অগ্রণী ব্যাংকের চেয়ারম্যান সৈয়দ আবু নাসের বখতিয়ার আহমেদ
সৈয়দ আবু নাসের বখতিয়ার আহমেদ যখন অগ্রণী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ছিলেন, তখন পূবালী ব্যাংক থেকে একটি রুগ্ন প্রতিষ্ঠানের ঋণ কিনে নিয়েছিলেন। ২০০৭ সালে ওই ঋণের পরিমাণ ছিল ১২ কোটি টাকা। এরপর আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে এ ঋণ বেড়ে ৩০ কোটি হয়েছে। ঋণের অর্থ অন্য খাতে ব্যয় করায় ব্যবসা বন্ধ হয়ে গেছে। খেলাপি হয়ে পড়ায় দুইবার ঋণ নবায়ন করিয়েছে। কিন্তু ব্যাংকের টাকা ফেরত দেয়নি।
বর্তমানে আবু নাসের বখতিয়ার অগ্রণী ব্যাংকের চেয়ারম্যান। এখন আবার তিনি মেসার্স চৌধুরী এন্ড কোম্পানী নামের হিমায়িত মৎস্য রফতানিকারী প্রতিষ্ঠানটিকে ৪০ কোটি টাকা ঋণ দিতে চাচ্ছেন। এক্ষেত্রে চেয়ারম্যানের ইচ্ছা আর নিজের সুবিধার বাস্তবায়নে কাজ করছেন চট্টগ্রামের সার্কেল মহাব্যবস্থাপক এ কে এম শামীম রেজা।
জানা গেছে, দীর্ঘ একদশক ধরে চট্টগ্রামের এ প্রতিষ্ঠানটির রফতানি কার্যক্রম বন্ধ। এমন প্রতিষ্ঠানকেই ঋণ দিতে বেপরোয়া হয়ে উঠেছেন অগ্রণী ব্যাংকের নয়া চেয়ারম্যান সৈয়দ আবু নাসের বখতিয়ার আহমেদ। ব্যাংকের কর্মকর্তাদের নির্দেশ দিয়েছেন মেসার্স চৌধুরী এন্ড কোম্পানিকে ঋণ দিতে। এমনকি নিজ হাতে ফাইলে কাটাকাটি করে ঋণের টাকার পরিমাণ বাড়িয়েছেন। আর এসব অভিযোগ নিজ মুখে স্বীকারও করে নিয়েছেন চেয়ারম্যান। আপন দেশকে তিনি জানিয়েছেন, সববাধা ভেদ করেই এ খেলাপি প্রতিষ্ঠানটিকে ঋণ দিতে চান তিনি।
আরও পড়ুন<<>> ইসলামী ব্যাংকের জলিলকে ইসি চেয়ারম্যান পদ থেকে অপসারণ
অগ্রণী ব্যাংকে চৌধুরী এন্ড কোম্পানী লিমিটেডের বর্তমাণ ঋণের পরিমাণ প্রায় ৩০ কোটি টাকা। গত ১৭ বছরে প্রতিষ্ঠানটিকে একাধিকবার পুনঃতফসিলের সুযোগ দিলেও ঋণের টাকা পরিশোধ করেনি। উল্টো নতুন করে ৪০ কোটি টাকা ঋণ পেতে তোরজোর চালাচ্ছে প্রতিষ্ঠানটি। ঋণটি পাইয়ে দিতে খেলাপি ঋণকে নিয়োমিত দেখানো হয়েছে চেয়ারম্যানের নির্দেশে। এটি ব্যাংকিং আইন অনুযায়ী গুরুতর অনিয়ম।
এছাড়া ডিএমডি সহ কর্মকর্তারা পরিদর্শনে গেলে অন্য মালিকের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানকে নিজের ব্যবসা হিসেবে দেখিয়েছেন। পরিদর্শক দলের একাধিক কর্মকর্তা এ তথ্য স্বীকার করেছেন। এমনকি চেয়ারম্যানের কাছে বিষয়টি তুলে ধরলে তিনি স্বীকার করেন, চৌধুরী এন্ড কোম্পানির ব্যবসা বন্ধ থাকায় এখানে ভাড়ায় অন্য প্রতিষ্ঠান চলছে।
অগ্রণী ব্যাংকের একাধিক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, সংশ্লিষ্ট শাখার কোন সুপারিশ বা প্রস্থাব ছাড়াই চেয়ারম্যান ও চট্টগ্রামের সার্কেল জিএম মিলে এ প্রতিষ্ঠানকে ঋণ দিতে মরিয়া হয়ে উঠেছেন। অথচ রফতানির মাধ্যমে চৌধুরী এন্ড কোম্পানির অর্থ পাচারের অভিযোগ নিয়ে দুর্নীতি দমন কমিশন ( দুদক) তদন্ত করছে।
