Apan Desh | আপন দেশ

শিক্ষা প্রকৌশলের প্রধান, হর্ষে আগমন বিষাদে বিদায়

বিশেষ প্রতিবেদক

প্রকাশিত: ১৬:৩০, ৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৫

আপডেট: ১২:০৭, ৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৫

শিক্ষা প্রকৌশলের প্রধান, হর্ষে আগমন বিষাদে বিদায়

বা থেকে- আলতাফ হোসেন, জালাল উদ্দিন, রায়হান বাদশা, দেলোয়ার হোসেন মজুমদার, আরিফুর রহমান, বুলবুল আখতার ও দেওয়ার মো. হানজালা। ফাইল ছবি

দেশের জাতীয় বাজেটে যে কয়টি খাতে বেশি বরাদ্দ রাখা হয় তারমধ্যে অন্যতম শিক্ষাখাত। এ বরাদ্দের বেশিরভাগ ব্যয় করা হয় শিক্ষা অবকাঠামো উন্নয়নে। যার চাবিকাঠি থাকে শিক্ষা প্রকৌশল অধিদফতরের (ইইডি) প্রধান প্রকৌশলীর হাতে।

স্বাভাবিকভাবেই ইইডির চিফের চেয়ারে বসতে লাগে বহুমাত্রিক যোগ্যতা। গত ১০ জন প্রধান প্রকৌশলীর আমলনামা বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, দায়িত্ব নেয়ার সময় তাদের হাতে দেয়া হয় ফুলের তোড়া। হর্ষে ভাসে অধিদফতর। কেউ মেয়াদকাল শেষ করতে পারেন আবার কারো বিদায় নিতে হয় মেয়াদপূর্তির আগেই। দায়িত্ব পালনকালে নিজ কর্মগুণের ফলভোগ করতে হয়। কারো নামে ঝুলছে বিভাগীয় মামলা। কারো চাকরি আছে কাজ নেই। কারো বরণটা হর্ষের হলেও বিদায়টা হয়েছে বিষাদের। ঘটা করে বিদায়মালা গলায় পরাতো দূরের কথা ‘ইজ্জত রক্ষাটাই’ ছিল বিধাতার কাছে পরম চাওয়া। 

আপন দেশ-এর খোঁজে এমন চিত্র মিলেছে গত ১০ জন প্রকৌশলীর বেলায়। 

মো. আলতাফ হোসেন

বর্তমানে ইইডির প্রধান প্রকৌশলী মো. আলতাফ হোসেন। গত ১৯ জানুয়ারি শিক্ষামন্ত্রণালয় তাকে প্রধান প্রকৌশলী (রুটিন দায়িত্ব) হিসেবে নিয়োগ দিয়েছেন। নিয়োগ ও যোগদানের তালিকা মতে ছয় সিনিয়র প্রকৌশলীকে সুপারসেড করে তিনি বাগিয়ে নিয়েছেন অধিদফতরের শীর্ষ পদ।

দায়িত্বের মাত্র দুই সপ্তাহ। এরই মধ্যে কব্জায় নিয়েছেন টপটু বটম। এদিকে শিক্ষা সংশ্লিষ্ট শীর্ষ পদগুলো নিয়ে প্রধান উপদেষ্টার প্রেসসচিব, বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির আহমেদ রিজভী চলমান বাস্তবতা প্রকাশ করেছেন।  

প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম গত ১৭ ডিসেম্বর বলেছেন, শিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং বিভিন্ন দফতরে প্রমোশন, বদলি ইত্যাদি ক্ষেত্রে বিশাল একটা ঘুষ ও কমিশন বাণিজ্য হয়। এ সেক্টরে যত ধরনের দুর্নীতি হয়, সে জায়গাটা আমরা চিহ্নিত করেছি। এটা নিয়ে কাজ হচ্ছে। 

আরেকধাপ এগিয়ে বলেছেন বিএনপির রিজভী আহমেদ। তার অভিযোগ, শিক্ষামন্ত্রণালয়সহ বিভিন্ন সেক্টরের শীর্ষপদে জামাতিকরণ করা হয়েছে। আলতাফ হোসেনের রাজনৈতিক আদর্শ রিজভী আহমেদের বিপরীত বলে জানা গেছে।

