Apan Desh | আপন দেশ

ভ্যাট কেলেঙ্কারি: ৫৪ কোটি টাকার দায় ২ কোটিতে মুক্তি পেল এসকেবি লিঃ

আফজাল বারী

প্রকাশিত: ১৫:১৯, ২৯ মে ২০২৩

আপডেট: ২১:১৪, ৩০ মে ২০২৩

ভ্যাট কেলেঙ্কারি: ৫৪ কোটি টাকার দায় ২ কোটিতে মুক্তি পেল এসকেবি লিঃ

ফাইল ছবি

সরকারি মাল দরিয়া মে ঢেলেছেন জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। সরকারের পাওনা ৫৪ কোটি টাকা দাবি (ভ্যাট) নামিয়ে আনা হয়েছে দুই কোটি টাকায়। এই ৫৪ কোটিকে কাটছাট করে দুই কোটিতে নামাতে ব্যয় হয়েছে আরও তিন কোটি টাকা। ভ্যাট ফাঁকি দিয়েছে ‘এসকেবি স্টেইনলেস মিলস লিমিটেড’। আর ঘষামাজার কাজটি করেছেন এনবিআরের দায়িত্বপ্রাপ্ত কিছু দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা।

এনবিআরের সেন্ট্রাল ইন্টেলিজেন্স সেল (সিআইসি) সূত্র থেকে প্রাপ্ত তথ্য বলছে, এসকেবি স্টিল মিলস লিমিটেড একই পদ্ধতিতে ভ্যাট বাবদ সরকারের শত শত কোটি টাকা রাজস্ব আত্মসাৎ করছে ২০০৫ সাল থেকে। টাকার হিসাবে প্রায় তিনশ’ কোটি। কাস্টমস, এক্সসাইজ ও ভ্যাট কমিশনারেট, ঢাকা উত্তরের কিছু দুর্নীতিগ্রস্ত কর্মকর্তা-কর্মচারি ফাঁকিবাজির কাজে সহযোগিতা করেছেন বলে সূত্রটি জানায়।

সম্প্রতি নিষ্পত্তিকৃত চারটি ভ্যাট মামলার রেকর্ড সূত্রে জানা যায়, ২০২০ সালের ৮ ডিসেম্বর ঢাকা (উত্তর) কাস্টমস, এক্সসাইজ ও ভ্যাট কমিশনারেটর কমিশনার ফারজানা আফরোজ মূল্য সংযোজন কর আইন, ১৯৯১-এর ধারা-৫৫-এর উপধারা (১) অনুযায়ী ‘এসকেবি স্টেইনলেস স্টিল মিলস লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালককে ২৬ কোটি ৫০ লাখ ৫৮ হাজার ৭৫ পয়সা আদায়ের জন্য কারণ দর্শানোর নোটিশ দেয়। যার নথি নং-ঢাকা উত্তর/আ: ও বি:/মূসক ফাঁকি.এস.কে.বি./১০(২৯৬)/২০২০/৩১১৫)। 

নোটিশে বলা হয়, পরিহারকৃত মূসক সরকারি কোষাগারে জমা প্রদান না করায় সরকার তার প্রাপ্য রাজস্ব হতে বঞ্চিত হয়েছে। আপনার (এসকেবি) প্রতিষ্ঠানের এহেন কার্যকলাপ আইনসঙ্গত নয় এবং সরকারি রাজস্বহানির কারণ। এ অবস্থায় পরিহারকৃত মূসক বাবদ ২৬ কোটি ৫০ লাখ ৫৮ হাজার ৭৫ টাকা আদায়ের লক্ষ্যে মূসক আইন, ১৯৯১-এর ধারা ৫৫-এর উপ-ধারা (১) মোতাবেক গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের পক্ষে দাবিনামা সম্বলিত নোটিশ জারি করা হলো। এভাবে ভ্যাট ফাঁকির পৃথক চারটি অভিযোগের প্রেক্ষিতে এসকেবিকে কারণ দর্শানো হয়। নোটিশের একটিতে নয় কোটি ২৬ লাখ ৩৯ হাজার ৯৫৬ টাকা, একটিতে চার কোটি ১৫ লাখ ১৪ হাজার ৬৯৭ টাকা এবং একটিতে এক কোটি ৭৭ লাখ ৮৮ হাজার ২৫৬ টাকা কর পরিহারের কথা উল্লেখ করা হয়।

