মো. আব্দুল জলিল। ছবি: সংগৃহীত
বাংলাদেশ ব্যাংক দায়িত্ব দিয়েছে ব্যাংক পাহারার। কিন্তু ঘটেছে বেড়ায় ফসল খাওয়ার মতো ঘটনা। দায়িত্বে এসেই ' মুরগী পাহারাদার শিয়ালের' ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছেন ইসলামী ব্যাংক পর্ষদের নির্বাহী কমিটির চেয়ারম্যান মো. আব্দুল জলিল। খেলাপি প্রতিষ্ঠানকে দিয়েছেন বড় অংকের ঋণ সুবিধা। বিজ্ঞপ্তি ছাড়াই বড় বড় পদে নিয়োগ দিচ্ছেন স্বজনদের। হস্তক্ষেপ করছেন ব্যাংকের দৈনন্দিন কার্যক্রমে। ক্ষমতার অপব্যবহার করে ব্যবহার করছেন পৃথক অফিস কক্ষও।
ইতোমধ্যে এসব অনিয়মের তদন্তে নেমেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। গত ২৬ ডিসেম্বর দুপুরে ব্যাংটি পরিদর্শন করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরিদর্শন টিম। তদন্তের পর ইসি চেয়ারম্যান মো. আব্দুল জলিলের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে বলে জানিয়েছেন বাংলাদেশের ব্যাংকের দায়িত্বশীল শীর্ষ কর্মকর্তা।
এস আলম গ্রুপের লুটপাটে ডুবেছিল ব্যাংকটি। এখনো ধকল সামলে নিয়মিত লেনদেনেই পুরোপুরি ফিরতে পারেনি ইসলামী ব্যাংক। বাংলাদেশ ব্যাংকের মাধ্যমে ধার করা টাকায় চলছে ব্যাংকটি। অথচ এর মধ্যেই নতুন করে অনিয়ম শুরু করেছেন ব্যাংকটিতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নিয়োগ করা পর্ষদ সদস্যদের কেউ কেউ। উচ্চ সুদে ধার করা টাকা দিয়ে দিচ্ছেন নিজের স্বার্থসংশ্লিষ্ট ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানে। অথচ এ টাকা ব্যয় হওয়ার কথা ছিল আমানতকারীদের প্রয়োজন মেটাতে।
দেখা গেছে, খেলাপি ও শতভাগ ঝুঁকিপূর্ণ প্রতিষ্ঠান ট্রু ফেব্রিকস ও ইউনিফিল টেক্সটাইল মিলের অনূকুলে ২৫০ কোটি টাকার ঋণ অনুমোদন করেছে ইসলামী ব্যাংক। গত ১০ ডিসেম্বর ব্যাংকটির নির্বাহী কমিটি বড় অংকের ঋণটি অনুমোদন দেয়। অথচ নতুন ঋণ দিতে ইসলামী ব্যাংককে নিষেধ করেছিল কেন্দ্রীয় ব্যাংক। কারণ, গত সময়ে সীমাতিরিক্ত বিনিয়োগ করায় নতুন ঋণের সুযোগ নেই ব্যাংকটির।
সে নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে নতুন ঋণ অনুমোদন করেছেন ইসলামী ব্যাংকের নির্বাহী কমিটির (ইসি) চেয়ারম্যান মো. আব্দুল জলিল। এ ঋণ অনুমোদনেও অনিয়মের আশ্রয় নেয়া হয়েছে।
আরও পড়ুন<<>> ওয়াকিদের স্মার্ট ক্যারিশমায় শীর্ষ খেলাপিরাও পেত সিআইবি ছাড়পত্র
নথিপত্র ঘেটে দেখা গেছে, প্রথমে প্রস্তাবিত ঋণের অংক ছিল ২২৫ কোটি টাকা। ব্যাংকের অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক ওমর ফারুকের নেতৃত্বাধীন আইসি কমিটি এ পরিমাণ ঋণের প্রস্তাব ইসি কমিটিতে পাঠিয়েছিল। কিন্তু নির্বাহী কমিটির ২০১৭তম সভা শুরুর দিন সকালে এ ঋণের প্রস্তাব বাড়িয়ে ২৫০ কোটি টাকা করা হয়েছে।
