ফাইল ছবি : আইয়ুব খান চৌধুরী, মো: ফজলুর রহমান ও ডিএম জোবায়েদ হোসেন।
বাংলাদেশ তেল, গ্যাস ও খনিজসম্পদ কর্পোরেশন ওরফে পেট্টোবাংলা। প্রতিষ্ঠানটি চক্কর খাচ্ছে কতিপয়ে। আর কাউকে দেখে না। যখনই কোনো ‘তদন্ত কমিটি’ গঠনের প্রয়োজন দেখা দেয়, ডাক পড়ে নির্দিষ্ট কয়েকজন ব্যক্তির। কারিগরি ও বিশেষজ্ঞ মতামতও নেয়া হয় চিহ্নিত কয়েকজন কর্মকর্তার কাছ থেকেই। পেট্টোবাংলায় যেন আর কোনো ‘বিশেষজ্ঞ’ নেই।
খনিজ ও জ্বালানিখাতের এই ‘সর্বজ্ঞ’গণ অত্যন্ত পরিকল্পিতভাবে এবং জ্ঞাতসারে জাতীয় স্বার্থের বিপক্ষে দাঁড়ান। লেনদেনের বিনিময়ে কৌশলে আড়াল করেন ঘটনার মাস্টারমাইন্ডকে। তাদের কৌশলী প্যাঁচেই হারিয়ে যায় আইনপ্রয়োগকারী সংস্থার দৃষ্টি। জনমনে সৃষ্টি করেন বিভ্রান্তি। চূড়ান্তভাবে দেশ-বিদেশে ক্ষুন্ন করেন জাতীয় স্বার্থ ও ভাবমূর্তি। এ কারণে পেট্টোবাংলার প্রতিটি দুর্নীতির অভিযোগের যেমন সুষ্ঠু তদন্ত হওয়া প্রয়োজন, তেমনি কথিত এসব ‘বিশেষজ্ঞ কর্মকর্তার কর্মকাণ্ডও তদন্ত হওয়া প্রয়োজন। নয়তো আরও ক্ষতির মুখে পড়বে দেশ।
রাষ্ট্রে গুরুত্বপূর্ণ দুই প্রতিষ্ঠানের তদন্ত সিন্ডিকেট নিয়ে আজকের প্রতিবেদনটি প্রস্তুত করেছেন আমাদের বিশেষ প্রতিবেদকআফজাল বারী
কী ঘটেছিলো বড়পুকুরিয়ায় ? :
বড়পুকুরিয়া কয়লা খনির ইয়ার্ড থেকে ৩ লাখ টন কয়লা উধাও হয়ে গেছে !!! হালে ‘শত্রুঘোষিত’ একটি জাতীয় দৈনিকের এমন প্রতিবেদনে হৈ হৈ কাণ্ড, রৈ রৈ ব্যাপার। ওই পত্রিকাসহ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কথিত এক বিশেষজ্ঞ বয়ান ছাড়লেন-এ কয়লা হাওয়া হয়ে যায়নি। পুরোটাই চুরি। আর ‘চুরি’ যাওয়া এই কয়লার আর্থিক মূল্য নিদানপক্ষে প্রায় সাড়ে ৮শ’ কোটি টাকা।
আর যায় কোথায়! চটজলদি কর্মশুরু করে দেশের একমাত্র দুর্নীতিবিরোধী রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। অর্ধ হাজার কোটি টাকার কয়লা চোরকে পাকড়াও করতেই হবে ! ঢোল-নাকাড়া পিটিয়ে জানান দেয়া হলো। সেই ঢেঁউ আছড়ে পড়লো বাংলাদেশের উন্নয়ন অংশীদার, বিনিয়োগকারী দেশে দেশে। সংশ্লিষ্ট প্রকৌশলী-কলাকুশলী এবং প্রকল্প সংশ্লিষ্টদের মাঝে শুরু হয়ে গেলো ছোটাছুটি। ইলেকট্রনিক মিডিয়ার মুহুর্মুহ ব্রেকিং।
২০১৮ সালের কথিত কয়লা ‘চুরি’র ঢেউ থেমে গেছে বহু আগে। পরবর্তীতে ওই ঘটনায় কার্যত: কারোরই কিছুই হয়নি। চুরির দায়ে অভিযুক্তরা বহাল তবিয়তে। একদিনও কারাভোগ করতে হয়নি কাউকেই। ঘটনার বিচারতো দূরের কথা, কাঠগড়ায় দাঁড়ানোমাত্র জামিন হয়ে গেছে ২২ আসামির।
