ছবি : আপন দেশ
সেনরাত আলভিস এখন শ্রীলঙ্কা ক্রিকেটের গুরুত্বপূর্ণ পদে আছেন।বয়স ভিত্তিক ক্রিকেটে মেধাবীদের চিরুনি অভিযান দিয়ে খুঁজে বের করতে যে চারজন শ্রীলঙ্কান কোচকে নিয়োগ দিয়েছিল বিসিবি, তাদের মধ্যে একজন এই সেনরাত আলভিস।
দেশব্যাপী অনূর্ধ্ব-১৩ মাইলো ক্রিকেট ক্যাম্পেইনে এক কিশোরকে অন্যদের চেয়ে ব্যতিক্রম মনে হয়েছে এই শ্রীলঙ্কানের কাছে। নেটে সবাইকে যখন এক-দুই ওভার করে দেখছেন আলভিস, তখন মাত্র একটি শট দেখেই তামিমকে পছন্দ করেছেন তিনি! দুই তিন স্টেপ সামনে এসে পিচ্চি ছেলেটির শট দেখে এতোটাই মুগ্ধ যে, ভবিষ্যতের সৌরভ গাঙ্গুলিকে পেয়ে গেছেন তিনি। সেই ছেলেটিই তামিম ইকবাল।
বাবা খ্যাতিমান ফুটবলার ইকবাল খান, চাচা আইসিসি ট্রফি জয়ী অধিনায়ক আকরাম খান, বড় ভাই নাফিস ইকবাল বাংলাদেশের প্রথম টেস্ট সিরিজ জয়ী দলের হিরো। তবে এসব পরিচয়ে নয়, নিজেকেই নিজে চিনিয়েছেন। ফুটবল খেলে পা হারানো বাবা ক্র্যাচে ভর দিয়ে ছোট্ট তামিমের খেলার মাঠে যেতেন, সেই বাবার স্বপ্ন পূরণ করতে হয়েছেন আন্তর্জাতিক ক্রিকেটার। ১৭ বছরের আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারে ১৫ হাজার রানের ক্লাবে একমাত্র বাংলাদেশী এই ছেলেটিই।
অথচ, ১৭ বছর বয়সে এই ছেলেটির আন্তর্জাতিক অভিষেকের পেছনের গল্পটা অনেকের হয়ত মনে নেই। ১৫ বছর বয়সে ঢাকা প্রিমিয়ার ডিভিশনে ওরিয়েন্টের হয়ে অভিষেকে হৈ চৈ ফেলে দেয়া, ১৬ বছর বয়সে ডিওএইচএস'র হয়ে ১৮৮ রানের ইনিংসে বিস্ময়ের জন্ম দিয়ে অভিষেক হয়েছে জাতীয় দলে। ২০০৭ বিশ্বকাপে সময়ের সেরা পেস বোলার জহির খানকে ত্রিনিদাদে পিচ্চির ওয়ান বাউন্স বাউন্ডারি শটটি যেনো এই পেসারকে থাপ্পড়! বাউন্সারে ভয় পাইয়ে দিতে চেষ্টা করে উল্টো ভারত বোলাররা তামিমের প্রতি আক্রমনে তছনছ। বাংলাদেশের কাছে হেরে বিশ্বকাপ থেকে বিদায় নিতে হয়েছে সর্বকালের সেরা ভারত ক্রিকেট দলকে।তারপরও তামিমের ১৮তম জন্মদিনটা ত্রিদিদাদের হোটেল হিলটনে পালন করেছে ভারত দল! এমন আগ্রাসী মেজাজের ব্যাটারকে দেখে ক্যারিবিয়ান লিজেন্ডারি ভিভ রিচার্ডস এন্টিগায় আমাকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন-‘তোমাদের ক্রিকেটারদের মধ্যে এই ছেলেটিকেই আলাদা মনে হয়েছে।ওর ভবিষ্যত অনেক ভাল।’
তার এই ভবিষ্যদ্বানী সত্যি হয়েছে। বিদেশের মাটিতে বাংলাদেশের প্রথম টেস্ট জয়ের নায়ক তামিম। প্রথম টেস্ট সেঞ্চুরিতেই ম্যাচ উইনার। ২০০৯ সালে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে তার ওই সেঞ্চুরিতে বাংলাদেশ রচনা করেছে ইতিহাস। সে বছর প্রথম তিনশ' প্লাস চেজ করে (৩১৩) জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে তামিমের ১৫৪ রানের ইনিংসে ড্রেসিং রুমে সমস্বরে আমরা করবো জয় গানে উৎসবমুখ পরিবেশের মধ্যমনি তামিম।
২০১০ সালে লর্ডস, ওল্ড ট্র্যাফোর্ডে ব্যাক টু ব্যাক সেঞ্চুরিতে অনার্স বোর্ডে নাম লিখিয়েছেন তামিম।২০১৫ সালে পাকিস্তানের কাছে ফলো অনে পড়ে ম্যাচ বাঁচাতে তৃতীয় ইনিংসে ডাবল সেঞ্চুরি, ইমরুল কায়েসকে নিয়ে ৩১২ রানের বিশ্বরেকর্ড পার্টনারশিপে তামিমের কৃতিত্বগাঁথা থাকবে সবার হৃদয়ে। বাংলাদেশের শততম টেস্ট জয়ে ম্যাচ সেরা তামিমকেও কী ভুলতে পারবে বাংলাদেশের মানুষ ?