অগ্রণী ব্যাংক সূত্র জানিয়েছে, নতুন ঋণের জন্য ১৯৭৫ সালে নির্মিত ভবন ও ব্যবহার অযোগ্য যন্ত্রপাতি জামানত হিসেবে দিচ্ছে এ গ্রাহক।
যেভাবে অগ্রণী ব্যাংকে ঢুকল চৌধুরী এন্ড কোম্পানী
অগ্রণী ব্যাংক পিএলসি'র আগ্রাবাদ কর্পোরেট শাখায় চৌধুরী এন্ড কোম্পানী (বিডি) লিমিটেডের অনুকূলে সর্বপ্রথম ২০০৭ সালের ২৪ জানুয়ারি ১২ কোটি টাকা ঋণ দেয়া হয়। এ ঋণের মধ্যে পূবালী ব্যাংক থেকে প্রতিষ্ঠানটির দায়দেনা টেক-ওভার করা হয় ৮ কোটি টাকার। বাকি ৪ কোটি টাকা চলতি মূলধন হিসাবে বিতরণ করা হয়। প্রতিষ্ঠানটি পূবালী ব্যাংকে থাকা অবস্থায় রুগ্ন ছিল।
পূবালী ব্যাংক থেকে ঋণটি টেক-ওভারের সময় বর্তমান চেয়ারম্যান সৈয়দ আবু নাসের ব্যাংকের এমডির দায়িত্বে ছিলেন। তার তত্বাবধানেই রুগ্ন গ্রাহককে বিশেষ সুবিধা দেয়া হয়েছিল।
এদিকে অগ্রণী ব্যাংকে এ ঋণের সীমা দিন দিন বেড়েছে। ঋণগ্রহীতার আবেদনের প্রেক্ষিতে ২০১১ সালের ৫ এপ্রিল ১২ কোটি টাকার ঋণসীমা ১৮ কোটি টাকায় বর্ধিত করা হয়। যা সর্বশেষ ২০১৫ সালের ৩০ নভেম্বর মেয়াদে নবায়ন করা হয়েছিল।
বর্ধিত ৬ কোটি টাকা ঋণ দ্বারা ওই গ্রাহক মাত্র ৩ কোটি টাকার মাছ রফতানি করে। বাকি টাকা আত্মসাৎ করেছিল বলে দুদক সূত্রে জানা গেছে। বন্ধ প্রতিষ্ঠান মেসার্স চৌধুরী এন্ কোং লিমিটেডের অনুকূলে ২৫ কোটি ৮২ লাখ টাকা ঋণ প্রদানের বিষয়ে অগ্রণী ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের বিরুদ্ধে অভিযোগ পড়েছিল দুদকে। ২০১৫ সালেল ৩১ ডিসেম্বর প্রতিষ্ঠানের যাবতীয় তথ্য উপান চাওয়া হয় ব্যাংকের কাছে।
এ ঋণটি অনুমোদন থেকে বিতরণ পর্যন্ত বিভিন্ন অনিয়মের কারণে ২০১৫ সালের ১২ অক্টোবর একটি জাতীয় দৈনিকে সংবাদ প্রকাশিত হয়। যাতে অনিয়মের বিষয়টি বিস্তারিতভাবে তুলে ধরা হয়। এরপরও সর্বশেষ ২০১৫ সালের ৭ মে ১৮ কোটি টাকা ঋণসীমা ২৫ কোটি টাকায় বর্ধিত করা হয়।
পূবালী ব্যাংক থেকে টেক-ওভার করার চৌধুরী এন্ড কোম্পানির অনুকূলে তিন দফায় মোট ১৩ কোটি ৬০ লাখ টাকা চলতি মূলধন ঋণ বিতরণ করা হয়। ঋণগ্রহীতা ঋণের টাকা যথাযথভাবে ব্যবসায় বিনিয়োগ না করে ফান্ড ডাইভার্টের মাধ্যমে আত্মসাৎ করে। ফলে প্রতিষ্ঠানটি বন্ধ হয়ে যায় মর্মে অগ্রণী ব্যাংকের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।
এ প্রতিষ্ঠানের অর্থ আত্মসাতের বিষয়ে অগ্রণী ব্যাংক থেকে কেন্দ্রীয় ব্যাংকে একটি নথি গেছে। এতে বলা হয়েছে, মেসার্স চৌধুরী এন্ড কোম্পানী একটি ১০০% হিমায়িত মৎস্য রফতানিকারক প্রতিষ্ঠান। মঞ্চজুরীকৃত ১৩ কোটি ৬০ লাখ টাকার হিমায়িত মৎস্য রফতানি করা হলে রফতানি মূল্য বা এক্সপোর্ট প্রসিড আসেনি। ঋণগ্রহীতা ফান্ড ডাইভার্ট করে টাকা আত্মসাৎ করায় বর্তমানে ঋণ হিসাবে ২৯ কোটি ৯৩ লাখ টাকা দায়স্থিতি রয়ে গেছে।
আরও পড়ুন<<>> রাষ্ট্রায়ত্ত অগ্রণী ব্যাংক এখনো স্বাধীন হয়নি! পদোন্নতি মিলে তার ইশারায়
