বাংলাদেশের উঠতি নেতা ভিপি নুর। কোটা সংস্কার আন্দোলনের সিঁড়ি বেয়ে তিনি দেশের আলোচিত নেতা বনে যান। অনেক গোপন তথ্য ফাঁস হওয়ার আগে মোটামুটি তাকে প্রজন্মের হ্যামিলিয়নের বাঁশিওয়ালাই আখ্যা দিচ্ছিলেন দেশের বেকারসহ সাধারণ মানুষ।
কিন্তু কালের আবর্তে এবং স্বকর্মে ম্লান হয়ে যাচ্ছে ‘রাজনীতির সালু’তে ঢাকা ভিপি নুরের অর্জন। একে একে সবাই ছেড়ে যাচ্ছেন তাকে। সহযোদ্ধারাই তাকে অব্যাহতি দিচ্ছেন।
বোদ্ধারা বলতে শুরু করেছেন নিরেট গ্রাম থেকে উঠে আসা নুরের মধ্যে অনেক আলোর ছটা ছিল। কিন্তু অভিভাবকহীন উঠতি নেতা ভিপি নুর ‘অঙ্কুরে বিনষ্ট হচ্ছে’। আড়ালে আবডালে শত্রুভাবাপন্ন দেশের প্রতিনিধির সঙ্গে বৈঠক, কোনো কোনো শীর্ষ নেতার পা ছুঁয়ে সালাম করা, নেত্রীর মধ্যে নিজের মাকে দেখার মতো বুলি ছাড়া, সরকার পতনের দিনক্ষণ বেঁধে দেয়া, হঠাৎ অঢেল বিত্তবান হওয়া এবং দল ভাঙা-গড়ায় নায়কের ভূমিকা পালনে এখন প্রশ্ন উঠেছে নুরুল হক নুর আসলে কার?
মায়ের প্রতিচ্ছবি ও পা ছুঁয়ে সেলাম
২০১৯ সালের ১১ মার্চ অনুষ্ঠিত হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের (ডাকসু) নির্বাচন। তাতে সহসভাপতি (ভিপি) নির্বাচিত হন নুরুল হক নুর। পাঁচ দিন পরই ১৬ মার্চ বিকালে প্রধানমন্ত্রীর সরকারি বাসভবন গণভবনে যান ডাকসু ভিপি নুরুল হক নুর। গণভবনের গেটে পৌঁছেই ডাকসুর নবনির্বাচিত জিএস গোলাম রাব্বানীর সঙ্গে কোলাকুলি করেন নুর।
নবনির্বাচিত ভিপি নুর প্রধানমন্ত্রীর উদ্দেশ্যে বলেন, ছোটবেলায় আমি মাকে হারিয়েছি। আপনার মাঝে আমি আমার মায়ের প্রতিচ্ছবি খুঁজে পাই। নুরের এ বক্তব্যের পর প্রধানমন্ত্রী তাকে পাশে বসান। এ সময় নুর প্রধানমন্ত্রীর পা ছুঁয়ে সালাম করেন।
মুক্তি চান খালেদা জিয়ার বৈঠক করেন মির্জা ফখরুলের সঙ্গে।
২০২০ সালের এক সভায় ডাকসু ভিপি নুরুল হক নুর বলেন, আমি বিএনপি করি না। তারপরও শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের ওপর শ্রদ্ধা রেখে আমিও সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার মুক্তি চাই।
কারণ বেগম খালেদা জিয়াকে যে মামলায় আটক রাখা হয়েছে, সেটি একটি উদ্দেশ্যপ্রণোদিত রাজনৈতিক প্রতিহিংসামূলক মামলা।’
২০২২ সালেল ৩ আগষ্ট বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুলের সঙ্গে বৈঠক করেন রেজা কিবরিয়া ও নুর। ঘোষণা দেন এক হয়ে সরকার পতন আন্দোলনের। অনেকবার বৈঠকও করেছেন বিএনপির সিনিয়র নেতাদের সঙ্গে।
এদিকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে নুরের নামে। তিনি নাকি বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের সঙ্গে হোয়াট্সঅ্যাপে চ্যাট করেছেন।