বড়পুকুরিয়া কয়লা খনির ‘কয়লা চুরি’ পরবর্তীতে কি হলো-এ প্রশ্নও জাগছে না কারও মনে। কিন্তু যে উদ্দেশ্যে বড়পুকুরিয়ার ‘চুরিতত্ত্ব’ আবিষ্কার সেটি হাসিল হয়েছে এরই মধ্যে। কথিত চৌর্যবৃত্তির অতিপ্রচারণায় বাংলাদেশের খনিজ শিল্পে বিনিয়োগে আগ্রহী বিদেশী অনেক প্রতিষ্ঠান সেই থেকে মুখ ফিরিয়ে নিতে চাইছে।
ইতোমধ্যে সত্য বিকশিত হলো যে, বড়পুকুরিয়ার ইয়ার্ড থেকে কোনো কয়লাই চুরি যায়নি। কারিগরি বিশ্লেষণ আর হিসেব কষে দেখা গেলো, গোটাটাই ছিলো স্বাভাবিক সিস্টেম লস। দীর্ঘদিনের পুঞ্জিভুত সিস্টেম লস একসঙ্গে হিসেব করায় পরিমাণটা অনেক বেশি দেখানো হয়েছিলো। ফলে হিসেবের গরমিলকেই মহাচুরি আখ্যা দিয়ে দেশের খনিজ সম্পদ সেক্টরে প্রলয় তোলা হয়েছিলো।
এ প্রতিবেদক ভুক্তভোগীদের সঙ্গে আলাপচারিতায় জানতে পারেন, পুরো বিষয়টি ছিলো বিদ্যুত, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের কতিপয় আমলা, পেট্টোবাংলার তৎকালিন পরিচালকসহ (পরিকল্পনা) কয়েকজন স্বার্থান্বেষী, দুর্নীতিগ্রস্ত ব্যক্তি কর্মকর্তা এবং দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) একটি সিন্ডিকেটের যৌথপ্রযোজনার সুপরিকল্পিত মঞ্চায়ন। এ সময়কার কিছু ঘটনাপ্রবাহ মেলালেই বিষয়টি পরিষ্কার হয়ে যায়।
২০১৮ সালে পেট্টোবাংলার অলিখিত সর্বেসর্বা ছিলেন জ্বালানি প্রতিমন্ত্রীর বিশেষ আস্থাভাজন পরিচালক (পরিকল্পনা) আইয়ুব খান চৌধুরী। হঠাৎই তার খেয়াল হলো, দিনাজপুর বড়পুকুরিয়া কয়লাখনি ইয়ার্ড পরিদর্শনের। তার আকষ্মিক পরিদর্শনেই নিহিত সব রহস্য। এ সময় বড়পুকুরিয়ার ব্যবস্থাপনা পরিচালক ছিলেন প্রকৌশলী হাবিবউদ্দিন আহমেদ। পরিদর্শন শেষে ঢাকায় ফিরে আইয়ুব খান চৌধুরী প্রথম মিডিয়ায় ছেড়ে দেন ৩ লাখ টন কয়লা ‘উধাও’ হয়ে যাওয়ার তত্ত্ব।
প্রশ্ন হচ্ছে, পেট্টোবাংলার পরিচালক (পরিকল্পনা) একজন নন-টেকনিক্যাল কর্মকর্তা। তিনি কেনো অত্যন্ত কারিগরিপূর্ণ একটি বিষয়ে স্টেটমেন্ট দিলেন? কোনো ধরণের অনুসন্ধান-তদন্ত না করেই তিনি কি করে সংবাদকর্মীদের হাতে তুলে দিলেন কথিত কয়লা উধাওয়ের ফ্যাক্ট-ফিগার? পেট্টোবাংলার শীর্ষ পর্যায়ের এমন ব্যক্তির লিখিত প্রতিবেদন মিডিয়ার পক্ষেই যাচাই-বাছাই বা উপেক্ষা করার সুযোগ কোথায় ? বিদ্যুৎগতিতে ছড়িয়ে পড়ে বিষয়টি। জ্বালানি