মুন্সি মুহাম্মদ ওয়াকিদ
ব্যাংকের খাতের অনিয়ম, লোপাটের ভয়ঙ্কর চিত্র ফুটে উঠছে। বিশেষ করে বাংলাদেশ ব্যাংকের অভ্যন্তরীণ একেকটি ঘটনার ভয়াবহতা আঁতকে উঠার মতো। আর্থিক খাতে অনিয়মের লাগাম ধরার কথা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের, কিন্তু ঘটেছে উল্টো।
ভুয়া ছাড়পত্রের কারখানা হয়ে উঠেছিল কেন্দ্রীয় ব্যাংক। খেলাপি গ্রাহককে ‘নিয়মিত’ দেখানো হতো এখান থেকেই। এ ছাড়পত্র দেখিয়েই খেলাপি ধরার জাল ভেদ করে ‘ক্লিনম্যান’ চিহ্নিত হতো দেশের হাজার হাজারো ঋণখেলাপি ও জনপ্রতিনিধি। এছাড়াও ঋণ থাকার পরও ভুয়া কাগজে ঋণের নামে লাখ কোটি টাকা হরিলুট করেছে বেক্সিমকো গ্রুপ, এস আলম গ্রুপ, নাসা গ্রুপ, তাইপে গ্রুপসহ বিভিন্ন গ্রুপ ও ব্যক্তি।
দেশ বিরোধী এ কাজটির মাস্টারমাইন্ড ছিলেন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার। তার দক্ষিণ হস্ত ছিলেন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ক্রেডিট ইনফরমেশন ব্যুরোর (সিআইবি) ডিরেক্টর মুন্সি মুহাম্মদ ওয়াকিদ। ওয়াকিদ মুন্সির স্মার্ট ক্যারিশমায় খেলাপির ভাগ্যে মিলতো নিয়মিত-এর ক্লিয়ারেন্স।
স্বৈরাচার শেখ হাসিনা পালানোর পর একই পথে গেছেন আব্দুর রউফ তালুকদার। তবে স্মার্ট ও বহুমাত্রিক ক্যারিশমায় বহাল আছেন ভুয়া রিপোর্টদাতা সেই মুন্সি ওয়াকিদ। শেখ হাসিনার শাসন আমলসহ টানা ২৩ বছর একই বিভাগে এ মুন্সি। ২/১ বার তার বদলির চিঠি দেয়া হয়েছিল কিন্তু তা বেশিদিন টেকেনি। ঘুরেফিরে সেই চেয়ারেই আনা হতো মুন্সিয়ানা ওয়াকিদকে। তাকে সিআইবি বিভাগে ফেরাতে অদৃশ্য শক্তি প্রয়োগ করে লুটেরা গোষ্ঠী। সার্বিক সহযোগিতা করতেন সিআইবির নির্বাহী পরিচালক গোপালগঞ্জের বাসিন্দা মানসুরা পারভীন।
ওদিকে মুন্সির বেলায় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মানব সম্পদ বিভারগের ভূমিকা নিয়েও প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে। চাউর আছে, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অনেক বড়কর্তার অপকর্মের আমলনামা আছে ওয়াকিদের কাছে। অভিযান চালালে তিনি হতে পারেন অপকর্মের রাজসাক্ষী। মুন্সির কিছু হলে- ওই কর্তাদের থলের ‘কালো বিড়াল’ দৌড় দিতে পারে। ফাঁস হতে পারে গোপন নথি। ফাইল চাপা দিতে ওয়াকিদকে ভারী পাথর মনে করছেন দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তারা। ফলে ডানে-বামের সবাই বদলি বা তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হলেও মুন্সী ওয়াকিদকে নিয়ে টু শব্দ করছেন না কেউই।
আরও পড়ুন<<>> ইসলামী ব্যাংকের মুনিরুল মওলাকে নিয়ে ভয় এস আলমের!
বাংলাদেশ ব্যাংকের ক্রেডিট ইনফরমেশন ব্যুরো (সিআইবি) দেশের অর্থনৈতিক শৃঙ্খলা বজায় রাখতে একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ বিভাগ। এটি দেশের সকল ঋণগ্রহীতার তথ্য সংরক্ষণ এবং ঋণ খেলাপিদের কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণে প্রধান ভূমিকা পালন করে। বিভাগটির বর্তমান পরিচালক মুন্সী মুহাম্মদ ওয়াকিদের বিরুদ্ধে গুরুতর অভিযোগ উঠেছে, যা দেশের অর্থনৈতিক শৃঙ্খলা, নৈতিকতা এবং সুশাসনের জন্য হুমকিস্বরূপ বলে মনে করেন ব্যাংকাররা।
বাংলাদেশ ব্যাংকের একাধিক কর্মকর্তা বলেন, ২০২৪ সালের দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে এ সিআইবি বিভাগে গুরুত্বপূর্ন ভুমিকায় ছিলেন মুন্সি ওয়াকিদ। আওয়ামী লীগের অনেক ব্যবসায়ির প্রতিষ্ঠান প্রকৃত খেলাপি হলেও তার কৌশলে নিয়মিত গ্রাহকের ছাড়পত্র পেত। যার মধ্য দিয়ে নির্বাচনে এসব ব্যবসায়িদের অংশগ্রহণের পথ সুগম হয়েছে।
একজন উর্ধ্বতন কর্মকর্তা এ প্রতিবেদককে বলেন, গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদারের সময়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি হরিলুট হয়েছে। তার কালেই এস. আলম ও সালামান এফ রহমান দেশের ব্যাংকগুলোতে শতশত কাগুজে প্রতিষ্ঠান তৈরি করে লাখ কোটি টাকা ঋণ জালিয়াতি করেছে।
আরও পড়ুন<<>> বাংলাদেশ ব্যাংকের তিন কার্যালয় ছিল এস আলমের!