এসব নোটিশের প্রেক্ষিতে এসকেবি লিমিটেড কমিশনে লিখিত জবাব দাখিল করে। জবাবে প্রতিষ্ঠানটি নিজেদের অনুকূলে নানা তথ্য তুলে ধরে এবং নিজেদের নির্দোষ দাবি করে। করোনা মহামারীর প্রাদুর্ভাবে উৎপাদন মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার দাবি করে সহমর্মিতা আদায়ের চেষ্টাও চলে। আনিত অভিযোগ থেকে অব্যাহতি দিতে বিশেষভাবে অনুরোধ জানানো হয়। 

আরও পড়ুন: এনআরবিদের চোখ কেন আর্থিক খাতে ?

আনুষ্ঠানিকতা রক্ষায় প্রতিষ্ঠানটি অভিযোগ থেকে অব্যাহতি চাইলেও ভেতরে শুরু হয় রফাদফার দেনদরবার। এসকেবির শুনানি নিয়ে এ বিষয়ে কাস্টমস, এক্সসাইজ ও ভ্যাট কমিশনার ফারজানা আফরোজ প্রতিবেদন চেয়ে পাঠান গাজীপুরের ডেপুটি কমিশনার সুশান্ত পালের কাছে। চিঠি পাওয়ামাত্র সুশান্ত পালের সঙ্গে যোগাযোগ করিয়ে দেন ভ্যাট কমিশন অফিস আইন শাখার উচ্চমান সহকারি আশরাফুল ইসলাম। তখন এসকেবি লিমিটেডের সঙ্গে অফিসের বাইরে আলোচিত সেই সুশান্ত পালের সঙ্গে একটি অনানুষ্ঠানিক বৈঠক হয়। সে অনুযায়ী এসকেবি থেকে ভ্যাট কমিশনের দাবিকৃত ৫৪ কোটি টাকা কমিয়ে ন্যূনতম দুই কোটি টাকা সাব্যস্ত করে প্রধান কার্যালয়ে প্রতিবেদন দেন গাজীপুরের উপ-কমিশনার সুশান্ত পাল। তার পাঠানো প্রতিবেদন অনাপত্তিতে কর কমিশনার (ঢাকা উত্তর)’র টেবিলে স্থানান্তর করেন ডেপুটি কমিশনার (আইন) ফেরদৌসি মাহবুব। প্রতিবেদনটি অত্যন্ত নিখুঁতভাবে উপস্থাপন উপযোগী করে দেন রাজস্ব কর্মকর্তা (আরও) মো. সাকের, বেলালউদ্দিন। এ ক্ষেত্রে ঘুষ লেনদেন হয় তিন কোটির বেশী। লেনদেনের ঘটকালী করেন উচ্চমান সহকারি আশরাফুল ইসলাম। তিনি বণ্টনের দায়িত্ব পালন করেন। 

আপন দেশের সোর্স থেকে প্রাপ্ত তথ্য মতে, এসকেবি স্টিল মিলস লিমিটেডকে ৫৪ কোটি টাকা ভ্যাট ফাঁকির অভিযোগে নোটিশকারী কমিশনার ফারজানা আফরোজ কিছুদিন পর বদলি হয়ে যান। তার চেয়ারে আসেন ওয়াহিদা রহমান চৌধুরী। ওয়াহিদা রহমান মামলাগুলোর উৎপত্তির কারণ এবং নেপথ্যে থাকা আশরাফুল ইসলাম সিন্ডিকেট সম্পর্কে বিস্তর জানতেন না। এ সুযোগ হিসেবে ব্যবহার করেন ইউডি আশরাফুল ইসলাম। ফলে তেমন কোনো সম্পুরক প্রশ্ন না করেই ঢাকা উত্তরের কাস্টমস, এক্সাইজ ও ভ্যাট কমিশনার ওয়াহিদা রহমান চৌধুরী মামলাগুলো নিষ্পত্তি করে দেন। 