টি-টোয়েন্টি ক্যারিয়ারে বাংলাদেশের প্রথম সেঞ্চুরিয়ান এবং হাজারী ক্লাবের সদস্য তামিম ইকবালের সংক্ষিপ্ত সংস্করণের ক্রিকেট ক্যারিয়ার থেমেছে দুই বছর আগে। দুই বছর আগে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপকে সামনে রেখে সংক্ষিপ্ত ফরম্যাটের ক্রিকেট থেকে নিয়েছিলেন অবসর। এবার ওয়ানডে বিশ্বকাপকে সামনে রেখেও আবেগি সিদ্ধান্তে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটকে জানিয়েছেন তামিম গুডবাই।
২৮ মাস আগে সিলেটে বিশালদেহী অধিনায়ক মাশরাফিকে কাঁধে তুলে নিয়েছিলেন তামিম অধিনায়কের ভার কতোটা, তা বোঝার জন্য। অধিনায়ক মাশরাফির ফেয়ারওয়েলের পর তার উপর অর্পিত ক্যাপ্টেনসির বোঝাটা ভালই বহন করেছেন তামিম। আইসিসির রক্তচক্ষুর জবাব দিয়ে র্যাঙ্কিংয়ের হিসাব মিলিয়ে ৮ দলের ২০১৭ আইসিসি চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি এবং ১০ দলের ২০১৯ বিশ্বকাপ ট্রফি সরাসরি কোয়ালিফাই করেছে বাংলাদেশ মাশরাফির ক্যাপ্টেনসিতে। প্রিয় অধিনায়ক মাশরাফির ছাঁয়ায় বেড়ে উঠে,তার নেতৃত্বগুন রপ্ত করে অধিনায়ক তামিমও অসাধ্য সাধনের গল্প রচনা করেছেন।ওডিআই সুপার লিগে অস্ট্রেলিয়া, ভারত, পাকিস্তান,দক্ষিণ আফ্রিকার মতো পরাশক্তিদের পেছনে ফেলে পয়েন্ট তালিকায় তৃতীয় হয়ে ২০২৩ বিশ্বকাপে কোয়ালিফাই করেছে বাংলাদেশ তামিমের নেতৃত্বে! ২৪ ম্যাচে ১৫ জয়ে ১৫৫ পয়েন্ট নিয়ে ইংল্যান্ডকে ছুঁয়েছে বাংলাদেশ।
তবে যার নেতৃত্বে ওডিআই সুপার লিগে বাংলাদেশ দলের সাফল্য কল্পনাকেও মানিয়েছে হার, বিশ্বকাপে দেখা যাবে না তাকে! বিশ্বকাপের আগে সব ধরণের আন্তর্জাতিক ক্রিকেট থেকে নিয়েছেন কান্নাভেজা অবসর নিয়েছেন বাংলাদেশের সবচেয়ে সফল ব্যাটার তামিম।
দুই বছরের ব্যবধানে দুটি সিদ্ধান্তের প্রেক্ষাপট এক। টি-টোয়েন্টি দলে অবস্থান নড়বডে, কেন্দ্রীয় চুক্তিতে রাখা হচ্ছে না-তা আঁচ করতে পেরে সেবার দিয়েছিলেন এই ফরম্যাট থেকে অবসরের ঘোষণা। ইনজুরি ভোগাচ্ছে। আফগানিস্তানের বিপক্ষে টেস্ট মিস করেছেন। তবে পুরোপুরি ফিট না হয়েও মিস করতে চাননি ওয়ানডে সিরিজ। আফগানিস্তানের বিপক্ষে মঙ্গলবার সংবাদ সম্মেলনে তামিম বলেছেন- ‘আমি অবশ্যই আগামীকালের ম্যাচের জন্য আছি। শরীর আগের চেয়ে ভালো। তবে এটা বলব না যে শতভাগ (ঠিক আছি)। কাল খেলার পর আরও ভালো বুঝতে পারব যে কী অবস্থা। তবে এখন পর্যন্ত সিদ্ধান্ত, আমি কাল খেলছি, ইনশা আল্লাহ।’ তার এই বক্তব্যটাই আসামির কাঠগড়ায় তাকে দাঁড় করিয়েছে। ফজলহক ফারুকির অফ স্ট্যাম্পের অনেক বাইরের বল অকারণে থার্ডম্যান দিয়ে খেলতে যেয়ে তামিমের আত্মাহুতিতে সুযোগ পেয়েছে বিসিবি। মাত্র ১৩ রানের মাথায় উইকেট কিপারের হাতে নিজেকে সঁপে দিয়ে বাংলাদেশ দলকে বিপদের মুখে একা ফেলে দিয়েছেন তামিম, বাংলাদেশ দল বৃষ্টি আইনে আফগানিস্তানের কাছে ১৭ রানে হারের অন্যতম কারণ এটা- তা বলা যাবে না।কারণ, আত্মহত্যার মিছিলে লিটন,সাকিব,মুশফিক,মিরাজরা এই অভিযোগে অভিযুক্ত হতে পারেন। গণমাধ্যমকে একটি সত্য কথা বলতে যেয়ে যে চাপটা পড়েছে তার উপর, তার ভার বহন করতে পারেননি তামিম।