সেক্টরে সেকী হুলস্থুল ! পেট্টোবাংলার ত্বরিৎ আদেশে ‘ব্যবস্থা’ স্বরূপ প্রথমেই সরিয়ে দেয়া হলো প্রকৌশলী হাবিবউদ্দিন আহমেদকে। কামরুজ্জামানের নেতৃত্বে গঠন করা হয় তিন সদস্যের একটি কমিটি। পেট্টোবাংলার পরিচালক (মাইন অপারেশন) মো: কামরুজ্জামানকে করা হয় কমিটির আহ্বায়ক। অপর দুই সদস্য হলেন- পেট্টোবাংলার মহাব্যবস্থাপক (হিসাব) তোফায়েল আহমেদ ও উপ-মহাব্যবস্থাপক ডিএম জোবায়েদ হোসেন। হাবিবউদ্দিনের স্থলাভিষিক্ত হন পেট্টোবাংলার পরিচালক (প্ল্যানিং) আইয়ুব খান চৌধুরী। তিনি প্রায় ৩ সপ্তাহের মতো এমডি’র পদে ছিলেন।
জানা যায়, এ সময় তিনি তেমন কোনো ফাইলে স্বাক্ষর করেননি। তবে বিশেষ একটি কাজ নিয়ে তিনি খুব ব্যতিব্যস্ত ছিলেন। জানাযায়, এ সময় তিনি পেট্টোবাংলায় অপছন্দের ব্যক্তিদের তালিকা প্রস্তুত করেন। এরই মধ্যে তিনি পেট্টোবাংলার চেয়ারম্যানের দফতর থেকে আরেকটি আদেশ করান। পেট্টোবাংলার মহাব্যবস্থাপক (মিনারেল এক্সপ্লোরেশন অ্যান্ড ইমপ্লেমেন্টেশন) প্রকৌশলী মো: ফজলুর রহমানকে বড়পুকুরিয়ার এমডি নিয়োগ দিয়ে নিজের স্থলাভিষিক্ত করেন।
চাউর আছে, ফজলুর রহমান আইয়ুব খান চৌধুরীরই খাস লোক। এমডির চেয়ারে বসার ১০/১২ দিনের মধ্যে মো: ফজলুর রহমান দায়ের করেন মামলা। মামলার বাদী করা হয়, বড়পুকুরিয়া কয়লাখনির ম্যানেজার (প্রশাসন) মোহাম্মদ আনিসুর রহমানকে। ২০১৮ সালের ২৫ জুলাই দিনাজপুর পার্বতীপুর থানায় দায়ের করা হয় এ মামলা। এতে আসামি করা হয় ১৯ জনকে। তারা হলেন, বড়পুকুরিয়া কয়লাখনির মহাব্যবস্থাপক (মাইন অপারেশন) নূর-উজ-জামান চৌধুরী, উপ-মহাব্যবস্থাপক ( স্টোর) একেএম খালেদুল ইসলাম, ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রকৌশলী হাবিব উদ্দিন আহমেদ, কোম্পানি সচিব ও মহাব্যবস্থাপক (প্রশাসন) আবুল কাশেম প্রধানীয়া, ব্যবস্থাপক (এক্সপ্লোরেশন) মোশাররফ হোসেন সরকার, ব্যবস্থাপক (জেনারেল সার্ভিসেস) মাসুদুর রহমান হাওলাদার, ব্যবস্থাপক (উৎপাদন ব্যবস্থাপনা) অশোক কুমার হালদার, ব্যবস্থাপক (মেইনটেন্যান্স অ্যান্ড অপারেশন) আরিফুর রহমান, ব্যবস্থাপক (ডিজাইন, কন্সট্রাকশন অ্যান্ড মেইনটেন্যান্স) জাহিদুল ইসলাম, উপ-ব্যবস্থাপক (সেফটি ম্যানেজমেন্ট) একরামুল হক, উপব্যবস্থাপক (কোল হ্যান্ডলিং ম্যানেজমেন্ট) মুহাম্মদ খলিলুর রহমান, উপব্যবস্থাপক (মেইনটেন্যান্স অ্যান্ড অপারেশন) মোর্শেদুজ্জামান, উপব্যবস্থাপক প্রোডাকশন