চতুর সুশান্ত পাল এমন কৌশলে প্রতিবেদন প্রস্তুত করেন যেন- আপাতদৃষ্টিতে নির্ভেজাল। সাচ্চা। কোনো ত্রুটি নেই। তিনি এসকেবির লিমিটেডের পক্ষে দেয়া আত্মপক্ষ সমর্থনমূলক তথ্যগুলো গ্রহণ করে প্রতিবেদন তৈরি করেন। রাষ্ট্রের দাবিকৃত ৫৪ কোটি টাকাকে মাত্র দুই কোটি টাকায় নামিয়ে আনেন। সুশান্ত পালের প্রতিবেদনের ভিত্তিতে ভ্যাট কমিশনার ওয়াহিদা রহমান চৌধুরী সরল বিশ্বাসে মামলাটি নিষ্পত্তির আদেশ দেন। এতে এনবিআর তথা সরকার অর্ধশত কোটি টাকা বঞ্চিত হলেও বিশাল অর্থদণ্ড থেকে বেঁচে যায় এসকেবি।
 

আশরাফুলের বিশেষ সার্ভিস:

শুধু এসকেবি স্টিল মিলস লিমিটেডই নয়, ঢাকা উত্তরের কাস্টমস, এক্সাইজ ও ভ্যাট কমিশনারের কার্যালয়ের আশরাফুল ইসলাম চাকরির সাইনবোর্ড ব্যবহার করে এ ধরণের বিশেষ সার্ভিস দিয়ে থাকেন। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান তার ‘বিশেষ সার্ভিস’ নিয়ে শত শত কোটি টাকা ভ্যাট ফাঁকি দিয়ে আসছেন। অভিযোগ রয়েছে, আশরাফুল ইসলাম পদবি অনুসারে সরকারি বেতন উত্তোলন করেন ২৫-২৬ হাজার টাকার মতো। কিন্তু ভ্যাট কমিশন অফিসে দালালি করে মাসে আয় করেন অন্তত ২০/২২ লাখ টাকা। চাকরি করছেন ছয়-সাত বছর ধরে। এরই মধ্যে তিনি ঢাকায় নামে-বেনামে কিনেছেন বেশ কয়েকটি প্লট। বসবাস করেন উত্তরা অভিজাত এলাকায়। নিজ এলাকা নেত্রকোনায় কিনেছেন বহু জমি।

আরও পড়ুন: পেট্রোবাংলার দুর্নীতি, ‘তদন্ত’ কমিটির তদন্ত করবে কে?

তবে অভিযোগ অস্বীকার করে ইউডি আশরাফুল ইসলাম বলেন, এসকেবিকে যিনি নোটিশ করেছেন তিনি নিষ্পত্তি করেননি। তাই এখানে কোনোপ্রকার দুর্নীতি হওয়ার সুযোগ নেই। যেখান থেকে তথ্য পেয়েছেন তারা সঠিক তথ্য দেয়নি। 

এদিকে এসকেবি লিমিটেডের ডেপুটি জেনারেল ম্যানেজার মো. মফিজুল ইসলাম বলেন, সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা সকল ডকুমেন্ট দেখে প্রতিবেদন দিয়েছেন। বিষয়টি নিষ্পত্তি হয়েছে তদন্ত কর্মকর্তার প্রতিবেদনের ভিত্তিতেই।

ভ্যাট আইন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মামলা নিষ্পত্তির ক্ষেত্রে যদি অনৈতিক পথ অবলম্বনের অভিযোগ ওঠে তাহলে ১৯৯১ সালের ভ্যাট আইনে এর প্রতিকারও রয়েছে। উল্লেখিত অভিযোগটি ১৯৬৯ শুল্ক আইন এবং ২০১২ সালের সম্পূরক শুল্ক আইনে প্রতিকারযোগ্য। এ ক্ষেত্রে ভ্যাট কমিশনার বিষয়টি সরকারের রাজস্ব আদায়ের স্বার্থে পুনঃনিরীক্ষায় পাঠাতে পারেন। কমিশনার যে আদেশ দিয়েছেন সেটি সংশোধনের সুযোগ রয়েছে। এনবিআরের সেন্ট্রাল ইন্টেলিজেন্স সেল (সিআইসি)-এর সহযোগিতায় উচ্চপর্যায়ের কমিটি গঠন করতে পারেন। এনবিআর এ বিষয়ে দ্রুত ব্যবস্থা নিতে পারে। 

আপন দেশ/আরএ
 

মন্তব্য করুন # খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, আপন দেশ ডটকম- এর দায়ভার নেবে না।

শেয়ার করুনঃ

সর্বশেষ

জনপ্রিয়