তিনি নাকি সৎ কর্মকর্তা, ইনসাফভিত্তিক কাজ করেন- এমন প্রশ্নের জবাবে একজন বড়মাপের ঠিকাদার এ প্রতিবেদককে বলেন,  ‘ঠিাকাদার ঠগ’ আমাদেরকে এ ট্যাগ দেয়া হয়। আমরা যদি ঠগবাজি করি তাহলে তাদেরকে নজরানা দিয়ে, দোয়া নিয়েই করি। শিক্ষা প্রকৌশলীর কাজ পেতে তো ধর্মমন্ত্রণালয়ে যেতে হয় না। পিসি (পারসেনটেজ) দিলে তো এদেরকেই দেই নাকি-পালটা প্রশ্ন রাখেন তিনি। তবে চলতি চীফকে বুঝতে কিছু সময় লাগবে বলে জানান ওই ঠিকাদার। 

মো. জালাল উদ্দিন চৌধুরী

চট্টগ্রামের সাতকানিয়ার বাসিন্দা মো. জালাল উদ্দিন চৌধুরী। প্রধান প্রকৌশলী ছিলেন (চলতি দায়িত্ব)। সহকারী প্রকৌশলী হিসেবে কর্ম শুরু ১৯৯৪ সালে ১৭ মার্চ থেকে। চুয়েট থেকে পাশ করা প্রকৌশলী জালাল উদ্দিন চৌধুরী যোগদানের পর থেকে বেশিরভাগ সময়ই ছিলেন নিজ বিভাগে। ৩১ বছরের মধ্যে কিছুদিনের জন্য ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় ছিলেন। বিদায়কালটা ঢাকায়। 

প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের চট্টগ্রামের সন্তান জালাল চৌধুরীকে প্রধান প্রকৌশলী করা হয়েছে ৫ জন সুপারসেড করে। তার মেয়াদ শেষ হয় ১৯ জানুয়ারি। আরও দুই বছরের চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের জন্য অপাত্রেজল ঢেলেছেন। তবে তা ধোপে টেকেনি। 

স্বল্প সময়ে অল্প অনিয়মে জড়িয়েছিলেন তিনি। মাতৃভাষা ইনস্টিটিউশনে দুটি প্রোগ্রাম করেছেন। তাতে মন্ত্রণালয়ের আমলা, পদস্থদের ভূরিভোজ করিয়েছেন। খরচ কয়েক লাখ হলেও উত্তোলন ছিল কোটির বেশি। ২/৩ জন বাদে দেশের ৬৫ তত্বাবধায়ককে নজরানা হিসেবে নগদ গুনতে জনপ্রতি ৩/৫ লাখ টাকা। 

নাম প্রকাশ না করার শর্তে একাধিক এক্সেন এ প্রতিবেদককে জানান, জনপ্রতি ৩ থেকে ৫ লাখ করে চাঁদা দিতে হয়েছে সাবেক প্রধান প্রকৌশলীর ফান্ডে। এছাড়াও বেশ কটি কাজের কমিশন গেছে সাবেকের পকেটে। অন্যদিকে চট্টগ্রামে বেনামে রয়েছে তার ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। চলতি প্রধান প্রকৌশলী সাবেকের পক্ষের ঠিকাদার সেকেন্ড লয়েষ্টধারীকে কাজ দিতে হুকুম দিয়েছেন ওই রেঞ্জের দায়িত্বপ্রাপ্তকে।

বাদশা এখন ‘সিংহাসনহীন’

১৯৯৪ সালের ৫ মার্চ সহকারী প্রকৌশলী হিসেবে যোগদান কারণে রায়হান বাদশা। অনিয়ম-দুর্নীতির দায়ে সাজাপ্রাপ্ত হয়েছিলেন বিএনপির আমলে। ঢাকাসহ ১৭ জেলার দায়িত্ব পালনকালে ছিলেন খুবই প্রভাবশালী। শেখ পরিবারের স্বজন লিটর চৌধুরীর আশীর্বাদে পদ্মা নদীর পানিকে বানাতেন বালু। যার তদন্ত হচ্ছে।

নো ম্যান্স ল্যান্ডে থাকা প্রধান প্রকৌশলীর পদটি গত ২৫ আগস্ট বাগিয়ে নেন। যোগ্যতা না থাকলেও বিশেষ সুবিধা সরবরাহ করেছেন বলে দফতরে চাউর আছে। তার দায়িত্বকালে আওয়ামী লীগের ঠিকাদারকে নানামুখী সুবিধা দেয়া হয়েছে। কাজ না করেই দেয়া হয়েছে ডজন ডজন চেক। যার আর্থিক ক্ষতির দায় টানতে হচ্ছে নবাগতদের।  

