
সুলতান মাহমুদ। ইনসেটে হোয়াইটবাবু। ছবি সংগৃহীত
পাবনার আলাউদ্দিন খাঁ ও পারুল খাঁ দম্পতির সন্তান সুলতান মাহমুদ খাঁ। সনদে বাদ দেয়া হয়েছে বংশ পদবির ‘খাঁ’ শব্দটি। কর্মস্থল থেকে বিদেশের মাটিতে তিনি পরিচিত সুলতান মাহমুদ হিসেবে। দু’দিন আগেও তিনি ছিলেন দুর্দান্ত প্রতাপশালী জামালপুর জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদফতরের নির্বাহীর দায়িত্বে। এই সুলতান মাহমুদ ওরফে সুলতান খাঁ। জনস্বাস্থ্যের পরিচিত ‘এলিট দুর্নীতিবাজ’ হিসেবে।
নিজ জেলার চাটমোহর উপজেলার হরিপুরের ফিরোজ হোসেন ও শাহানাজ পারভীন দম্পতির কন্যা মোছা. ফাল্গুনী নুপুরকে বিয়ে করেছেন সুলতান খাঁ। সুলতান-নুপুর দম্পতির দুই কন্যা সাদিয়া মাহমুদ নিক্কন ও সিনথিয়া মাহমুদ নিপুন। গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে পাসপোর্ট সম্পন্ন করেছেন পুরো পরিবারের।
রাজধানী ঢাকার বুকে বনানী, বারিধারা, তেজগাঁও, মিরপুরসহ বিভিন্ন স্থানে রয়েছে সুলতানের স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি। একাধিক বাসা-বাড়ি-গাড়ি। তাই নিন্মবিত্ত পরিবার এবং পাবনার নিরেট পল্লীর বাসিন্দা পরিচয় দিতে স্বস্তিবোধ করেন না হাজার কোটি টাকা মালিক বনে যাওয়া সুলতান খাঁ।
প্রকৌশলী ডিগ্রি অর্জনের পর থেকেই আকাশের দিকে তাকানো সুলতান খাঁ তার স্বপ্নকে বাস্তবায়ন করেছেন। গন্ডি এখন দেশ থেকে বিদেশ।
আপন দেশ ডটকমের অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে সুলতান মাহমুদের ভয়ঙ্কর অপকর্মের চিত্র। আজ পাঠকদের জন্য সুলতান খাঁ-কে নিয়ে ধারাবাহিকের প্রথম পর্ব।
যোগদানের তারিখটা ছিল ২০২০ সালের ২০ অক্টোবর। আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক জামালপুরের মির্জা আজম এ সুলতান মাহমুদকে জেলা জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদফতরের নির্বাহী দায়িত্বে বসান। শর্ত ছিলো ‘দিয়ে খাবার’। শেখ হাসিনার বাবা বঙ্গবন্ধু প্রকৌশল পরিষদের নেতা ছিলেন সুলতান। মির্জা আজমের পাওয়ার আর দলীয় প্রভাব-দু’য়ে মিলে ঐশ্বরিক ক্ষমতা অর্জন করেন সুলতান মাহমুদ। অধিদফতরের উপরের ‘খাস কামরা’তে বসে ধরাকে সরাজ্ঞান করেছেন এ প্রকৌশলী। শুধু জেলাই নয় কন্ট্রোল করতেন কেন্দ্রীয় অফিসও।
আরও পড়ুন<<>> জামালপুর জনস্বাস্থ্যের কোটিপতি অফিস সহকারী হোয়াইট বাবু ছায়া নির্বাহী!
