Apan Desh | আপন দেশ

জামালপুর জনস্বাস্থ্যের কোটিপতি অফিস সহকারী হোয়াইট বাবু ছায়া নির্বাহী!

শওকত জামান, জামালপুর থেকে

প্রকাশিত: ২০:১৮, ২১ মার্চ ২০২৫

আপডেট: ০১:০১, ২২ মার্চ ২০২৫

জামালপুর জনস্বাস্থ্যের কোটিপতি অফিস সহকারী হোয়াইট বাবু ছায়া নির্বাহী!

জামালপুর শহরের বোষপাড়ার জনস্বাস্থ্য নির্বাহী প্রকৌশলীর বাসায় থাকেন অফিস সহকারী জাহাঙ্গীর কবির বাবু ওরফে সাদা বাবু ওরফে হোয়াইট বাবু। ছবি: আপন দেশ

শেখ হাসিনার জামানায় গোপালগঞ্জের পরই বেশি বরাদ্দ জামালপুরে। ওই বরাদ্দের বেশিরভাগ আবার হলো জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদফতরে। হাজার হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ আর শতশত কোটি টাকা লোপাট হয়েছে রাষ্ট্রীয় এ প্রতিষ্ঠানে।

অনেক ঠিকাদার শতশত কোটি টাকার মালিক হয়েছেন আবার অনেকে সহায়সম্বল হারিয়েছেন এখানে, রাষ্ট্রের কোটি কোটি টাকা ব্যবহৃত হয়েছে ব্যক্তিমালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানে, ব্যাপক তছরুপ হয়েছে এখানে, সরকারি বিধিভঙ্গই নিয়মে পরিণত হয়েছে এখানে, এখানেই হরণ করা হয়েছে অনেক নারীর সম্ভ্রম। আর ছাপোষা অফিস সহকারী থেকে অর্ধশত কোটিপতি বনে গেছেন এ অফিসে অপকর্ম করেই। অনিয়ম-দুর্নীতির সজ্ঞায় যা যা পড়ে তার প্রায় সবকিছুই ঘটেছে এখানকার প্রতিষ্ঠানটিতে। তাতে রাজনৈতিক শেল্টার দিতেন পলাতক শাসক দলীয় মন্ত্রী, এমপি ও দলীয় ক্যাডাররা। 

ঘোষণা মতে, আজ আপন দেশ-এর পাঠাকের জন্য প্রকাশ করা হলো-এ অধিদফতরের অফিস সহকারীর কোটিপতিবনে যাবার তথ্য। 

জামালপুর জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদফতরের গাড়ি চালক ছিলেন তার বাবা আব্দুল হালিম। তাই জন্মস্থান ও বেড়ে উঠা অধিদফতরের কোয়ার্টারেই। কোটার জমানায় বাবার কোটায় অফিস সহকারীর চারকিটা পেয়েছেন তিনি। চাকরি শুরু ২০১৫ সালের ১মার্চে। কালের আবর্তে তিনি এখন প্রধান অফিস সহকারী। ১৩তম গ্রেডের কর্মচারী হলেও এ অধিদফতরের ইটপাটকেল থেকে ঠিকাদার সবাই জানে তিনিই ‘ছায়া নির্বাহী প্রকৌশলী’। কারণ এ অধিদফতরের নির্বাহী প্রকৌশলী সুলতান মাহমুদের আলো-অন্ধকারের সুকর্ম-কুকর্মের রাজসাক্ষী তিনিই। কখনো ঘটনার সহযোগি, কখনো অঘটনের উপাদান সরবরাহকারী আবার কখনো দুয়েমিলে করেছেন কু-কর্মগুলো। ফলে তার কব্জাতেই অফিসের প্রধান কর্তাটি। বদৌলতে বাস করছেন বড়স্যারের জন্য বরাদ্দকৃত বাড়িতে, চাষ করছেন সরকারি পুকুর। কর্মস্থল আর নিয়ন্ত্রণ অফিসে প্রায় একযুগ থাকায় আধিপত্যটাও গড়ে উঠেছে অপ্রতিরোধ্য। সব মিলিয়ে হাজারের অঙ্কে বেতন পাওয়া ছাপোষা ড্রাইভারের ছেলে এখন কোটিপতিবনে গেছেন। নাম জাহাঙ্গীর কবির বাবু। কুষ্ঠু রোগে আক্রান্ত হয়ে পুরোদেহ সাদা হওয়ায় তাকে কেউ চিনেন ‘সাদা বাবু’ নামে আবার কেউ ডাকেন ‘হোয়াইট বাবু’।

