
পটুয়াখালী এলজিইডি’র সিনিয়র সহকারী প্রকৌশলী মীর শাকের আলী
গত বছরের ৫ আগষ্টের পর পালিয়ে যাওয়া মিরাজ-মহারাজের লুটপাটে জড়িত ১৩ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিয়েছে সরকার। তবে এখনো অনেকেই রয়েছেন ধরা ছোঁয়ার বাইরে। তাদেরই একজন পটুয়াখালী এলজিইডি’র সিনিয়র সহকারী প্রকৌশলী মীর শাকের আলী। চিহ্নিত কয়েকটি লাইসেন্সে শতশত কোটি টাকার কাজ দিয়ে হাতিয়ে নিয়েছেন কোটি কোটি টাকা। কেউ এ আবদার মেটাতে ব্যর্থ হলে তাকে পদে পদে হয়রানির শিকার হতে হয়। মীর শাকের আলীর কাছে জিম্মি পটুয়াখালীর সাধারণ ঠিকাদাররা।
আওয়ামী লীগের দোসর হয়ে এখনো তিনি কিভাবে বহল তবিয়তে থেকে তাদের বিশেষ সুবিধা দিচ্ছেন। তা নিয়ে দেখা দিয়েছে প্রশ্ন।
শেখ হাসিনা সরকারের আমলে মোটা অংকের টাকা দিয়ে ২০২১ সালের ২৩ জুন পটুয়াখালী এলজিইডিতে সিনিয়র সহকারী প্রকৌশলী হিসেবে যোগদান করেন মীর শাকের আলী। সিনিয়র সহকারী প্রকৌশলী হিসেবে দরপত্রের সকল কার্যক্রম নিজের আয়ত্তে থাকায় ওপেন টেন্ডার ম্যাথট ( ওটিএম ও ওয়েস্ট টিএম) কাগজপত্রে কোনো ত্রুটি না থকলেও নিজে কৃত্রিম ত্রুটি সৃষ্টি করেন। সঠিক দরদাতাকে কার্যাদেশ না দিয়ে টাকার বিনিময়ে যাকে খুশি তাকে কাজ দিয়েছেন। চিহ্নিত কয়েকটি লাইসেন্সে শতশত কোটি টাকার কাজ দেয়া হয়েছে।
এসব লাইসেন্সে অতিরিক্ত উন্নয়ন কাজ দেয়ায় বছরের পর বছর অনেক কাজ পড়ে রয়েছে। ইতোমধ্যে মিরাজ- মহারাজের মালিকানাধীন ইফতি লি. এর কিছু কিছু কাজ বাতিল করেছে এলজিইডি। দক্ষিণাঞ্চলের আয়রন ব্রিজ নির্মাণ ও পুণঃনির্মাণ প্রকল্পে টেন্ডারে অংশ নেয় মনির হোসেন বাদল নামে এক ঠিকাদার। নিম্মদরদাতা নির্বাচিত হলেও তাকে কাজ না দিয়ে সে কাজ দেয়া হয় অন্য একজনকে। এ ঘটনায় পরে ওই ঠিকাদার আদালতে মামলা করেন।
আরওপড়ুন<<>>প্রকৌশলী সুলতানের জালিয়াতি-লোপাটের ভয়ঙ্কর চিত্র, ফাঁসছেন দুই সহযোগি
তৎকালীন নির্বাহী প্রকৌশলী মো. লতিফ হোসেনের ব্যস্ততার সুযোগে মীর শাকের আলী পুরো টেন্ডার প্রক্রিয়া নিজের কব্জায় নেয়। টাকার বিনিময়ে যাকেতাকে কাজ দিয়ে হাতিয়ে নেন কোটি কোটি টাকা। ১০% বারের টেন্ডারে টাকা নিয়ে ২/৩ চিহ্নিত ঠিকাদারকে রেট ও বিল প্রদানে ১ থেকে ২% পিসি আদায়। নিম্মদরদাতা ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তি করে কাজ ভেদে ১ থেকে ৩% পর্যন্ত টাকা আদায়, এলটিএম ( লিমিট টেন্ডার ম্যথোট), ওটিএম ( ওপেন টেন্ডার ম্যাথোট) এবং ওসটিম সর্বনিম্ম দরদাতা নির্বাচিত হলে তাকে ফোন দিয়ে প্রথমে তার সঙ্গে দেখা করার আহবান জানান শাকের আলী। পরে টেন্ডারে ভুয়া ত্রুটি সৃষ্টি করে মোটা অংকের টাকা দাবি করেন তিনি।
এলটিএম টেন্ডারে সর্বনিম্ম দরদাতা ২/৩ প্রতিষ্ঠানের কাছে ২০২২ সালে দাবিকৃত টাকা দিতে অস্বীকার করায় ওই টেন্ডার বাতিল করে দেন এ সিনিয়র সহকারী প্রকৌশলী। এ নিয়ে এলজিইডিতে হৈ চৈ শুরু হয়। পরে ঘটনা বেগতিক দেখে ২টি কাজ দিয়ে ঘটনার সামাল দেন তৎকালীন নির্বাহী প্রকৌশলী মো. লতিফ হোসেন।