এদিকে নতুন করে ৪০ কোটি টাকা ঋণের জন্য গ্রাহকের আবেদনের প্রেক্ষিতে প্রধান কার্যালয়ের ইন্ডাস্ট্রিয়াল ক্রেডিট ডিভিশন-২ এর প্রকৌশলীরা কারখানা পরিদর্শন করেন। পরিদর্শনের ভিত্তিতে গত ৩ অক্টোবর একটি রিপোর্ট দিয়েছেন তারা। উক্ত রিপোর্টে কারখানার যন্ত্রপাতি ১৭ বছরের পুরাতন এবং প্রায় ব্যবহারের অযোগ্য মর্মে উল্লেখ করা হয়েছে। এছাড়া ২০১৩ সাল থেকে প্রতিষ্ঠানটি বন্ধ এবং বর্তমানেও ঋণগ্রহীতার ব্যবসা সম্পূর্ণরূপে বন্ধ আছে মর্মে ওই প্রতিবেদনে উল্লেখ আছে।
পরিদর্শন টিমের ‘না’, চেয়ারম্যানের ‘হ্যা’
ব্যাংক সূত্রে জানা যায়, মেসার্স চৌধুরী অ্যান্ড কোম্পানীকে নতুন ঋণ দেয়ার জন্য প্রস্তাব পাঠাতে আগ্রাবাদ কর্পোরেট শাখার কর্মকর্তাদের ওপর চাপ সৃষ্টি করছেন সার্কেল জিএম শামিম রেজা। শাখার উপ-মহাব্যবস্থাপক মোহাম্মদ ফয়ছল মোর্শেদ, চট্টগ্রাম সার্কেলের উপ-মহাব্যবস্থাপক সফিউল আজম ও আগ্রাবাদ কর্পোরেট শাখার এসপিও মোহাম্মদ শাহজাহানকে দুই বার প্রধান কার্যালয়ে ডেকে এনে রীতিমতো শাসিয়েছেন তিনি।
এদিকে গত ১৭ নভেম্বর অনুষ্ঠিত ক্রেডিট কমিটির সভায় শাখার প্রস্তাব ছাড়াই ঋণগ্রহীতা প্রতিষ্ঠানের অনুকূলে ৫ কোটি টাকা ঋণ অনুমোদন করা হয়। পরবর্তীতে ব্যাংকের চেয়ারম্যান আবু নাসের বখতিয়ার এ মেমো কাটাকাটি করে ৫ কোটির পরিবর্তে ৮ কোটি টাকা ঋণ অনুমোদন করেন৷
অগ্রণী ব্যাংকের কর্মকর্তারা বলেন, পরিচালনা পর্ষদের কোন চেয়ারম্যান নিজ হাতে কাটাকাটি করে ক্রেডিট কমিটির মেমো সংশোধন করেছেন- এমন নজির অগ্রণী ব্যাংকের ইতিহাসে নাই। অথচ বর্তমান চেয়ারম্যান ঋণগ্রহীতাকে নিয়মবহির্ভূতভাবে ঋণসুবিধা প্রদানের জন্য নিজ হাতে কাটাকাটি করে ক্রেডিট কমিটির মেমো সংশোধন করেছেন। কর্মকর্তা বলেন, দ্রুততার সঙ্গে একটি মৃত প্রতিষ্ঠানের অনুকূলে ঋণ অনুমোদন প্রচেষ্ঠার রহস্য কি? কোনো ভালো গ্রাহকের ঋণ প্রস্তাবও এত দ্রুততার সঙ্গে পর্ষদ সভায় উপস্থাপিত হয় না।
অগ্রণী ব্যাংকের চেয়ারম্যানের বক্তব্য
এ প্রসঙ্গে অগ্রণী ব্যাংকের চেয়ারম্যান সৈয়দ আবু নাসের বখতিয়ার আহমেদ আপন দেশকে বলেন, আমি চৌধুরী এন্ড কোং লিমিটেডকে টেকওভার করতে সহায়তা করেছি। তখন আমি এ ব্যাংকের এমডি ছিলাম।
তিনি বলেন, ব্যাংক চাইলে একটি প্রতিষ্ঠানকে বাঁচিয়ে রাখতে পারে আবার চাইলে পথেও বসাতে পারে। গত ১৫ বছরে রাজনৈতিক কারণেই অনেক প্রতিষ্ঠানকে বেকায়দায় ফেলা হয়েছে। তারমধ্যে মেসার্স চৌধুরী অ্যান্ড কোং লিমিটেডে একটি।
তিনি সাফ বললেন, যে যাই বলুক আমি এ প্রতিষ্ঠানকে ঋণ দিতে চাই। রাজনৈতিক কারণে বিগতদিনে আরও যেসব প্রতিষ্ঠান খেলাপি হয়েছে তাদেরকেও ঋণ দেব। এ সময় তিনি পারটেক্স বেভারেজ-এর এমডি রুবেল আজিজের নাম উল্লেখ করে বলেন, উনিও খেলাপি, তারপরও তাকে আমি ঋণ দেব...।
আপন দেশ/এবি
মন্তব্য করুন # খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, আপন দেশ ডটকম- এর দায়ভার নেবে না।