 আরও পড়ুন<<>> জামালপুর জনস্বাস্থ্যের এলিট দুর্নীতিবাজ ‘সুলতাননামা‘

মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর কবির বাবু ওরফে সাদাবাবুর দুর্নীতি অনিয়ম, কমিশন বানিজ্য, নিয়োগ তদবির ও পার্টনারে ঠিকাদারিসহ নানা অপকর্ম করে তিনি এখন  কোটি কোটি টাকার মালিক। দুদকের জাল ভেদ করতে নামে বেনামে জমি, বাড়ি, ব্যবসা বানিজ্যসহ বিপুল অর্থ সম্পদ গড়ে তুলছেন তিনি। তার জ্ঞাত আয় বহির্ভুত সম্পদের হিসাব সম্পদের বেশকটি ব্যাংকে খতিয়ে দেখলেই প্রমাণ মিলবে। 

পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে সরকারি কর্মচারি হয়েও আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে সরাসরি জড়িত তিনি। জেলা যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক ফারহান আহমেদের ভোজনবন্ধু পরিচয়ে প্রভাব, ঠিকাদার নিয়ন্ত্রণ, অনিয়ম, দুর্নীতির কাজে বিশ্বস্ত সহযোগীতা, বিশেষ চাহিদার বস্তু সাপ্লাই দিয়ে নির্বাহী প্রকৌশলী সুলতান মাহমুদের প্রিয়পাত্র হয়ে জনস্বাস্থ্য অফিসে দুর্দান্ত প্রভাব গড়ে তুলেন। 
                                                                                 জনপ্রকৌশলের প্রধান সহকারী জাহাঙ্গীর কবির বাবু ওরফে সাদা বাবু ওরফে হোয়াইট বাবুর রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের খন্ডচিত্র।
ঠিকাদার, অধিদফতরের একাধিক কর্মকর্তা-কর্মচারির দেয়া তথ্যমতে, নির্বাহী প্রকৌশলী সুলতান মাহমুদের অনিয়ম ও দুর্নীতির কার্যসাধনে মেশিন অফিস সহকারী জাহাঙ্গীর কবির হোয়াইট বাবু । তার ইশারা ছাড়া জনস্বাস্থ্যের অফিস আঙ্গিনায় একটি কর্মও সাধিত হয়না। তার আঙ্গুলের হেলনিতে চলে জনস্বাস্থ্যের অফিসিয়াল কার্যক্রম। ঠিকাদারী কাজ বন্টন, পার্সেন্টেন্স ঠিক করা, টেন্ডার ও কাজ বরাদ্দের মত ঠিকাদারদের ভাগ্য নির্ধারিত হয় অফিস সহকারী বাবুর হাত ধরে। যে কারণে নির্বাহী প্রকৌশলীর অফিস রুমের চেয়ে বাবুর টেবিলের চারপাশ জুড়ে বসে থাকে ঠিকাদাররা।  

বিজ্ঞপ্তিবিহীন কাজটি কতো পার্সেন্ট কমিশনে কাকে দিবেন, কার কাছে কাজ বিক্রি করবেন ঠিকাদার, ঠিকাদারি নয়া লাইসেন্স করা, নবায়ন, বাতিল, বিভিন্ন প্রকল্পের প্রশিক্ষণার্থীর তালিকা তৈরি নানা কাজের সুলতানি দায়িত্ব সম্পন্ন হয় হোয়াইট বাবুর কলমের খোচায়। তার কলমের প্রতি খোঁচার রেট হাজার থেকে কয়েক লাখ টাকা। 

আপন দেশ-এর অনুসন্ধানে তথ্য মিলেছে- বাবু নিজেও ঠিকাদারি করেন। তবে সেটা একটু প্যাচ দিয়ে। অন্য ঠিকাদারের লাইসেন্সে, ঠিকাদারদের সঙ্গে ঠিকাদারি কাজের পার্টনারে ও ঠিকাদারি কাজ বাগিয়ে দেয়ার চুক্তিতে পার্টনার থেকে ঠিকাদারি করছেন এমন তথ্য মিলেছে নাম প্রকাশ্যে অনিচ্ছুক জনস্বাস্থের তালিকাভুক্ত বেশকজন ভুক্তভোগী ঠিকাদারের কাছ থেকে। 

