Apan Desh | আপন দেশ

জামালপুর জনস্বাস্থ্যে টেন্ডার নয়, ছিল ‘টিপস অ্যান্ড টাচ’

শওকত জামান, জামালপুর

প্রকাশিত: ১৭:১৩, ২৩ এপ্রিল ২০২৫

আপডেট: ২১:৪৩, ২৩ এপ্রিল ২০২৫

জামালপুর জনস্বাস্থ্যে টেন্ডার নয়, ছিল ‘টিপস অ্যান্ড টাচ’

ফাইল ছবি

জামালপুর জেলা জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদফতরের প্রধান ভবন ঘিরে বিস্ময়ের সঞ্চার হয়েছে স্থানীয়দের মধ্যে। সরকারি কাজে স্বচ্ছতা পেশাদারিত্ব যেখানে প্রাথমিক শর্ত, সেখানে ঘুষ, দুর্নীতি, তদবির প্রভাব বিস্তারসহ নানা অভিযোগে আলোচনায় উঠে এসেছে নির্বাহী প্রকৌশলী সুলতান মাহমুদের নাম।  

স্থানীয়দের ভাষ্য অনুযায়ী, ভবনটি যেন হয়ে উঠেছে প্রভাব খাটানোর অনুশীলন ক্ষেত্র, যার কেন্দ্রবিন্দুতে ছিলেন সদ্য ওএসডি হওয়া প্রকৌশলী। তার স্থানীয় গডফাদার ছিলো- পতিত সরকারের পলাতক সাবেক প্রতিমন্ত্রী মির্জা আজম ও তার ভাগ্নি জামাই পৌর মেয়র ছানোয়ার হোসেন ছানু।

২০২০ সালের ২০ অক্টোবর জামালপুরে নির্বাহী প্রকৌশলীর দায়িত্ব গ্রহণ করেন সুলতান মাহমুদ। তাকে পছন্দ করে জেলায় এনেছিলেন আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক মির্জা আজম। সরকারি বাসভবন থাকলেও সুলতান অফিস ভবনের নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় নির্মিত একটি বিশেষ কক্ষে অবস্থান নেন। ঘরটিকে স্থানীয়রা বলেনখাস কামরা’—যেখানে নিয়মিত যাতায়াত ছিল রাজনৈতিক পরিচিতির নারীরা। চলত ঘন্টার পর ঘন্টা আড্ডা, হাস্যরস।

আরও পড়ুন<<>> প্রকৌশলী সুলতানের জালিয়াতি-লোপাটের ভয়ঙ্কর চিত্র, ফাঁসছেন দুই সহযোগি

সাধারণ ঠিকাদাররা অফিসে এলেও তাদের অপেক্ষা করতে হতো দীর্ঘসময়। কারণ, সুলতান মাহমুদের দেখা মিলত না অফিসে, বরং শোনা যেত, তিনি 'ছাদের রুমে বিশ্রামে' শুধু তাই নয়, সন্ধ্যার পর ভবনের ছাদে ঘরের আলো-আঁধারী ছিল। যেটি স্থানীয়দের মধ্যে নানা গুঞ্জনের জন্ম দেয়।

স্থানীয় ঠিকাদারদের অভিযোগবিশেষ সম্পর্কের ভিত্তিতে কাজের বরাদ্দ দেয়া হতো। অভিযোগ রয়েছে, যুব মহিলা লীগের কয়েকজন নেত্রী, যাদের কেউ জনস্বাস্থ্য অধিদফতরের তালিকাভুক্ত ঠিকাদার নন, তারাও পেয়েছেন প্রকল্পের কাজ। যেমন- প্রেমা ট্রেডার্স ইন্টারন্যাশনাল নামে একটি প্রতিষ্ঠানের অনুকূলে বরাদ্দ হয় প্রায় এক কোটি টাকার ওয়াশ ব্লক প্রকল্প। সাবেক এক নেত্রীও পেয়েছেন ৭১ লাখ টাকার প্রকল্প। কথিত আছে জামালপুর জনস্বাস্থ্যে টেন্ডার নয়, ছিল ‘ সুলতানের টিপস অ্যান্ড টাচ’।

অভিযোগ রয়েছে, প্রকৌশলী সুলতান মাহমুদ বরাদ্দ দিয়েছেনউপহারের’ বিনিময়েতদবির বা ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের ভিত্তিতে। 

যদিও এসব অভিযোগ সরাসরি অস্বীকার করেছেন যুব মহিলা লীগের বর্তমান সভাপতি ফারহানা সোমা। তিনি জানান, প্রকল্পটি তার কমিটির সাধারণ সম্পাদক নিয়েছেন এবং তার ভাইয়ের মাধ্যমে কাজটি বাস্তবায়িত হয়েছে।

আরও পড়ুন<<>> জামালপুর জনস্বাস্থ্যের কোটিপতি অফিস সহকারী হোয়াইট বাবু ছায়া নির্বাহী!