ম্যানেজমেন্ট) হাবিবুর রহমান, উপ-ব্যবস্থাপক (মাইন ডেভেলপমেন্ট) জাহেদুর রহমান, সহকারী ব্যবস্থাপক ( ভেন্টিলেশন ম্যানেজমেন্ট) সত্যেন্দ্রনাথ বর্মণ, ব্যবস্থাপক (নিরাপত্তা) সৈয়দ ইমাম হাসান, উপ-মহাব্যবস্থাপক (মাইন প্ল্যানিং অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট) জোবায়ের আলী, সাবেক মহাব্যবস্থাপক (অর্থ ও হিসাব) আব্দুল মান্নান পাটোয়ারী এবং মহাব্যবস্থাপক (অর্থ ও হিসাব) গোপাল চন্দ্র সাহা।
এই ১৯ জনের তালিকায় দু’একজজনের বিরুদ্ধে পূর্ব থেকেই দুর্নীতির অভিযোগ ছিলো। কিন্তু তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থাই নেয়নি পেট্টোবাংলা। কিন্তু এই এজাহারে আসামি করা হয় শুধু আইয়ুব খান চৌধুরী প্রণীত তালিকার ১৯জনকে। মামলার বিশ্বাসযোগ্যতা অর্জনের লক্ষ্যে আইয়ুব খানের অপছন্দের ব্যক্তিদের সঙ্গে যুক্ত করে দেয়া হয় বহুলদুর্নীতিগ্রস্ত কয়েকজন কর্মকর্তার নামও।
এজাহারে ধারা যুক্ত করা হয় ১৯৪৭ সালের ২ নং দুর্নীতি প্রতিরোধ আইনের ৫(২) এবং দণ্ডবিধির ৪০৯ ধারা। যদিও এই ধারায় দায়েরকৃত মামলা তদন্তের এখতিয়ার শুধুমাত্র দুদকের।
মাঠ তৈরি করেন আইয়ুব খান গং-গোল দেয় দুদক সিন্ডিকেট :
বড়পুকুরিয়ায় কয়লা চুরির প্রেক্ষাপটটি প্রস্তুতই করা হয় দুদকের জন্য। কারণ, দুদক নামক কথিত স্বশাসিত স্বাধীন তদন্ত সংস্থাটির ওপর রয়েছে পেট্টোবাংলার পরিচালক (প্ল্যানিং) আইয়ুব খান চৌধুরীর অবিশ্বাস্য নিয়ন্ত্রণ। দুদকের দুই শীর্ষ কর্মকর্তা, আত্মীয় সম্পর্কের একজন মহাপরিচালক,কয়েকজন পরিচালক, উপ এবং সহকারি পরিচালকের সমন্বয়ে গঠিত দুদকের এই সিন্ডিকেট। এই সিন্ডিকেট আইয়ুব খান চৌধুরীর ব্যক্তিগত এজেন্ডা বাস্তবায়ন করে। অনেক আগে থেকে ঘটনা এমন ছক করে তৈরি করা হয়, যাতে মনে হবে, সত্যিই বড় কোনো দুর্নীতির ঘটনা ঘটেছে। মূলত: নিজের সংশ্লিষ্টতায় পেট্টোবাংলায় যে বৃহৎ দুর্নীতিগুলো সংঘটিত হয় সেগুলো আড়াল করতেই তার এই তৎপরতা। ব্যাপারটা অনেকটা এমন যে, পেট্টোবাংলায় মাঠ তৈরি দেন আইয়ুব খান চৌধুরী, অনায়াসে গোল করে দুদকে থাকা তার পোষ্য সিন্ডিকেট। এতে একদিকে ব্যক্তিগতভাবে লাভবান হন আইয়ুব খান চৌধুরী, অন্যদিকে তদন্ত সংশ্লিষ্ট দুদকের দুর্নীতিগ্রস্ত কর্মকর্তারা লাভবান হন আর্থিকভাবে।