প্রত্যেকটি ঋণ দেয়ার আগে সিআইবিতে গ্রাহকের ঋণ স্ট্যাটাস দেখা হয়। ভুয়া কাগজে প্রতিষ্ঠান জানা সত্ত্বেও তার বিপরীতে ঋণ দিতে ছাড়পত্র দিতেন মুন্সি ওয়াকিদ। সরকার পরিবর্তনের পরেও তিনি একই বিভাগের ডিরেক্টর হিসেবে কর্মকরত রয়েছেন। যার কারণে এখনো কর্মকর্তাদের মধ্যে উদ্বেগের কারণ সৃষ্টি হয়েছে। এরকম একজন দুর্নীতিপরায়ণ ব্যক্তি কিভাবে একইবিভাগে দুই যুগের বেশি সময় অতিবাহিত করেন।
একই বিভাগে মুন্সির দুই যুগ
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ইন্টারনাল নির্দেশে মুন্সি ওয়াকিদের বদলি চিঠি সূত্রে জানা যায়, মুন্সি ওয়াকিদ ২০০১ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত ১৩ বছর চাকরির পর যুগ্ম-পরিচালক থাকা অবস্থায় ২০১৪ সালের ২ অক্টোবর সিআইবি থেকে পরিসংখ্যান বিভাগে বদলি করা হয়। মাত্র তিন মাসের মাথায়, ২০১৫ সালের ৬ জানুয়ারি অদৃশ্য শক্তির বলে তিনি আবার সিআইবিতে ফিরে আসেন।
তিনি একই জায়গায় থেকে ২৯ আগস্ট ২০১৭ সালে উপমহাব্যবস্থাপক (বর্তমানে অতিরিক্ত পরিচালক) পদে পদোন্নতি পান। এরপরও তিনি একই শক্তির প্রভাবে সিআইবিতে বহাল ছিলেন। একই বিভাগে থেকেই ২০২৩ সালের ৩০ এপ্রিল পরিচালক পদে পদোন্নতি পান তিনি। পদোন্নতির পর তাকে পরিসংখ্যান বিভাগে পাঠানো হয় কিন্তু ছয় মাসও যায়নি সেখানে। ওই বছরের ১৭ অক্টোবর তিনি ফের সিআইবিতে পোস্টিং নেন।
কর্মকর্তারা বলেন, ২০২৪ সালের প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচনের ঠিক এক মাস আগেই এক বিশেষ এসাইনমেন্ট দিয়ে গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদারের নির্দেশে তাকে সিআইবিতে পুনরায় পোস্টিং দেয়া হয় ৷ ওয়াকিদ মুন্সির বিরুদ্ধে গুরুতর অভিযোগ হলো- তিনি বিশেষে উদ্দেশ্যে ঋণ খেলাপিদের সিআইবি রিপোর্ট সংশোধন করে তাদের খেলাপি মুক্ত দেখাতেন। এর মাধ্যমে নির্বাচনে অধিক সংখ্যক প্রার্থীর অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা হয়েছে ২০২৪ সালের নির্বাচনে। যা ফ্যাসিস্ট সরকারের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল এবং রাজনৈতিক ইমেজ শক্তিশালী করতে ব্যবহৃত হয়।
আরও পড়ুন<<>> বিতর্কিত দুই ডেপুটি গভর্নরের কারিশমা, ঝুঁকিতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক
গত ১৫ বছর আওয়ামী সুবিধাভোগী ডেপুটি গভর্নর ও সিআইবির নির্বাহী পরিচালক মানসুরা পারভীনের চোখে ওয়াকিদ মুন্সীর বদলে হবার কথা ছিল মওলানা। তার কাজে তুষ্ট ছিলো প্রধানমন্ত্রীর দফতর থেকে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নিজস্বরা। যে কারণে শতভাগ সাপোর্ট দিচ্ছেন গোপালগঞ্জের মানসুরা পারভীন। যিনি সিআইবির নির্বাহী পরিচালক হওয়ার আগে জিএম (বর্তমান পরিচালক) পদে দায়িত্ব পালন করেছিলেন। সে সময় মুন্সী মুহাম্মদ ওয়াকিদ সিআইবির ডিজিএম (বর্তমানে অতিরিক্ত পরিচালক) ছিলেন। মানসুরা পারভীন মুন্সীকে বিশেষ প্রাধান্য দিতেন। তার স্বামী শাহজালাল ইসলামী ব্যাংকের ডিএমডি আখতার হোসেন। ডেপুটি গভর্নর কাজী সাইদুর রহমান ও খুরশিদ আলমের ঘনিষ্ঠজন ছিলেন।
এ সিন্ডিকেটের প্রভাবে সিআইবির অন্যান্য কর্মকর্তাদের অবহেলা করা হতো শেখ হাসিনা আমলজুড়েই। ওই বিভাগের সদস্যদের মধ্যে বৈষম্য তৈরি করেছে তারাই। কারণ, সিআইবির অধিকাংশ সিদ্ধান্ত শুধু ওয়াকিদ-মানসুরার দ্বারা পরিচালিত হতো।
