
ছবি: আপন দেশ
দেশের প্রাচীনতম রাজনৈতিক দল বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ। কালে কালে নানামুখী ভূমিকা রেখেছে। আলোচনা-সমালোচনার মুখোমুখি হয়েছে অনেকবার। গত জুলাই-আগষ্ট গণঅভূত্থানে দলটির শীর্ষনেতা থেকে শুরু করে শেষ সারির নেতাকর্মীকে নিষিদ্ধ করেছে জনতা। রাজনীতির মাঠ ছেড়েছে আওয়ামী লীগ। রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ও বোদ্ধাদের ধারণা- এবার দলটি যাচ্ছে ইতিহাসের পাতায়। অন্যদিকে, আদালতের খাতায় এখনও নিষিদ্ধ জামায়াত প্রায় দেড়যুগ পর ফিরে পেয়েছে রাজনৈতিক প্রাণ।
২০১৩ সালে বাংলাদেশের অন্যতম রাজনৈতিক দল জামায়াতে ইসলামীর নিবন্ধন বাতিল করে শেখ হাসিনা সরকারের উচ্চ আদালত। এর ১১ বছর পর সংগঠনটিকেই নিষিদ্ধই করে শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগ সরকার। আর নিষিদ্ধের চার দিন পরই ওই সরকারের পতন ঘটেছে। গত ৫ আগস্টে গণঅভ্যুত্থানের তোড়ে মন্ত্রীবর্গ নিয়ে শেখ হাসিনাকে দেশ ছাড়তে হয়েছে। এখন তাদের অবস্থান প্রতিবেশী ভারতে। নিজের নাম-বাবার নামও পরিবর্তন করছে শেখ হাসিনার স্বজনরা।
তবে পতনের ২৮দিন পরই আওয়ামী লীগকে ক্ষমা করে দিয়েছেন নিষিদ্ধ জামায়াতের আমীর ডা. শফিকুর রহমান। ওইদিন দুপুরে রাজধানীর তেজগাঁওয়ের একটি রেস্টুরেন্টে সিনিয়র সাংবাদিকদের মতবিনিময় সভায় তিনি বলেন, আমরা সংশোধন ও ক্ষমার রাজনীতিতে বিশ্বাসী। আমরা প্রতিহিংসা ও প্রতিশোধের রাজনীতিতে বিশ্বাস করি না। রাজনৈতিকভাবে আমাদের ওপর যারা জুলুম-নির্যাতন করেছে আমরা তাদেরকে ক্ষমা করে দিয়েছি।
আরও পড়ুন<<>> আ.লীগের ঝটিকা মিছিল নিয়ন্ত্রণ না করতে পারলে ব্যবস্থা: স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা
এদিকে একরকম গৃহবন্দি থেকে সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে বাংলাদেশে থাকা নেতা-কর্মীদের রাজনৈতিক তৎপরতা, মিছিল-প্রতিশোধের নির্দেশনা দিচ্ছেন শেখ হাসিনা। নেত্রীর নির্দেশনা পেয়ে দেশে ঝটিকা মিছিল করছেন আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী-সমর্থকরা। ইতোমধ্যে রাজধানীর পল্টন, উত্তরা, যাত্রাবাড়ী, ডেমরা, মিরপুর, গাজীপুর, চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্নস্থানে ঝটিকা মিছিল করেছেন। যদিও ক্ষুদ্র মিছিলের স্থায়িত্ব ছিল কয়েক মিনিট। ঝটিকা মিছিল করতে গিয়ে উত্তরা থেকে গ্রেফতার হয়েছেন মহানগর দক্ষিণ আওয়ামী লীগ নেতা শাহে আলম মুরাদ। এছাড়াও পুলিশি অভিযানেও আটক হয়েছে অনেকেই।
রাত-বিরাতের চিপাগলির এসব মিছিল সরকারকে ভাবিয়ে তুলেছে। অস্বস্তিবোধ করছে সাধারণ মানুষ। এতোদিন ভেতরে ভেতরে পুলিশকে নির্দেশনা দিয়েছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রণালয়। আজ শনিবার (১৯ এপ্রিল) অন্তর্বর্তী সরকারের স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লে. জে. (অব.) মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী গণমাধ্যমে কঠোরতার বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়েছেন। স্পষ্ট জানিয়েছেন, আওয়ামী লীগের ঝটিকা মিছিল ঠেকাতে হবে। না পারলে সংশ্লিষ্ট এলাকার আইনশৃঙ্খলাবাহিনীর দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে। এসময় পুলিশের বিরুদ্ধে নিষ্ক্রিয়তার অভিযোগ আনে গণমাধ্যমকর্মীরা।