এসব অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগে গত বছরের ২ জুলাই তৎকালী প্রধান প্রকৌশলী মো. আলী আকতার হোসেন মীর শাকের আলীকে পটুয়াখালী এলজিইডি থেকে সদর দফতরে সিনিয়র সহকারী প্রকৌশলী হিসেবে বদলির আদেশ দেন। ৪৬,০২,০০০০,০০১,৯৯,২৫৫,১৯,৮৪৯৯ স্মারকের এক অফিস আদেশে মীর শাকেরকে দ্রুত সময়ে PMIS এর মাধ্যমে ছাড়পত্র গ্রহণ ও যোগাদানের জন্য আদেশ দেয়া হয়। কিন্তু তিনি এ আদেশ অমান্য করেন। অদৃশ্য শক্তির জোরে ১৯ দিনের মাথায় প্রধান প্রকৌশলী মো. আলী আকতার হোসেনকে দিয়েই সে বদলির আদেশ বাতিল করে পটুয়াখালী এলজিইডিতে স্বপদে বহাল থেকে যান।
মীর শাকের আলী পিরোজপুরের ইন্দরকাণী উপজেলায় ২০১৩- ২০১৬ ও ২০১৯ সালে নাজিরপুর উপজেলা ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ওয়েডিং ও আম্ফান IRDP প্রজেক্টসহ পিরোজপুর এলজিইডির বিভিন্ন প্রকল্প থেকে মিরাজ-মহারাজরা ১ হাজার ৬৮৬ কোটি আত্মসাত করেন। এর মধ্যে মীর শাকের ইন্দরকানী ও জিয়ানগরে থাকালীন সময়ে প্রায় ২শ’ কোটি টাকা আত্মসাৎ করেন বলে গণমাধ্যম কর্মীদের জানান নাম প্রকাশ না করার শর্তে সংশ্লিষ্ট কয়েক কর্মকর্তা।
আরওপড়ুন<<>>জামালপুর জনস্বাস্থ্যের কোটিপতি অফিস সহকারী হোয়াইট বাবু ছায়া নির্বাহী!
গত বছরের ৫ আগষ্ট শেখ হাসিনার পতন হলে মিরাজ-মহারাজের মহাদুর্নীতি প্রকাশ্যে আসে। কাজ না করে টাকা নিয়ে যাওয়ায় প্রকল্প পরিচালক আ. হাই ও মোহাম্মদ আদনান আকতারুল আজম এবং নির্বাহী প্রকৌশলী আব্দুস সত্তার হাওলাদার, সুশান্ত রঞ্জন রায়, সিনিয়র সহকারী প্রকৌশলী মো. আরিফুল ইসলাম, উপ সহকারী প্রকৌশলী আবুল কালাম আজাদ, মো রুবায়েত তালুকদার, মো শফিকুজ্জামান, মো. বদরুল আলম, হিসাবরক্ষক হুমায়ুন কবির, একেএম মোজাম্মেল হক খান, মো. আনোয়ারুল ইসলাম এবং সার্ভেয়ার শাহানুর আলমকে কর্মকর্তাকে দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা ও তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়।
স্থানীয় সরকার বিভাগের যুগ্ম-সচিব মো. কামরুজ্জামান স্বাক্ষরিত এক চিঠিতে এ আদেশ দেয়া হয়। এদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া হলেও মীর শাকের আলী থেকে যান ধরা-ছোঁয়ার বাইরে। মিরাজ-মহারাজের সঙ্গে ঐক্য করে অনিয়ম-দুর্নীতির মাধ্যমে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেন শাকের। বগুড়া ও ঢাকায় বাড়ি-গাড়িসহ গড়েছেন সম্পদের পাহাড়। শ্বশুরবাড়ি ও নিজের আত্মীয়-স্বজন দিয়ে ব্যবসা বাণিজ্য চালাচ্ছেন বলেও বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে।
সিনিয়র সহকারী প্রকৌশলী মীর শাকের আলীর বিরুদ্ধে এসব অভিযোগের তথ্য সংগ্রহ করতে পিরোজপুর ও পটুয়াখালীতে অনুসন্ধানে গেলে জুয়েল নামে তার শ্যালককে দিয়ে হোয়াটসঅ্যাপে ফোন দিয়ে শাকের আলীকে নিয়ে ঘাটাঘাটি না করার জন্য বিভিন্নভাবে হুমকি দেন।
এসব অভিযোগের বিষয়ে জানতে এলজিইডির সিনিয়র সহকারী প্রকৌশলী মীর শাকের আলীর দফতরে কয়েক বার গিয়েও তাকে না পেয়ে তার সরকারী মোবাইল নম্বরে ফোন দিলেও তিনি ফোন রিসিভ করেননি।
এ বিষয়ে এলজিইডির বরিশাল ডিভিশনের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী শেখ মো. নুরুল ইসলাম বলেন, আমার কাছে এ ধরনের কোনো অভিযোগ নেই। আমি আপনার কাছ থেকে প্রথমে জানলাম। লিখিত অভিযোগ পেলে তার ( সিনিয়র সহকারী প্রকৌশলী মীর শাকের আলী) বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়ার কথাও বলেন তিনি।
আপন দেশ/এমএস
মন্তব্য করুন # খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, আপন দেশ ডটকম- এর দায়ভার নেবে না।