প্রভাবশালী গোষ্ঠীর বিশেষ সুবিধা প্রদান
মুন্সি ওয়াকিদ বিভিন্ন প্রভাবশালী গোষ্ঠী বেক্সিমকো গ্রুপ, এস আলম গ্রুপ, নাসা গ্রুপ, তাইপে গ্রুপের জন্য সিআইবি রিপোর্ট সংশোধন করেছেন। এর বিনিময়ে তিনি বিপুল অর্থ ও ব্যক্তিগত সুবিধা অর্জন করেছেন-এ কথা বাংলাদেশ ব্যাংকে ওপেন-সিক্রেট।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অফিসার্স কাউন্সিল নীল দল (আওয়ামী লীগ পন্থি) জোরালো লবিং করছেন; মুন্সি ওয়াকিদকে সিআইবিতে বহাল রাখতেই হবে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরিসংখ্যান সাইডে আরও ১২জন পরিচালক থাকা সত্ত্বেও মুন্সী ওয়াকিদকেই কেন ওই পদে বহাল রাখতে হবে তার উত্তর খুঁজছে বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা।
আলাপকালে একাধিক কর্মকর্তা বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের মানব সম্পদ বিভাগের ভূমিকা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। তারা মুন্সী ওয়াকিদের বিরুদ্ধে কোনো কার্যকর ব্যবস্থা না নিয়ে বরং তাকে সুরক্ষা দিচ্ছে। তাদের ধারণা, ওয়াকিদের কাছে এমন কোনো গোপন দুর্নীতির তথ্য রয়েছে, যা ফাঁস হয়ে গেলে বাংলাদেশ ব্যাংকের অনেক উচ্চপদস্থ কর্মকর্তার অপকর্ম ধরা পড়বে। এ কারণেই হয়তো এইচআরডি তার বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নিতে সাহস করছে না।
এখনো সেবা-স্বচ্ছতার অভাব সিআইবি বিভাগে
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সিআইবি বিভাগের তথ্য ব্যবহারে মুন্সি ওয়াকিদের স্বেচ্ছাচারিতা এবং রাজনৈতিক স্বার্থে অপব্যবহারের নতুন শঙ্কায় কর্মকর্তারা। তারা মনে করেন- মুন্সির এহেন কর্মকাণ্ডে গ্রাহক সেবা এবং বিভাগীয় স্বচ্ছতায় মারাত্মক প্রভাব ফেলেছে।
অভিযোগ পড়েছে- টিমেক্স জুট মিলস লিমিটেড নামক একটি কোম্পানির চেয়ারম্যান আব্দুল মান্নান ও তার ভাইয়ের (একজন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর) কোম্পানির সিআইবি সমস্যার সমাধান বিষয়ে একটি কোর্টের আদেশ নিয়ে আসেন। কিন্তু মুন্সী ওয়াকিদ সে আদেশ বাস্তবায়ন করছেন না। তার গড়িমসির কারণে ফলে আব্দুল মান্নানের কোম্পানি প্রায় ১০ কোটি টাকার মতো লোকসানের সম্মুখীন। এ বিষয়ে আলোচনা করতে আব্দুল মান্নান ওই সময়ে মুন্সী ওয়াকিদের সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করতে গেলে তাদের সঙ্গে অসৌজন্যমূলক আচরণ করেন মুন্সি ওয়াকিদ। মুন্সীর মারমুখি আচরণে আশপাশের সবার অবাক হন।
বাংলাদেশ ব্যাংক ও মুন্সী ওয়াকিদের বক্তব্য
মুন্সি মুহাম্মদ ওয়াকিদের কাছে মুঠফোনে অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে আপন দেশকে বলেন, আমি এ বিষয়ে কিছু বলতে পারবো না। আপনারা তো সাংবাদিকরা তথ্য বের করতেই পারবেন।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র হুসনে আরা শিখা এ প্রতিবেদককে বলেন, মুন্সি ওয়াকিদের বিষয়ে আমাদের কাছে এখন পর্যন্ত কোনো অভিযোগ আসেনি। অভিযোগের প্রেক্ষিতে সত্যতা প্রমাণিত হলে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে।
আপন দেশ/এবি
মন্তব্য করুন # খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, আপন দেশ ডটকম- এর দায়ভার নেবে না।