বিশেষভাবে লক্ষ্যনীয় বিষয় হচ্ছে, বড়পুকুরিয়ার ৩ লাখ টন কয়লা চুরি মামলার আগে কিছু দিন প্রতিষ্ঠানটির এমডি’র পদে বসানো হয় প্রকৌশলী মো: ফজলুর রহমানকে। ফ্যাক্ট-ফিগার তৈরি, ঘটনা সাজানো, আসামির তালিকা সরবরাহ, মামলা রুজু, দুদকের হাতে ন্যাস্ত এবং দুদকের তদন্ত পর্যন্ত তার দায়িত্ব শেষ। ৬/৭ মাস পর আরেকটি বদলির আদেশ দিয়ে বড় পুকুরিয়া কয়লা খনি থেকে তুলে নিয়ে বসিয়ে রাখা হয় পেট্টোবাংলায়। এরপর তাকে গুরুত্বপূর্ণ কোনো স্থানে পদায়ন করা হয়নি। বছর খানেক বসিয়ে রেখে ২০১৯ সালের জুলাইয়ের দিকে তাকে আবার ব্যবস্থাপনা পরিচালক করে পাঠানো হয় মধ্যপাড়া কঠিন শিলা প্রকল্পে। সেখানে ছিলেন ৪ মাসের মতো।
জানা গেছে, আইয়ুব খানের এই সিপাহসালার কিছু বিভ্রান্তিকর ফ্যাক্ট-ফিগার দিয়ে সেখানেও একটি মামলা রুজুর গ্রাউন্ড তৈরির চেষ্টা চালান। মূলত: এসবই পাতানো খেলা। আইয়ুব খান চৌধুরীর পরিকল্পনায় পেট্টোবাংলা থেকে মাঠ তৈরির কাজটিই করেন জিএম ফজলুর রহমান ও জিএম (মাইন অপারেশন) ডিএম জোবায়েদ হোসেনকহ কয়েকজন কর্মকর্তা। তবে এমজিএমসিএল-এ মাঠ তৈরির অ্যাসাইনমেন্টে ব্যর্থ হওয়ায় ফজলুর রহমানকে ফিরিয়ে আনা হয়েছে পেট্টোবাংলায়।
হিসেবে নেয়া হয়নি যেসব ‘সিস্টেম লস’ :
খনিজ কয়লা মূলত: একটি সলিড গ্যাস। এটির ধর্ম নিজে নিজে জ্বলে ওঠা। যাতে জ্বলে না ওঠে তাই নির্দিষ্ট তাপমাত্রায় সংরক্ষণ করতে এটিতে পানি মেশাতে হয়। কয়লার নিজস্ব ময়েশ্চার ধরা হয় ৪ শতাংশ। কয়লা কাটার পর মেশানো হয় পানি। কিন্তু পানি যুক্ত করা হলেও বড়পুকরিয়ার ইয়ার্ডের কয়লায় সেটি কাউন্ট করা হয়নি। এতে কয়লা উত্তোলনের পরিমাণ বেশি দেখানো হয়। মাটির সঙ্গে মিশে যাওয়া কয়লার পরিমাণও কম নয়। এভাবে খনিতে উৎপাদন শুরু হওয়া থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত স্বাভাবিক সিস্টেমলসগুলোকে হিসেবে আনা হয়নি। অভিযোগ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিগণ দুদকের জিজ্ঞাসাবাদে যখন ফ্যাক্টস-ফিগার তুলে ধরলেন তখন দুদক গা বাঁচাতে নামকাওয়াস্তে একটি তদন্ত প্রতিবেদন দেয়। এতে আসামি করা হয় বড়পুকুরিয়ার সাবেক ৬ এমডিসহ ২২ জনকে। ২০১৯ সালের ২৪ জুলাই দুদকের দিনাজপুর কার্যালয়ের উপ-পরিচালক আবু হেনা আশিকুর রহমান যেনতেন প্রকারে দাখিল করেন চার্জশিট। দুদকের তৎকালীন পরিচালক (বিশেষ) কাজী মোঃ শফিকুল আলমের তত্বাবধানে মামলাটি তৎকালীন উপ-পরিচালক বেনজীর আহমেদ, উপ-পরিচালক আবু বক্কর সিদ্দিক ও উপ-পরিচালক মোঃ শামসুল আলম ( বর্তমানে অবসরপ্রাপ্ত), তৎকালিন