আপন দেশ অনুসন্ধানে দেখা গেছে, ইসি চেয়ারম্যান আব্দুল জলিলের নির্দেশে ওমর ফারুক তড়িঘড়ি করে ঋণপ্রস্তাব বাড়িয়ে নতুন করে নথি প্রেরণ করেন। এর ভিত্তিতে ওইদিন ২৫০ কোটি টাকা ঋণ অনুমোদন করা হয় প্রতিষ্ঠান দুটির অনুকূলে। অথচ ইসি কমিটির মেমোতেই উল্লেখ করা হয়েছে, ব্যবসায়ী এম. এ. বাশারের মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান দুটি এক্সিম ব্যাংকে ঋণ খেলাপি। অনাদায়ী আছে ১৮ কোটি টাকা। এছাড়া ক্রেডিট রেটিংয়ে প্রতিষ্ঠানগুলোকে দীর্ঘ মেয়াদে শতভাগ ঝুঁকিপূর্ণ বলা হয়েছে। কোম্পানির উৎপাদন সক্ষমতা বিবেচনায় নিলে নতুনভাবে চলতি মূলধন দেয়ার সুযোগ নেই। এরপরও সকল ব্যাংকিং নিয়মাচার লঙ্ঘন করে এমন প্রতিষ্ঠানের অনুকূলে জোরপূর্বক ঋণ প্রস্তাব অনুমোদন করিয়ে নিয়েছেন আব্দুল জলিল, এমন তথ্য জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা।
অনুসন্ধানে দেখা যায়, মো. আব্দুল জলিল পূর্বে ইসলামী ব্যাংকের এক্সিকিউটিভ ভাইস প্রেসিডেন্ট (ইভিপি) ছিলেন। পরবর্তীতে আল-আরাফাহ ইসলামী ব্যাংকে যোগদান করেন। উপব্যবস্থাপনা পরিচালক (ডিএমডি) হিসেবে ২০১৮ সালে অবসর গ্রহণ করেন জলিল। এরপর তিনি ইসলামী ব্যাংকের ইসলামপুর শাখার গ্রাহক ট্রু ফেব্রিকস লিমিটেড নামক প্রতিষ্ঠানে ব্যাংকিং বিষয়ক পরামর্শক হিসেবে যোগদান করেন।
গত ৫ আগস্ট সরকার পরিবর্তন হলে ইসলামী ব্যাংককে এস আলম গ্রুপের নিয়ন্ত্রণ থেকে বের করতে নতুন পরিচালনা পর্ষদ গঠন করে দেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এ পর্ষদের পরিচালক হিসেবে নিয়োগ পান আব্দুল জলিল। পর্ষদ পরে তাকে ইসি চেয়ারম্যান নির্বাচিত করেন। দায়িত্বে এসেই তিনি তার স্বার্থসংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানকে ঋণ দিলেন সকল ব্যাংকিং আইন ও বিধান লঙ্ঘন করে।
নিয়োগে স্বজনপ্রীতি
এদিকে ইসলামী ব্যাংকের দুই সহযোগী প্রতিষ্ঠানে স্বজনপ্রীতির মাধ্যমে নিয়োগ দেয়ার প্রমাণ মিলেছে আব্দুল জলিলের বিরুদ্ধে।
নিজের মেয়ের জামাতা মো. মশিউর রহমানকে ইসলামী ব্যাংক সিকিউরিটিজ লিমিটেডের এমডি হিসেবে নিয়োগ দিয়েছেন। অথচ তিনি নিজেই এ সিকিউরিটিজের একজন পরিচালক। গত ২০ অক্টোবর ব্যাংকের ৩৪৪তম পর্ষদ সভায় মশিউর রহমানের নিয়োগের সিদ্ধান্ত হয়। আব্দুল জলিল ওই সভায় উপস্থিত থেকে চাপ প্রয়োগের মাধ্যমে সিদ্ধান্ত নিজের অনুকূলে নিয়েছেন বলে সভা সূত্রে জানা গেছে।
