায্য হিস্যা, সীমানায় শান্তির খোঁজে নামে তারা। দেশটির পণ্য বয়কট করে, স্ত্রীর শাড়িতে আগুণ দেয় নেতা কিন্তু তলে তলে করছে তোষণ।
নির্ভযোগ্য সূত্রের দাবি, বিএনপি-জামায়াতের একাধিক নেতা ভারত লবি মেন্টেইন করার দায়িত্বে আছেন। দেশটির সহযোগিতা ছাড়া বেশি আসন মিলবে না। নির্বিঘ্নে সরকার পরিচালনা অসম্ভব তা নতুন করে বুঝার দরকার নেই। তাই ভারতের চাহিদা মেটাতে পরামর্শ পালন করতে রাজি দুই দলই। ভারতবিরোধী সেন্টিমেন্টকে নিজের তহবিলে ভরতে নানা কৌশল নিচ্ছে বিএনপি-জামায়াত।
ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক নিয়ে দেশটি থেকে প্রকাশিত গণমাধ্যমের বাংলাদেশ প্রতিনিধিদের সঙ্গে মতবিনিময়কালে জামায়াতের আমীর ডা. শফিকুর রহমান বলেছেন, ভারত কষ্ট পায়, এমন কিছু করবে না জামায়াতে ইসলামী। আর বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে সবসময়ই খুব ভালো সম্পর্ক রয়েছে এবং সম্পর্ক উন্নত হয়েছে। ভারতের বোঝার চেষ্টা করা উচিত তাদের সব ডিম এক ঝুড়িতে রাখা উচিত নয়। তার মানে ভারতের আস্থায় যেতে চায় বিএনপি।
আপন দেশ/এবি
মন্তব্য করুন # খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, আপন দেশ ডটকম- এর দায়ভার নেবে না।