গণঅধিকার পরিষদ ভাঙা-গড়া
ড. রেজা কিবরিয়া ও ভিপি নুর গঠন করেছিলেন গণঅধিকার পরিষদ। বেশ কিছুদিন ধরেই দুই নেতার মধ্যে টানাপড়েন চলছিল। গত ১৯ জুন সংগঠনবিরোধী অভিযোগ এনে গণঅধিকার পরিষদের আহ্বায়ক রেজা কিবরিয়াকে সরিয়ে ভারপ্রাপ্ত আহ্বায়কের দায়িত্ব দেয়া হয় যুগ্ম আহ্বায়ক মো. রাশেদ খানকে। গণঅধিকার পরিষদের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে এক সভায় নেয়া হয় এ সিদ্ধান্ত। এ ঘটনার ২৪ ঘণ্টা না পেরোতেই ২০ জুন রাতে নুরুর বিরুদ্ধে লেনদেন, ইসরাইলি গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদের সঙ্গে সম্পর্কসহ নানা অভিযোগ তুলে পাল্টা ঘোষণা দেন রেজা কিবরিয়া। ডাকসুর সাবেক ভিপি নুরুল হক নুর ও রাশেদ খানকে পদ থেকে সাময়িক অব্যাহতি দিয়ে হাসান আল মামুনকে ভারপ্রাপ্ত সদস্যসচিব মনোনীত করেন রেজা কিবরিয়া। নুরুল হক নুরকে গণঅধিকার পরিষদের সদস্যসচিব থেকে অব্যাহতি দেন রেজা কিবরিয়া।
নুরু থেকে ভিপি নুর
নুরুল হকের জন্ম পটুয়াখালী জেলার গলাচিপা উপজেলার চর বিশ্বাস ইউনিয়নে। পাঁচ ভাইবোনের মধ্যে পরিবারের তৃতীয় সন্তান নুর। তিনি তার মাকে হারান ১৯৯৩ সালে যখন তার বয়স আনুমানিক পাঁচ থেকে ছয় বছর। সাধারণ একটি পরিবারে জন্ম নেয়া নুরের বাবা সাবেক ইউনিয়ন পরিষদ সদস্য মো. ইদ্রিস হাওলাদার। তিনি বিএনপির সমর্থক।
আরও পড়ুন <> মোসাদ-নুরের সম্পর্ক: তথ্য ফাঁস করলেন রেজা কিবরিয়া
নুর চর এলাকাতেই সপ্তম শ্রেণি পর্যন্ত লেখাপড়া করেছেন। এরপর গাজীপুরের কালিয়াকৈরে চাচাতো বোনের বাড়িতে থেকে পড়াশোনা করেন। কালিয়াকৈর মাধ্যমিক বিদ্যালয় থেকে এসএসসি পাশ করেন। এইচএসসি পাশ করেন উত্তরা হাই স্কুল অ্যান্ড কলেজ থেকে। মেডিক্যাল কলেজে সুযোগ না পেয়ে প্রথমে পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন এবং পরবর্তীতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি বিভাগে ভর্তির সুযোগ পান।
নুরের শ্বশুর গলাচিপা উপজেলার চর বিশ্বাস ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি হাতেম আলী। তার মেয়ে মরিয়ম আক্তারকে বিয়ে করেন নুর। নুরের স্ত্রী মরিয়ম স্থানীয় একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষিকা হিসেবে কর্মরত।