ইসলামী ব্যাংক ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যানের দায়িত্বে থেকেও ক্ষমতার অপব্যবহার করছেন জলিল। নিজের মেয়ের জামাতার মামা ফায়জুল কবিরকে গত ৮ অক্টোবর জেনারেল ম্যানেজার পদমর্যাদায় নিয়োগ দিয়েছেন ফাউন্ডেশনে। গত ২৩ সেপ্টেম্বর ফাউেন্ডেশনের ২২৫তম সভায় এ নিয়োগের সিদ্ধান্ত হয়েছিল। এছাড়া আবুল খায়র নামের একজন আত্মীয়কে কোনো বিজ্ঞপ্তি ছাড়াই ফাউন্ডেশনের সিনিয়র অফিসার পদে নিয়োগ দিয়েছেন। এছাড়া ড. আলতাফ উদ্দীন নামের একজন আত্মীয়কে ইসলামী ব্যাংক হাসপাতালের বরিশাল শাখার সুপারিনটেনডেন্ট হিসেবে নিয়োগ দিয়েছেন। এছাড়া ইসলামী ব্যাংক হাসপাতালের রাজশাহী, মতিঝিল, কাকরাইলসহ বিভিন্ন শাখায় নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি ছাড়াই লোকবল নিয়োগের অভিযোগ উঠেছে তার বিরুদ্ধে।
ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষের কাজে হস্তক্ষেপের অভিযোগ
পরিচালনা পর্ষদের মধ্যে শুধু চেয়াম্যানের জন্য আলাদা চেম্বার রাখার বিধান আছে। অন্য পরিচালকরা এ সুবিধা পাবেন না। তারা শুধু পরিচালনা পর্ষদের বৈঠকে যোগদান করে তাদের মতামত তুলে ধরবেন। কিন্তু ইসলামী ব্যাংকের পরিচালক আব্দুল জলিলের বিরুদ্ধে আলাদা চেম্বার ব্যবহারের অভিযোগ রয়েছে, যদিও চেম্বারের নেমপ্লেটে 'কমিটি রুম' লেখা আছে। এছাড়া পদোন্নতি, বদলি, অডিট রিপোর্ট তৈরি, ঋণ বিতরণসহ ব্যাংকের দৈনন্দিন কার্যক্রমে আব্দুল জলিলের হস্তক্ষেপের অভিযোগ তুলেছেন কর্মকর্তারা।
ইসি চেয়ারম্যান মো. আব্দুল জলিলের বক্তব্য
জামাতা মো. মশিউর রহমানকে ইসলামী ব্যাংক সিকিউরিটিজ লিমিটেডের এমডি হিসেবে নিয়োগ দেয়া প্রসঙ্গে মো. আব্দুল জলিল আপন দেশকে বলেন, তিনি (মশিউর রহমান) ইসলামী ব্যাংকেরই চাকরিজীবী। বোর্ড তাকে ওখানে পাঠিয়েছে। মশিউর রহমান এফসিএ- তিনি ব্যাংকেরই। এরমধ্যে জামাতা হয়েছেন।
খেলাপি প্রতিষ্ঠানকে ঋণ দেয়ার সিদ্ধান্ত প্রসঙ্গে আব্দুল জলিল বলেন, প্রতিষ্ঠানটি ৮৬ সাল থেকে চলমান। ঋণ দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছি কিন্তু প্রশ্ন উঠার পর সে সিদ্ধান্ত বাতিল করেছি। ফাইলটি বোর্ডে পাঠানো হয়েছে। তারা যা ভালো মনে করে।
বেয়াইকে (জামাতার মামা) ইসলামী ব্যাংক ফাউন্ডেশনে ম্যানেজার পদমর্যাদায় নিয়োগ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ব্যাংকের চেয়ারম্যান সেখানকার সদস্য। তিনি মিটিংয়ে থাকেন, সিদ্ধান্ত দেন। তার সিদ্ধান্তের বাইরে কোনো কথা আমরা বলি না।
তিনি অভিযোগ করেন, তার নিজের ভূমিকার কারণে ব্যাংকের ভেতরের কিছু লোক নাখোশ আছে। তবে আরও সতর্কতার সঙ্গে চলতে হবে বলে আলাপকালে জানান মো. আব্দুল জলিল।
ব্যাংক সূত্রের খবর, খেলাপি প্রতিষ্ঠানকে ঋণ ইস্যু নিয়ে গত ২৬ ডিসেম্বর দুপুরে বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিদর্শন টিম (ব্যাংক পরিদর্শন বিভাগ) ইসলামী ব্যাংক পরিদর্শন করে। এরপরই তড়িঘড়ি করে ঋণ পাশের ইসির সিদ্ধান্ত বাতিল করা হয়। ফাইলটি পাঠানো হয় বোর্ডে।
আপন দেশ/এবি/এসএমএস
মন্তব্য করুন # খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, আপন দেশ ডটকম- এর দায়ভার নেবে না।