সহকারি পরিচালক এএসএম সাজ্জাদ হোসেন,উপ-সহকারি পরিচালক এএসএম তাজুল ইসলাম পর্যায়ক্রমে তদন্ত করেন। চার্জশিটে সিস্টেম লস হওয়া কয়লার বাজার মূল্য দেখানো হয় ২৩০ কোটি টাকা। ২২ আসামি দিনাজপুর জেলা স্পেশাল জজ আদালতে আত্মসমর্পণ করে জামিন চাইলে জামিন মঞ্জুর করেন দিনাজপুর জেলা আদালত। কারাগারে একরাত পরই মুক্তি মেলে আসামিদের। ঘটনার পর ৫বছর হতে চললেও এখন আর মামলাটির খবর নেই। সব আসামিই এখন মুক্ত।
প্রশ্ন হচ্ছে, কয়লা খনির ইয়ার্ডের স্বাভাবিক সিস্টেম লস যদি চুরি তথা দুর্নীতি হয়েই থাকে তাহলে এখন পর্যন্ত কাউকে বিচারের আওতায় আনা হয়নি কেন ? কেন একজন আসামিকেও একদিনের জন্যও কারাভোগ করতে হয়নি ? এসব ‘কেন? এর উত্তর মেলে ঘটনা পরম্পরা, ধারাবাহিক বিশ্লেষণ, পেট্টোবাংলার তদন্ত কমিটি এবং সর্বোপরি দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) কর্মকর্তা বিশেষের সংশ্লিষ্টতার মধ্যেই।
লক্ষ্যনীয় বিষয় হচ্ছে, দিনাজপুর বড়পুকুরিয়া কয়লা খনির ইয়ার্ডে সংঘটিত ঘটনাটি চোখে পড়ে ২০১৮ সালের ১৭ জুলাই। ২০১৮ সালের ১৬ জুলাই খনি পরিদর্শনের সময় পেট্রোবাংলার একজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা ইয়ার্ডে কয়লার ঘাটতি খুঁজে পান। পরের দিন কর্তৃপক্ষ স্টকের বিপরীতে ১ লাখ ৪৫ হাজার মেট্টিক টন কয়লা কম পান। এই ঘাটতিটা স্বাভাবিক সিস্টেম লস, হিসাবের গরমিল নাকি চুরি-এটি। কিন্তু তা না করে এটিকে সরাসরি ‘চুরি বা ‘সরকারি সম্পত্তি তছরুপ’‘ হিসেবে প্রযোজ্য ধারায় মামলা ঠুকে দেয়া হয়।
যেখানে তদন্ত কমিটি সেখানেই ফজলু-ডিএম জোবায়েদ :
বর্তমান সরকার-বিরোধী হিসেবে তকমাপ্রাপ্ত এই প্রকৌশলীকে আইয়ুব খান চৌধুরী কাজে লাগিয়েছে ব্যক্তিগত স্বার্থে, প্রতিপক্ষকে শায়েস্তার কাজে। কাজ শেষে তাকে ছুড়ে ফেলা হয় ব্যবহৃত টিস্যুর মতো। পেট্টোবাংলায় জিএম ফজলুর রহমানের পরিচিতি এখন ‘চাঁদাবাজ’ হিসেবে।
২০১৯ সালের ঘটনা। দিনাজপুর বড়পুকুরিয়া কয়লা খনি কর্মকর্তা-কর্মচারির প্রফিট বোনাস আটকে রেখে ৬০ লাখ টাকা চাঁদা আদায়ের অভিযোগ ওঠে প্রকৌশলী ফজলুর রহমানের বিরুদ্ধে। অভিযোগ তদন্তে ওই বছর ৩০ জানুয়ারি এক সদস্যের একটি কমিটি গঠন করে পেট্টোবাংলা। তদন্ত কমিটির প্রধান করা হয় ছিলেন পেট্টোবাংলার মহা-ব্যবস্থাপক (মাইন অপারেশন) ডিএম জোবায়েদ হোসেন।