নির্বাহী প্রকৌশলী সুলতান মাহমুদ ২০২০ সালে যোগদান করার পর থেকে স্বল্পমূল্যে র প্রায় এক হাজারটি লেট্টিন বিনা টেন্ডারের, বিনা নোটিশে, বিনা বিজ্ঞাপনে মনোনীত কিছু ঠিকাদারকে শতকরা ১০ ভাগ উর্ধমূল্যে কাজ দেয়া হয়। এ কাজপ্রতি ১ হাজার টাকা উৎকোচ নিতেন তারা। এক প্রকল্পেই প্রায় ৩ কোটি টাকা গ্রহণ করে ক্যাশিয়ার আমিনুল ও সাদা বাবুসহ উর্ধতন-অধস্তনরা ভাগাভাগি করে নেন।

ইতোমধ্যেই জেলা শহরের বজ্রাপুরে কৃষিজমিসহ প্রায় দুই কোটি টাকার সম্পদ কিনেছেন আমিনুল। ক্রয় মূল্যের চেয়ে অধিক কম মূল্যে দলিল রেজিস্ট্রি করে সরকারকে রাজস্ব ফাঁকির আশ্রয়ও নিয়েছেন তিনি। 

সূত্রের দাবি, অধিদফতরের প্রত্যেকটি কাজের জন্য ঠিকাদার থেকে সুলতান মাহমুদের বেধে দেয়া কমিশনের চেয়ে অধিক গ্রহণ করতেন হোয়াইট বাবু। তবে এখানে সুলতান মাহমুদ নীরব থাকতেন। কারণ সুলতান মাহমুদ স্পর্শকাতর বিষয়ে বাবুর কাছে ধরা। যা সুলতান মাহমুদকে নিয়ে পরের পর্বে প্রকাশ করা হবে। 

জুলাইবিপ্লবের আগে হোয়াইট বাবুদের শেল্টার দিতেন, কাজ নিতেন, নারী কেলেঙ্কারি ধামাচাপা দিতেন আওয়ামী লীগের নেতারা। ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা পলানোর এখন ছায়া দিচ্ছেন বিএনপি-জামায়াত ও কথিত সমন্বয়করা। সুবিধাও নিচ্ছেন তথৈবচ।

আরও পড়ুন<<>> বসুন্ধরার পাচারের টাকায় তিন মহাদেশে আট সাম্রাজ্য!

গাছের আগাটার মতো শেকড়েরটাও হাতছাড়া করতে নারাজ অফিস সহকারী বাবু। বর্তমানে জনস্বাস্থ্য  অফিসের পুকুরে মাছ চাষের করেন তিনি। সরকারি পুকুর লিজ দেয়ার নিয়ম থাকলেও নির্বাহী প্রকৌশলী সুলতান মাহমুদ তার প্রিয়সহকর্মী বাবুকে গিফট করেছেন। রাষ্ট্রীয় নীতির তোয়াক্কা না করে মাছ চাষ করছেন বাবু। মাছ চাষের আয় সরকারি কোষাগারে জমা না পড়ে ঢুকছে বাবুর পকেটে। পুকুরে মাছ চাষ নিয়ে বিগত সরকারের আমলে শহর ছাত্রলীগের সভাপতি ফাহিম এলিটের হাতে চড়থাপ্পরও খেয়েছিলেন সাদাবাবু।

প্রকৌশলী সুলতান মাহমুদ অফিসচলাকালে অধিক সময় থাকেন অফিসের উপরের খাস কামরায়। আবার কখনো অফিসের বাইরে। ঠিকাদার, নেতা, সংবাদকর্মী বা অন্য কোন লোকজন সুলতানের সঙ্গে যোগাযোগ করতে হলে নিচে এ হোয়াইট বাবুর কাছে ধরনা দিতে হয়-হতো। আর হোয়াইট বাবু নির্বাহী প্রকৌশলীর শিখানো বুলি ছুঁড়েন। কমিশনের চুক্তিসহ সমাধান দিয়ে বিদায় করেন আগতদের। 

জানা যায়, দীর্ঘদিন ধরে এ হোয়াইট বাবু ঠিকাদার সিরাজের রূপসা কৌশলীর ও শেরপুরের ঠিকাদার লুৎফর রহমানের সঙ্গে পার্টনারশিপে ব্যবসা করে আসছেন। তাদের এ পার্টনারশিপের তালিকায় রয়েছে আমিনুল ক্যাশিয়ারও। ইতোমধ্যে সিরাজ ও ক্যাশিয়ার আমিনুল মিলে প্রায় কোটি টাকায় লেটেস্ট মডেলের নোয়া গাড়ি কিনেছেন। যার মালিকানা দেখানো হয় সিরাজ ঠিকাদারকে।