শেখ হাসিনার শাসন আমলে এ রায়হান বাদশার ছিল নামের সঙ্গে কাজের মিল। পুরো ইইডি চলতো তার বাদশাহী হুঙ্কারে। সকাল-বিকেল বদলাতেন বিলাসবহুল গাড়ি। এক দেহের জন্য বরাদ্দ নিয়েছিলেন দুই গাড়ি। একাধিক পাক-পেয়াদার সেবা নিতেন তিনি। 
অবশেষে অযোগ্যতার কারণে বঙ্গবন্ধু প্রকৌশলী পরিষদ নেতা বাদশার হাতে জুটেছে ওএসডির চিঠি। সঙ্গে জড়িয়েছেন আরও দুইজনকে। বসেনও একই কক্ষে। কালের এ বাদশার ডাকাডাকিতে এখন আর সাড়া দেন না পিয়নরাও। তবে পদবি, চেয়ার ও কক্ষ ছাড়লেও ছাড়েননি বিলাসবহুল গাড়ীটি। 

দেলোয়ার হোসেন মজুমদার

ইইডিতে যে কয়জন প্রধান প্রকৌশলীর আসা যাওয়া হয়েছে তার মধ্যে সবচেয়ে নেতিবাচক ইতিহাস বঙ্গবন্ধু প্রকৌশল পরিষদ নেতা প্রকৌশলী দেলোয়ার হোসেন মজুমদারের বেলায়। চাকরিজীবনে কাটিয়েছেন স্বর্ণযুগ। দেশের বিভিন্নস্থানে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেছেন। শেখ হাসিনার বিদায়ের পরই তার পদত্যাগ করতে হয়েছে। অধস্তন কর্মকর্তা-কর্মচারিদের রোষানল থেকে বাঁচতে কোনোমতে নীচু মাথায় চেয়ার ছেড়ে বাসায় গেছেন মজুমদার।

তৎকালীন শিক্ষামন্ত্রী দীপুমনি ও নওফেলের চাহিদা মিটিয়ে দুই বছরের জন্য চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দিয়েছিলেন দেলোয়ার হোসেনকে। দেলোয়ার এতো দুর্নীতি, ক্ষমতার অপব্যবহার ও নৈতিকস্থলন ঘটিয়েছিলেন যে, তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা হয়। 

বঙ্গবন্ধুর আদর্শের দাবিদার হলেও তার ম্যুরাল তৈরির জন্য বরাদ্দ পকেটস্থ করেছিলেন ঠিকাদার। পরে চাপের মুখে রাষ্ট্রীয় কোষাগারে আংশিক ফেরত এসেছে।  

আরিফুর রহমান

ইইডির তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী ছিলেন মো. আরিফুর রহমান। পদোন্নতি দিয়ে করা হয় অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী। এরপর প্রধান প্রকৌশলী (চলতি দায়িত্ব) হিসেবে তাকে দায়িত্ব দেয়া হয়। ঘটনা ২০২০ সালের ২২ ডিসেম্বরের।

তার আগের ভারপ্রাপ্ত প্রধান প্রকৌশলী বুলবুল আখতার অবসরে যান ওই বছরের ১৯ নভেম্বর। এরপর থেকে প্রধান প্রকৌশলীর পদ শূন্য ছিল। ফলে ডিসেম্বরের টেন্ডার আবাসনসহ অন্যান্য আর্থিক সব কাজ বন্ধ থাকে। যথাসময়ে টেন্ডার আবাসনসহ বিভিন্ন সমস্যা দেখা দেয়। পরিস্থিতি সামাল দিতে প্রধান প্রকৌশলীর রুটিন দায়িত্ব দিয়ে অফিস আদেশ জারি করা হয়।

তবে এ রুটিন দায়িত্ব দেয়া নিয়ে অতিরিক্ত প্রকৌশলীদের মধ্যে দেখা দেয় অসন্তোষ। অভিযোগ উছে জ্যেষ্ঠ তালিকার ৬ নম্বরের আরিফুরকে ওই পদে বসানো হয়েছিল। তবে ওই পদে চিঠি পাবার কথা ছিল প্রকৌশলী শাহ্ নইমুল কাদেরের। তৎকালীন শিক্ষামন্ত্রীর অনুপস্থিতিতে উপমন্ত্রী বাগিয়ে দিয়েছিলেন প্রমোশনের চিঠি। 