এর আগে গত ১৩ এপ্রিল ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) গোয়েন্দা বিভাগের (ডিবি) প্রধানের পদ থেকে রেজাউল করিম মল্লিককে সরিয়ে দেয়া হয়েছে।
আরও পড়ুন<<>> আ. লীগকে ঝটিকা মিছিলও করতে দেয়া হবে না: এ্যানি
এদিকে স্বৈরাচার শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে গণহত্যার অভিযোগে প্রায় অর্ধসহস্র মামলা হয়েছে। তাকে গ্রেফতার করতে ইন্টারপোলে রেড নোটিশ জারির আবেদন করা হয়েছে। গত ২৩ অক্টোবর আওয়ামী লীগের ছাত্রসংগঠন বাংলাদেশ ছাত্রলীগকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। হাসিনার দল আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধের দাবি উঠেছে ঘরে-বাইরে। সেই আন্দোলন থেকে আজঅব্দি রাজপথে থাকা ছাত্ররা গণহত্যার দায়ে বিচারের দাবি করছে শেখ হাসিনাসহ তার দলীয় নেতা, এমপি-মন্ত্রীদের। আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করার দাবি করছে।
আর নিষিদ্ধ করা নিয়ে বিএনপিকে দোষারোপ করছে সরকার আর সরকারকে দুষেছে বিএনপি। ড. ইউনূস সরকার বলছে, বিএনপির কারণে গণহত্যাকারী আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করা যাচ্ছে না। আর বিএনপি বলছে, আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ করার দায়িত্ব সরকারের, বিএনপির নয়।
বিএনপির প্রথম সারির একাধিক নেতা আওয়ামী লীগের ‘ভালো’ নেতাদের মাধ্যমে ভোটের মাঠেও আসাকে একরকম স্বাগতই জানাচ্ছেন। কেন্দ্রীয় নেতার এমন সুরে স্থানীয় নেতাদের আশ্রয়-প্রশ্রয় দিচ্ছে স্বৈরাচারের স্থানীয় দোসরদের। এমনও ভিডিও সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাসছে যে, বিএনপি নেতা বলছেন, ‘আমাদের দরজা আপনাদের (আওয়ামী লীগ নেতা) জন্য খোলা’। তবে দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের নির্দেশনা হলো-তার দল বিএনপিতে যেন নতুন করে বা ফ্যাসিস্ট দলের কোনো নেতাকর্মী প্রবেশ করতে না পারে। দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গের দায়ে, পতিত দলীয় নেতাদের আশ্রয় দেয়ার অভিযোগে দুই হাজারের বেশি নেতাকর্মীকে বহিষ্কারও করেছে বিএনপি।
আরও পড়ুন<<>> জামায়াত নিবন্ধন ফিরে পাচ্ছে শিগগিরই: অ্যাডভোকেট শিশির মনির
সবশেষ শনিবার (১৯ এপ্রিল) বিএনপির যুগ্মমহাসচিব শহীদ উদ্দিন চৌধুরী এ্যানী বলেছেন, ঢাকা-চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে আওয়ামী লীগ ঝটিকা মিছিল করছে। আবারও ফ্যাসিবাদ কায়েমের চেষ্টা চলছে। আওয়ামী লীগের দুঃশাসন, অত্যাচার, নির্যাতন, খুন ও গুম দেশের মানুষ এখনও ভুলে যায়নি। ফ্যাসিবাদকে কোনোভাবেই ঝটিকা মিছিলও করতে দেয়া হবে না। দলীয় নেতাকর্মীসহ সবাইকে সতর্ক থাকার আহবান জানিয়েছেন বিএনপির এ নেতা।
জামায়াতের নিবন্ধন ফিরে পাওয়া কতদূর?