জামালপুরের অধিদফতরের এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে আপন দেশকে জানান, হাত ঘুরিয়ে ‘নিজের প্রতিষ্ঠান’কে ঠিাকাদারি কাজ দিতেন অধিদফতর প্রধান সুলতান। পছন্দের ঠিকাদারকে দেয়া কাজে নিতেন ১০ থেকে ২০ পারসেন্ট কমিশন। বদৌলতে দিতেন ১০-১৫ পার্সেন্ট উর্ধদর (এভাব)। সরকারি মাল দরিয়া মে ঢাল’ নীতিকে লোপাট করেছেন শতকোটি টাকা।
অনুসন্ধানে জানাযায়, সরকারি বিধি নিষেধ থাকার অন্যের নামে গড়ে তোলেছেন ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। যার নামে প্রতিষ্ঠান গড়েছেন, যার অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে দেশের অভ্যন্তরে লেনদেন এবং-বিদেশে টাকা পাচার করেছেন তাকে দিচ্ছেন মাসিক লাখ টাকা বেতন।
নিজে কাজ দিতেন আর স্ত্রী ফাল্গুনী নুপুর গুনে নিতেন কমিশনের টাকা। দেখাশুনা করেন ঠিকাদার চরিত্রে প্রক্সি দেয়া ভাড়াটেদের। দেশের বিভিন্ন প্রান্তে স্বচরিত্রের সহকর্মীদের সমন্বয়ে গঠিত সিন্ডিকেটের মাধ্যমে প্রায় হাজার কোটি টাকার মালিক মধ্যবিত্ত পরিবারের সুলতান মাহমুদ ওরফে সুলতান খাঁ।
সনদ জালিয়াতি
জেলা জনস্বাস্থ্যের বরাদ্দকৃত অর্থের বেশিরভাগ কাজ করেছে ৬/৭টি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। এরমধ্যে ঝামেলা এন্টারপ্রাইজ, মেসার্স রূপসা প্রকৌশলী, মোহাম্মদ লুৎফর রহমান, মেসার্স তাই. বি কনস্ট্রাকশন, মেসার্স আকরাম হোসেন, আরজু কনস্ট্রাকশন, মেসার্স এমকে ট্রেডার্স ও মেসার্স লাবনী এন্টারপ্রাইজ অন্যতম।
শেখ হাসিনার দখলি জামানায় দলীয়দের মধ্যে হলেও কাজ বন্টনের স্বচ্ছতার জন্য ই-টেন্ডারের বিধান করা হয়েছিল। তবে সেটা জামালপুরের এ দফতরে ছিল না। কিছু কাজের জন্য এনালগে টেন্ডার আহবান করা হতো। আর বেশিরভাগ ছিলো টেবিল টেন্ডার। তাতে অংশ নিয়েছে উল্লিখিত ঠিকাদার।
আপন দেশের অনুসন্ধানে মিলেছে, কাজ পেতে একাধিক ঠিকাদারের অভিজ্ঞতা সনদ জাল করা হয়েছে। যার নিয়ন্ত্রণ ছিল সুলতান মাহমুদের হাতে। সংশ্লিষ্ট ফাইল তলব করলেই এর সত্যতা মিলবে। আর জালিয়াতিতে সহায়তা করেছেন প্রধান সহকারী জাহাঙ্গীর কবির বাবু ওরফে সাদা বাবু ওরফে বড় বাবু ওরফে হোয়াইট বাবু। তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করলেই সত্য মিলবে।
ষ্ট্যান্ড রিলিজের নথি বাধেন আজমের লাল ফিতায়
সাবেক প্রতিমন্ত্রী মির্জা আজমের ভাই মির্জা সোহেলের প্রতিষ্ঠান মেসার্স লাবনী এন্টারপ্রাইজ, মেলান্দহ উপজেলা আওয়ামী লীগ নেতা আরজুর প্রতিষ্ঠান আরজু কনস্ট্রাকশন, জেলা ছাত্রলীগ নেতা কাঞ্চনের প্রতিষ্ঠান মেসার্স তাই. বি কনস্ট্রাকশনসহ ৩/৪টি প্রতিষ্ঠানের নামে মাসে বেশ কয়েকটি করে কাজ দেয়া হতো। যা মাসের মোট কাজের ২৫/৩০ ভাগ। শহরের পাওয়ার হাউজের জলপান শেষের মিটিংয়ে মির্জা আজমকে জানানো হতো সব কাজই তার দলীয় লোকজনকে দেয়া হচ্ছে।