বুলবুল আখতার

ইইডি দীর্ঘকালে পেয়েছিল একজন নারী প্রধান প্রকৌশলী (ভারপ্রাপ্ত)। নাম বুলবুল আখতার। ২০১৯ সালের ২২ আগস্ট দায়িত্ব পান। অবসর নিয়েছেন পরের বছর ১৯ নভেম্বর। অধিদফতরের পিয়ন থেকে শুরু করে প্রকৌশলী। এমন কেউ নেই তার বকুনির শিকার হয়নি। একাই দুই বিলাসবহুল গাড়ি চালানো নিয়ে টু শব্দ করতে গিয়ে তার হেনস্তার শিকার হয়েছেন একাধিক প্রকৌশলী। তবে তিনি রহস্যজনক কারণে মাত্রাতিরিক্ত সুবিধা দিতেন প্রকৌশলী ওবায়দুর রহমানকে। তাদের নিয়ে নানা মুখরোচক কথা এখনো নতুন। খারাপ ব্যবহারের কারণে তার বিদায়টাও তেমনই হয়েছে। অবসরে আগে প্রকৌশলী বুলবুল আখতারের বিরুদ্ধে জামায়াত সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ করা হয়েছিল শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে। 

শাহ নঈমুল কাদের ১৯৯৪ সালের ৩মার্চ যোগদান করে চাকরিতে। আলোচ্য ১০ প্রধান প্রকৌশলীর মধ্যে সবচেয়ে খরায় দায়িত্ব পালন করেছেন তিনি। কারণ তার নিয়োগ হয়েছিল অর্থ বাজেটের শেষের দিকে। আর অবসরে গেছেন বাজেটের শুরুতেই। সুপারসেডের শিকার হলেও স্বসম্মানে বিদায় নিতে পেরেছেন তিনি।   

দেওয়ান মো. হানজালা

১৯৮১ সালের ১২ ডিসেম্বর চাকরিতে যোগদান করেন দেওয়ান মো. হানজালা। ইইতিতে প্রধান প্রকৌশলীদের মধ্যে সবচেয়ে আলোচিত তিনি। শিক্ষাঙ্গনের বহুতল ভবনের নামফলকে তাকালেই মিলবে উদ্বোধকের নামের পরই দেওয়ান মো. হানজালার নাম। শিক্ষা অধিদফতরে ৩ হাজার ৫০০ পদ সৃষ্টি করেছেন। তার আমলেই ডিজিটালাইজড হয়েছে টেন্ডারসহ বিভিন্ন কাজ। তবে তিনিও সমালোচনার ঊর্ধ্বে ছিলেন না। বয়স বাড়িয়ে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ নেয়া অভিযোগ তার বিরুদ্ধে। হানজালার ভাই-ভাবীও ঠিকাদারি ব্যবসা করতেন প্রতাবের সঙ্গে। তার বিরুদ্ধে অনেক অভিযোগও ছিল শিক্ষামন্ত্রীর টেবিলে। 

দেওয়ান হানজালাকে নিয়ে একজন আমলার উক্তি হলো, ‘বেশি কাজে সুনাম যেমন কমিশনের দুর্নামও তেমনই‘

আব্দুল্লাহিল আজাদ

১৯৭৮ সালের ১৭ জুলাই যোগদান করেন আব্দুল্লাহিল আজাদ। তখন সহকারী প্রকৌশলী। কালের আবর্তে শিক্ষা প্রকৌশল অধিদফতরে প্রধান হিসেবে আসেন এডহক ভিত্তিতে। অনেকটাই স্বচ্ছাতার সঙ্গে মেয়াদ পার করেছেন তিনি। 

আজাদের আগে ছিলেন প্রকৌশলী মিজানুল করিম। তৎকালে দলবাজী কিংবা দুর্নীতিকে ঘৃণার চোখে দেখতেন সংশ্লিষ্টরা। 

আপন দেশ/এবি

মন্তব্য করুন # খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, আপন দেশ ডটকম- এর দায়ভার নেবে না।

শেয়ার করুনঃ

সর্বশেষ

জনপ্রিয়