উল্লেখ্য, কয়লা উধাওয়ের ঘটনা তদন্তে পেট্টোবাংলা কর্তৃপক্ষ তিন সদস্যের যে কমিটি করে, সেটির অন্যতম সদস্য ছিলেন ডিএম জোবায়েদ হোসেন। তিনিও আইয়ুব খান চৌধুরীর অনুগত সিপাহসালা। ফজলুর রহমানের বিরুদ্ধে চাঁদাবাজির অভিযোগ তদন্তের দায়িত্ব এককভাবে জোবায়েদ হোসেনকে দিলে তীব্র আপত্তি ওঠে ভুক্তভোগীদের মধ্য থেকে। পরে পেট্টোবাংলার উপ-মহাব্যবস্থাপক (নিরীক্ষা) শামীম হাসানকে তদন্ত কমিটিতে কো-অপ্ট করা হয়। ফজলুর রহমানের বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিলো, বড়পুকুরিয়া কয়লা খনির ১৪৭ জন কর্মকর্তা-কর্মচারীর মাঝে (২০১৭-২০১৮) অর্থ বছরে প্রফিট বোনাসের টাকা বিতরণ করতে গিয়ে প্রায় ৬০ লাখ টাকা চাঁদা আদায় করেছেন তিনি। যদিও মো: ফজলুর রহমান ২০১৮ সালের ২০ আগস্ট বিসিএমসিএল-এ যোগদান করেন।
সে অনুযায়ী তার প্রফিট বোনাস গ্রহণের কোনো সুযোগই নেই। এ অবস্থায় ফজলুর রহমান অসদুপায়ে ১৪৭ কর্মকর্তা-কর্মচারীর কাছ থেকে ৬০ হাজার টাকা করে চাঁদা তোলেন। অনেক কর্মকর্তার আপত্তির মুখে পরে অবশ্য ৪০ হাজার টাকা করে চাঁদা আদায় করা হয়। চাঁদার টাকা উত্তোলন শেষ না হওয়া পর্যন্ত ট্রাস্টি বোর্ডকে মৌখিক নির্দেশ দিয়ে টাকা বণ্টন বন্ধ করা হয়। বিষয়টি প্রমাণিত হলেও জিএম জোবায়েদ হোসেনের তদন্ত প্রতিবেদনে খনির তৎকালিন ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো: ফজলুর রহমানের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়ার কোনো সুপারিশ করা হয়নি। আইয়ুব খান চৌধুরীকে মোটা অংকের ঘুষ দিয়ে তদন্ত প্রতিবেদনটি ধামাচাপা দেয়া হয়। আইয়ুব খান অবসরে চলে গেলে সেই প্রতিবেদন আলোর মুখ দেখেনি। ফজলুর রহমান জিএম পদে এখনও পেট্টোবাংলায় বহাল। শুধু ‘বহাল’ বললেও ভুল হবে। যার প্রতিষ্ঠানে চাঁদাবাজির অভিযোগ তদন্ত হয়েছে, সে ব্যক্তির নেতৃত্বেই গঠিত হচ্ছে বিভিন্ন ঘটনার তদন্ত কমিটি। সাথে রাখা হচ্ছে তার বিরুদ্ধে তদন্তকারী কর্মকর্তা দেওয়ান মোহাম্মদ জোবায়েদ হোসেনকে।
পেট্টোবাংলার অধীনস্থ প্রতিষ্ঠান চট্টগ্রাম কর্ণফুলি গ্যাস ফিল্ড কোম্পানি লি: (কেজিডিসিএল)র চার কর্মকর্তার দুর্নীতি তদন্তে কমিটি হয়। প্রতিষ্ঠানটির তৎকালিন এমডি এমএ মাজেদের নেতৃত্বে গড়ে ওঠা সিন্ডিকেটে কোম্পানির মহাব্যবস্থাপক শফিউল আজম খান, মহাব্যবস্থাপক আমিনুর রহমান, মহাব্যবস্থাপক (প্রশাসন) মো: ফিরোজ খান-প্রত্যেকেই পেট্টোবাংলার দুর্নীতির কিংবদন্তি আইয়ুব খান চৌধুরীর শিস্য।
তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ, জাল-জালিয়াতির মাধ্যমে বিভিন্ন শিল্প প্রতিষ্ঠানে অবৈধ গ্যাস সংযোগ দিয়েছেন। এছাড়া অনেক শিল্পপ্রতিষ্ঠানকে বকেয়া গ্যাস বিল আদায় না করে বছরের পর বছর অনৈতিক সুবিধাও দিয়েছে। অফিসিয়ালি সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেয়ার পরও গোপনে দিয়েছেন পুন:সংযোগ। এই দুর্নীতির তদন্তে গঠিত হয় চার সদস্যের কমিটি।
পেট্টোবাংলার পরিচালক প্রকৌশলী আলী ইকবাল মো: নূরুল্লাহ কমিটির প্রধান। সদস্য সচিব ছিলেন, মহা-ব্যবস্থাপক (সংস্থাপন) মো: আমজাদ হোসেন। অপর দুই সদস্য হলেন, পেট্টোবাংলার মহা-ব্যবস্থাপক (হিসাব) নজরুল ইসলাম এবং মহা-ব্যবস্থাপক (মাইন অপারেশন) ডিএম জোবায়েদ হোসেন। এই কমিটিতে অন্যান্যদের সঙ্গে ডিএম জোবায়েদ হোসেনও রয়েছেন। প্রায় সব তদন্ত কমিটিতেই কেনো ডিএম জোবায়েদকে রাখা হয়- জানতে চেষ্টা করা হয় পেট্টোবাংলার বর্তমান চেয়ারম্যান জনেন্দ্রনাথ সরকারের কাছে। কিন্তু প্রতিবারই তার ওয়েবসাইটে প্রচারিত ফোন নম্বরটি বন্ধ পাওয়া হয়।
দুদক-পেট্টোবাংলা চলে কার ইশারায় :
জানাগেছে, তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনের আলোকে মাজেদ, ফিরোজ খানসহ কয়েকজনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার সুপারিশ ছিলো। কিন্তু জোবায়েদের মাধ্যমে কমিটিতে তীব্র প্রভাব বিস্তার করেন আইয়ুব খান চৌধুরী। ফলে তদন্ত প্রতিবেদনে কর্ণফুলির অবৈধ বাণিজ্যিক গ্যাস সংযোগের প্রধান হোতা আইয়ুব খান চৌধুরীকে স্পর্শই করা হয়নি। ফলে আড়ালে রয়ে যায় কর্ণফুলি গ্যাস কোম্পানি লিমিটেডের আসল দুর্নীতি। কখনও ফজলুর রহমান, কখনও ডিএম জোবায়েদের মাধ্যমে অবসরে চলে যাওয়া আইয়ুব খান চৌধুরী পেট্টোবাংলার তদন্ত কমিটিগুলোতে নিজের পূর্ণ করায়ত্ত্ব রাখছেন। বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের বিভিন্ন টেবিল, পেট্টোবাংলার অধীনস্থ প্রতিষ্ঠান এবং আইনপ্রয়োগকারী সংস্থা দুদকের ওপর এই কর্মকর্তার এখনও এতোটাই প্রভাব যে, প্রতিষ্ঠানগুলোকের অনেকে মনে করেন, আইয়ুব খান চৌধুরীই এখন পেট্টোবাংলা ও দুদক চালাচ্ছেন। এ বিষয়ে জানতে একাধিকবার ফোন করা হয় দুদক চেয়ারম্যান মোহাম্মদ মঈনউদ্দীন আবদুল্লাহকে। তিনি এ প্রতিবেদকের ফোন ধরেন নি।
আপন দেশ/এআর
মন্তব্য করুন # খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, আপন দেশ ডটকম- এর দায়ভার নেবে না।