নিবন্ধন ও নির্বাচনী প্রতীক ফিরে পাওয়ার জন্য একযুগ ধরে আইনি লড়াই করছে সংগঠনটি। ২০১৩ সালের ১ আগস্ট হাইকোর্ট জামায়াতে ইসলামীর নিবন্ধন বাতিল ও অবৈধ ঘোষণা করে রায় দেন। ২০১৮ সালের ৭ ডিসেম্বর নির্বাচন কমিশন (ইসি) দলটির নিবন্ধন বাতিল করে। এরপর উচ্চ আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করে জামায়াত। তবে ২০২২ সালের নভেম্বরে আদালত তাদের আপিল খারিজ করে দেয়।
জামায়াত দলটি নিবন্ধন ফিরে পেতে হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করে। তবে গত বছরের নভেম্বরে সংগঠনটির মূল আইনজীবীর অনুপস্থিতির কারণে আপিল খারিজ হয়। এরপর জামায়াত দলটি ১ সেপ্টেম্বর পুনরায় মামলা পুনরুজ্জীবিত করার চেষ্টা করে। কিন্তু এখনও পর্যন্ত দলটির নিবন্ধন বা নির্বাচনী প্রতীক ফিরে আসেনি। জামায়াতের আইনজীবীরা জানিয়েছেন, শিগগিরই চূড়ান্ত রায় হবে। নিবন্ধন ফিরে পাওয়া সম্ভব হবে।
গণঅভ্যুত্থানের পর অন্তর্বর্তী সরকারের আট মাস পেরিয়ে গেছে। তবে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী এখনও তাদের নিবন্ধন ফিরে পায়নি। এ নিয়ে দলটি নিবন্ধন ফিরে পেতে আন্দোলন, সমাবেশ ও প্রতিবাদ কর্মসূচি চালিয়ে যাচ্ছে।
জামায়াতের নায়েবে আমীর অধ্যাপক মুজিবুর রহমান বলেছেন, জামায়াতে ইসলামীকে নিবন্ধন ও প্রতীক ফেরত দিতে হবে। না হলে আমরা রাজপথে আন্দোলন করব। বর্তমান সরকার বৈষম্য করছে। জামায়াতের সদস্যদের মুক্তি না দেয়া জাতির জন্য হতাশাজনক।
দলটির আইনজীবীরা বলেছেন, নিবন্ধন ফিরিয়ে আনতে আইনি লড়াই অব্যাহত থাকবে। শিগগিরই এটি সমাধান হবে। জামায়াতের নিবন্ধন ফেরত আসবে ও প্রতীক ফিরে পাবেন।
রাষ্ট্রবিজ্ঞান কী বলে
দুই দলের সিদ্ধ আর নিষিদ্ধ প্রশ্নের জবাব দিয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের সাবেক চেয়ারম্যান প্রফেসর ড. নুরুল আমিন বেপারী। তার মতে, ৫ আগস্টের গণঅভূত্থানই জনতার আদালত। ওই আদালতেই রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ প্রত্যাখ্যাত হয়েছে, নিষিদ্ধ হয়েছে। আওয়ামী লীগের ছাত্র সংগঠন বাংলাদেশ ছাত্রলীগও নিষিদ্ধ করেছে সরকার। একইভাবে জামায়াতে ইসলামীর বিরুদ্ধে পতিত সরকার যে রায় (নিষিদ্ধ) দিয়েছিল সেটাও জনতার রায়ে প্রত্যাহার হয়েছে। জনতার রায় বাস্তবায়নে সরকারের পদক্ষেপ নেয়া হবে সমুচিত-যোগ করেন এ রাষ্ট্রবিজ্ঞানী।
আপন দেশ/এবি
মন্তব্য করুন # খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, আপন দেশ ডটকম- এর দায়ভার নেবে না।