জেলা জনস্বাস্থ্য দফতরের টেন্ডার কমিটির সদস্য সচিব প্রকৌশলী সোহেল রানা আপন দেশ’কে বলেন, ‘ওনারা (নারী নেত্রী) আমাদের টেবিলে আসেননি। প্রকল্প কাকে দেয়া হবে, সে সিদ্ধান্ত নিতেন নির্বাহী প্রকৌশলী সুলতান মাহমুদ। আমরা শুধু চুক্তিপত্রে স্বাক্ষর করতাম’।

সবচেয়ে আলোচিত বিষয় হলো- ভবনের ছাদে থাকা বিশেষ কক্ষে তার দীর্ঘ সময় কাটানো, যা অফিস-পরিচালনার স্বচ্ছতার প্রশ্ন তোলে। স্থানীয়দের কেউ কেউ অভিযোগ করেছেন, সেখানে রাতেও ভিন্নধর্মী আড্ডা, বিনোদন রাজনৈতিক-ব্যক্তিগত সংযোগ কার্যক্রম চলত। কেউ কেউ কটাক্ষ করে বলেন, ভবনের সেই অংশ ছিলসুলতানের রঙিন রাজ্য। ওই পরিবেশ তৈরির আয়োজক এ চক্রে ছিলেন প্রধান সহকারী জাহাঙ্গীর কবির বাবু ওরফে সাদাবাবু ওরফে হোয়াইট বাবু।

নিয়মিত অফিসে উপস্থিত না থাকা, প্রকল্প বরাদ্দে দুর্নীতি, পক্ষপাতিত্ব, ঠিকাদারদের হয়রানি এবং নারী নেত্রীদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতাএসবের সমন্বয়েই গড়ে ওঠে বিতর্কিত এক পরিমণ্ডল, যার ফলে প্রকৌশলী সুলতান মাহমুদ আজ ওএসডি। বর্তমানে তিনি দায়িত্ব হস্তান্তর করেছেন এবং জামালপুর ছেড়েছেন। তবে সুলতান চক্রের  সদস্য ক্যাশিয়ার আমিনুল ইসলাম, সহকারী প্রকৌশলী সোহেল রানা, প্রধান সহকারী সোহেল রানাসহ অন্যরা বহাল তবিয়তে। সুলতানের রোডম্যাপেই চালাচ্ছে অনিয়ম, নিচ্ছেন চলমান কাজের কমিশন। যথারীতি চলছে সুলতানের অঘোষিত মালিকানাধীন ঠিকাদারী কাজও।

দুর্নীতিবাজ প্রকৌশলী সুলতান দোসরদের তার বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিকভাবে এখনও কোনো তদন্ত শুরু হয়নি। তবে স্থানীয় প্রশাসন নাগরিক সমাজের পক্ষ থেকে এ ঘটনার নিরপেক্ষ তদন্তের দাবি উঠেছে। জনস্বাস্থ্য দফতরের মতো একটি মৌলিক সেবা প্রতিষ্ঠান নিয়ে এমন কাজ সরকারি কার্যক্রমের প্রতি জনগণের আস্থা ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। জামালপুরে দুর্নীতি দমন কমিশনের টিম থাকলেও পাহাড়সম দুর্নীতির দিকে ক্ষণিকের জন্যও তাকায়নি এ কমিশন। তবে সারা দেশে সাব-রেজিস্ট্রার অফিসে হঠাৎ অভিযানের মতো অভিযান চলতে পারেন জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদফতরে। এ তথ্য দুদকের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের। 

অভিযোগের বিষয়ে যোগাযোগের একাধিক চেষ্টায় সুলতান মাহমুদের বক্তব্য পাওয়া যায়নি। তার মোবাইলে কল বার্তা পাঠানো হলেও সাড়া মেলেনি।

সরকারি অর্থ, পদ ক্ষমতা ব্যবহারের নামে এমন বিতর্কিত কর্মকাণ্ডে লিপ্ত নির্বাহী প্রকৌশলী সুলতান মাহমুদের বিচার দাবি করছেন স্থানীয়রা। একই সঙ্গে বছরের পর বছর দুর্নীতিকে দেখেও না দেখান ভানকরা দুর্নীতি দমন কমিশনের দায়িত্বপ্রাপ্তদের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। অন্যদিকে সুলতানের স্থলে দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে অনিয়মের ফাইল তালাশ করার অনুরোধ জানিয়েছেন ভুক্তভোগী ঠিকাদাররা।

সুলতান মাহমুদ ও যুবলীগ নেত্রীর বরাদ্দভাগাগির বিষয়টি এখন আর শুধু অফিসের ভেতরের আলাপ নয়, এটি পরিণত হয়েছে জেলার টক অব দ্য টাউনে। 

 ( চলবে...)

আপন দেশ/এবি

মন্তব্য করুন # খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, আপন দেশ ডটকম- এর দায়ভার নেবে না।

শেয়ার করুনঃ

সর্বশেষ

জনপ্রিয়