আলোচিত তমা গ্রুপের চেয়ারপারসন মোহাম্মদ আতাউর রহমান ভূঁইয়ার (মানিক) উপস্থিতিতে জনৈক ছাত্রলীগ নেতা মির্জা আজমকে জানান, সুলতান মাহমুদ তাকে বোকা বানাচ্ছেন। মোট কাজের অর্ধেকের বেশি নিচ্ছেন সুলতান তার আশ্রিত ঠিকাদারকে দিচ্ছে। মাসিক কাজের হিসেবে অভিযোগের সত্যতা মিলে। ওই রাতেই স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্তজনকে মির্জা আজম প্রকৌশলী সুলতানকে ষ্ট্যান্ড রিলিজের সুপারিশ করেন। এ খবরে ধূর্ত সুলতান জেলা আওয়ামী লীগ নেতা পৌরসভার মেয়র ছানোয়ারসহ আরও দুজন নেতাকে ম্যানেজ করেন। তাদের অনুরোধে পরদিন সকালে অপর ফোনে ওই ফাইল লালফিতায় বেধে রাখার নির্দেশ দেন মির্জা আজম।
ফেঁসে যাচ্ছেন ‘হোয়াইট’ বাবু- ক্যাশিয়ার আমিনুল
বদলি হয়েছেন সুলতান মাহমুদ। গত রোববার (২৩ মার্চ)। স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের স্থানীয় সরকার বিভাগের উপসচিব হাসান হাবিব স্বাক্ষরিত একটি প্রজ্ঞাপনে সুলতান মাহমুদকে জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদফতরে (ডিপিএইচই) সংযুক্ত করা হয়েছে। ওইদিন থেকেই অতিরিক্ত দায়িত্ব পালন করছেন জনস্বাস্থ্যে প্রকৌশল ময়মনসিংহ সার্কেলের প্রকৌশলী সামিউল হক। ময়মনসিংহ সার্কেল অফিসে বসেই দায়সারা দায়িত্ব দিয়েছেন সুলতান মাহমুদ। দায়িত্ব হস্তান্তরের জন্য জামালপুর আসেননি।
প্রকৌশলী সামিউল হক আপন দেশকে বলেন, গত ২৩ মার্চ আমি দায়িত্ব নিয়েছি। একটা ভিন্ন পরিস্থিতে অর্পিত দায়িত্ব যথাযথ পালন করবেন বলে আশাব্যক্ত করেন সামিউল হক।
দফতর সূত্র জানিয়েছে, সুলতান মাহমুদের বেনামি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের জালিয়াতির ফাইলগুলো দেখভাল করেন সাদাবাবু। কোথায় কোন দুর্নীতি হয়েছে তা বাবুর নখদর্পনে। নতুন নির্বাহী যেকোনো ফাইল তলব করতে পারেন এজন্য ইতোমধ্যে বেশ কিছু ঝামেলার ফাইল গায়েব করেছেন। সুলতান জামালপুর ছাড়তে পারলেও তার দুই খলিফা ঘুষ কালেক্টর সাদা বাবু ও ক্যাশিয়ার আমিনুল ফেঁসে যাচ্ছেন। এমন শঙ্কার কথা জানিয়েছেন ঠিকাদাররা।
সুলতানকে খুজঁছেন ঘুষ-কমিশন দাতারা
সাবেক ছাত্রলীগ ও বর্তমান বঙ্গবন্ধু প্রকৌশল পরিষদ নেতা সুলতান মাহমুদের আমলনামা এখন সচিবালয়ে অগ্নিকাণ্ড তদন্তকারী দলের হাতে। শুরুতেই ফলাও করে আসতে থাকে এ প্রকৌশলীসহ অন্যদের নাম। তবে ‘টাকার চাঁদর’ দিয়ে মুড়িয়ে রেখেছেন ওই ফাইল। ঘনিষ্ঠজনদের কাছে সুলতান শেয়ার করেন উপদেষ্টা ও সমন্বয়ককে ম্যানেজ করার কথা।
ওদিকে জামালপুরে নতুন কাজ দেয়ার জন্য অগ্রিম কমিশন নিয়েছেন সুলতান মাহমুদ। অনেক ঠিকাদারকে কাজ দিয়েছিলেন। কিন্তু ২০/২৫ ভাগ কাজ চলার পর তা বাতিলের নজির স্থাপন করেছেন তিনি। এতে করে বেশ কয়েকজন ঠিকাদার ফতুর হয়েছেন। বদলির খবরে সুলতানকে খুঁজছেন ঘুষ-কমিশন দাতারা। আজ মঙ্গলবার (২৫ মার্চ) দুজন ঠিকাদার রাজধানীর কাকরাইলে জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদফতরে সুলতানের অবস্থান জানতে আসেন।
সুলতান মাহমুদের বক্তব্য জানতে ০১৭১৩ - - - - ৭৩ নম্বরে কল করা হলেও তিনি রিসিভ করেননি। একই নম্বরে হোয়াট্স অ্যাপে ক্ষুদেবার্তা পাঠানো হয়। তাতেও তিনি কোনো ফিরতি বার্তা পাঠাননি।
আপন দেশ-এর পাঠাকদের জন্য দীর্ঘ অনুসন্ধানে প্রাপ্ত তথ্যে ‘জনস্বাস্থ্যের এলিট দুর্নীতিবাজ সুলতাননামা’ শীর্ষক ধারাবাহিক প্রতিবেদন পড়তে সঙ্গে থাকুন।
আপন দেশ/এবি
মন্তব্য করুন # খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, আপন দেশ ডটকম- এর দায়ভার নেবে না।