গভীর রাতে অফিসে বাবুর ডাক পড়ে নারী সহকর্মীদের

নাম প্রকাশ্যে অনিচ্ছুক ভুক্তভোগী নারীরা অভিযোগ করেন, জনস্বাস্থ্যের বিভিন্ন প্রকল্পে  প্রশিক্ষণে প্রশিক্ষণার্থীর তালিকা,মাঠ জরিপ কার্যক্রমেরও দায়িত্বপালন করেন প্রধান অফিস সহকারী জাহাঙ্গীর কবির বাবু। নারীদের প্রশিক্ষণের অংশ নেয়ার সুযোগ করে দিতে, গরীব দরিদ্র নারীদের বাড়িতে টিউবয়েল স্থাপনের অফার দিতেন। সঙ্গে দিতেন কু-প্রস্তাবও। 
অধিদফতরের বিভিন্ন প্রকল্পে অংশগ্রহনকারী আবাসিক প্রশিক্ষণার্থীদের জরুরি কাজের কথা বলে গভীর রাতে ডেকে আনা হতো অফিস রুমে। অবৈধ সম্পর্ক স্থাপন করেছেন একাধিক নারীর সঙ্গে। চাকরি হারানোর ভয়ে অনেকেই তখন মুখ খোলতেন না। 

আরও অভিযোগ হলো- বাবুর প্রস্তাবে ‘কবুল’ বলা বেকার শিক্ষিত নারীদের উপঢৌকন হিসেবে পাঠাতেন বড় স্যারের খাসকামরায়। 

জনস্বাস্থ্যের স্বল্পমুল্যে স্যানিটেশন প্রকল্পে মাঠ জরিপের কাজের দায়িত্বেও ছিলেন বাবু। বাড়ি বাড়ি জরিপের কাজে বেকার যুবতী লোভ লালসার ফাঁদে ফেলে সর্বনাশ করার অভিযোগ করেছেন বাবু গংরা। আপন দেশ-এর কাছে এমন তথ্য জানাতেই কেঁদে ফেলেন ভুক্তভোগী জনৈক নারী। 
চাকরি দেয়ার টোপে ফেলেও অসহায় মেয়েদের সর্বনাশ করারও অসংখ্য  অভিযোগ তথ্য অনুসন্ধান করে পাওয়া গেছে অফিস সহকারী বাবুর নামে। নারী কেলেংকারীর ঘটনা ধাপাচাপা দিতেন  ছাত্রলীগ ও যুবলীগের নেতাদের দিয়ে। বাবুর নারী কেলেংকারীর ঘটনা জনস্বাস্থ্য অফিস এলাকা, ঠিকাদার ও স্থানীয়দের মুখে মুখে। 

‘স্যার আপনার প্রতি নারাজ’

টেন্ডার হলে ঠিকাদারকে ভিড়তে হয় বাবুর কাছেই। টার্গেটের ঠিকাদারকে হঠাৎ করে আতঙ্কগ্রস্ত করে ফেলতেন। বলছেন, ‘এক্সেন  সাহেব আপনার উপর নারাজ, আপনাকে আর কাজ দিবেন না।’ ভীতিকর এ শব্দে ঠিকাদারের চোখ উঠঠে কপালে। প্রশ্ন ছিলো, ভাই তাহলে করনীয় কী? আতঙ্কগ্রস্ত ঠিকাদার ‘নারাজ’কে রাজী করার সরল পথ বাতলে দিতে বলেন বাবুকেই। তিনি যথাযথ অঙ্কের বিনিময়ে ভীতি কাটানোর ওষুধ দিতেন। এ ওষুধের উপাদান কখনো টাকা আবার কখনো নারী। বাবুর মহৌষধে সুফল পাওয়া একাধিক ঠিকাদার আপন দেশ-এর কাছে স্বীকার করেছেন। এ ভীতির ওষুধ সেবন করতে হয়েছে জনস্বাস্থ্যের উপজেলা লেভেলের কর্মকর্তাদেরও।

জাহাঙ্গীর কবির বাবুর বক্তব্য জানতে ফোন করা হয় তার ০১৭১৬----১৯ নম্বরে। ফোন বন্ধ থাকায় তার মন্তব্য নেয়া সম্ভব হয়নি। বাসাতেও নেই গতদিন থেকে।

পরের পর্বে পড়ুন ‘জনস্বাস্থ্যের এলিট দুর্নীতিবাজ সুলতাননামা’

আপন দেশ/এবি

মন্তব্য করুন # খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, আপন দেশ ডটকম- এর দায়ভার নেবে না।

শেয়ার করুনঃ

সর্বশেষ

জনপ্রিয়