নুরুল হক কোটা সংস্কার আন্দোলনে নেতৃত্বের কারণে গণমাধ্যমে পরিচিত মুখ হয়ে ওঠার পর থেকেই একদিকে শারীরিক নানারকম হামলার শিকার যেমন হয়েছেন, তেমনি সাইবার জগতেও শিকার হয়েছেন আক্রমণের। 'শিবির-কর্মী' বলে তাকে অনলাইনে আখ্যা দেয়া হয়। এমনকি ডাকসু নির্বাচনের ফল ঘোষণার রাতে নুরের বিজয়ের খবরে 'শিবিরের ভিপি মানি না' এমন স্লোগানও দিয়েছিল ছাত্রলীগ।
নুরুল হক কখনো শিবিরের রাজনীতিতে যুক্ত ছিল কিনা জানতে চাইলে তার পরিবার গণমাধ্যমকে তা নাকচ করে দিয়েছেন। তবে নুরুল হক এর আগে ছাত্রলীগের বিশ্ববিদ্যালয় হল কমিটিতে সক্রিয় ছিলেন। হাজী মুহম্মদ মহসিন হল ইউনিটের মানবসম্পদ উন্নয়ন বিষয়ক উপ-সম্পাদক ছিলেন বলে জানা গেছে।
বিতর্কিত-আলোচিত-সমালোচিত যেভাবে
২০২২ সালের ২৮ ডিসেম্বর দুবাইয়ে ডাকসুর সাবেক ভিপি নুর ইসরাইলের গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদ’র সদস্য মেন্দি এন সাফাদির সঙ্গে বৈঠক করেছেন বলে অভিযোগ উঠে। মেন্দি এন সাফাদি ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর লিকুদ পার্টিরও সদস্য। চলতি বছরের ৩ জানুয়ারি ফেসবুকে বিভিন্ন আইডি এবং পেজ থেকে তাদের দুই জনের একটি ছবি ছড়িয়ে পড়ে।
ছবিতে দেখা যায়, একটি রেস্টুরেন্টের সামনে মোসাদের এজেন্ট মেন্দি এন সাফাদির সঙ্গে হাসিমুখে দাঁড়িয়ে রয়েছেন ডাকসুর সাবেক সহ-সভাপতি (ভিপি) নুরুল হক নুর। প্রথম ছবিটি এডিট করা বলে দাবি করে নুর। এরপর স্বীকার করে বলেছেন, আমি যে কারো সঙ্গে কথা বলতেই পারি। এ ঘটনায় তপ্ত হয়ে উঠে সংসদ। ক্ষিপ্ত হয় ক্ষমতাসীনরা।
১১ জানুয়ারি দেশে ফিরে সংবাদ সম্মেলনে নুরু জামায়াতের আমির ডা. শফিকুর রহমানকে ‘মানবতাবাদী’ আখ্যা দিয়ে ফের সমালোচনায় পড়েন। তিনি বলেন, জামায়েতের আমিরের মতো একজন মানবতাবাদী লোককেও জঙ্গিবাদে জড়িয়ে যারা জেলে নিতে পারে, আমাকে নেয়া তো তাদের জন্য কোনো ব্যাপার না।
সর্বশেষ গত বৃহস্পতিবার (২২ জুন) ঢাকায় ফিলিস্তিনের রাষ্ট্রদূত ইউসুফ এস ওয়াই রামাদান মোসাদের সঙ্গে নুরের বৈঠক নিয়ে তথ্য দেন। তিনি জানিয়েছেন, ইসরায়েলের গুপ্তচর সংস্থা মোসাদের সঙ্গে গণঅধিকার পরিষদ নেতা নুরুল হক নুর কাতার, দুবাই ও ভারতে তিন দফা বৈঠক করেছেন।
ইউসুফ এস ওয়াই রামাদান বলেন, আমাদের গোয়েন্দা সংস্থা থেকে বৈঠকের ছবি পেয়েছি। কাতার বিশ্বকাপের সময় (২০২২ সালের নভেম্বর-ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত) বিষয়টি আমাদের নজরে আসে। তিনি বলেন, ইসরায়েল থেকে টাকা নেয়া মানুষ কখনো নেতা হতে পারে না। এ ধরনের নেতা দেশের জন্য কল্যাণ বয়ে আনতে পারে না।
আপনদেশ/এবি
মন্তব্য করুন # খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, আপন দেশ ডটকম- এর দায়ভার নেবে না।