আফগানিস্তানের বিপক্ষে সিরিজের প্রথম ম্যাচ বৃষ্টি আইনে ১৭ রানে হেরে যাওয়ায় অপরাধবোধে তাড়িত ছিলেন তামিম। তবে পুরোপরি ফিটনেস ফিরে পাওয়ার আগে তার খেলার সিদ্ধান্ত এবং দ্রুত তার আউট হওয়ায় অভিযোগের তির এতোটাই বিদ্ধ করেছে যে, রাতে টিম হোটেল থেকে কাজির দেউড়ির বাসায় ফিরে দুপুরে সংবাদ সম্মেলন ডেকে কৌতুহলি করেছেন তামিম। আর সেই কৌতুহলের অবসানে কান্নাভেজা কণ্ঠে সব ফরম্যাটের ক্রিকেট থেকে তার অবসর ঘোষণা বাংলাদেশের ক্রিকেট প্রশাসনকে আর একবার দাঁড় করিয়েছে।
পাঁচ বছর আগে দুবাইয়ে ভাঙ্গা আঙুলে ব্যান্ডেজ নিয়ে ব্যাটিং গ্লাভস কেঁটে এক হাতে শেষ ব্যাট করে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে বাংলাদেশের জয়ে দেশাত্মবোধের সবচেয়ে বড় প্রমান দিয়েছেন তামিম। গালফ নিউজের স্পোর্টস পেজে তামিমের সেই ছবিটি এখন দেখতে পারে বিসিবি।
ওয়ানডে ক্রিকেটে বাংলাদেশের সবচেয়ে সফল অধিনায়ক মাশরাফির সাফল্যাঙ্ক যেখানে ৫৮.১৩% (৮৮ ম্যাচে ৫০ জয়), সেখানে তামিমের ৬০% (৩৭ ম্যাটে ২১ জয়)। বাংলাদেশের ওডিআই ইতিহাসে অধিনায়কদের সাফল্যাঙ্কে সবার উপরে তামিম। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ১৭ বছরের লম্বা এবং বর্ণাঢ্য ক্যারিয়ারের আনুষ্ঠানিক ফেয়ারওয়েলের তো প্রাপ্য দাবিদার ৩৪ বছর বয়সী এই ক্রিকেটার।
সামনে এশিয়া কাপ এবং বিশ্বকাপের মতো দুটি মেগা আসর করছে অপেক্ষা। ওয়ানডে ক্রিকেটে বাংলাদেশের একমাত্র ৮ হাজারী ক্লাবের সদস্য (২৪১ ম্যাচে ৮৩১৩ রান), তিন ফরম্যাটের ক্রিকেট মিলে বাংলাদেশের একমাত্র ১৫ হাজার রানের মালিক (৩৮৯ ম্যাচে ১৫২০৫ রান) তামিমের নেতৃত্বে এই দুটি আসর শেষ করে ফেয়ারওয়েল মঞ্চ তো তৈরি করতে পারতো বিসিবি। কিন্তু সেই সুযোগটাই যে পেলেন না তামিম। তামিম নিজেও যে চাননি বিশ্বকাপ পর্যন্ত এই বোঝাটা বইতে। কান্নাভেজা কণ্ঠে অবসর ঘোষণায় সে অবস্থানের কথাই যে জানিয় দিয়েছেন গণমাধ্যম কর্মীদের- ‘আমি চাইলে অন্তত বিশ্বকাপ পর্যন্ত তো খেলতে পারতাম।কিন্তু আমি এই জীবনে যা করেছি, জীবনকে যে দৃষ্টিকোণ থেকে দেখি, তাতে আরেকটি বিশ্বকাপের জন্য এত বড় বিসর্জন দেওয়ার কোনো মানে নেই।’
এক সঙ্গে তিন ফরম্যাটের আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে বাংলাদেশের সর্বোচ্চ রানের রেকর্ডটা ছিল তামিমের দীর্ঘদিন। উইজডেন টেস্ট ক্রিকেটার অব দ্য ইয়ারে ভুষিত প্রথম বাংলাদেশী ক্রিকেটারও তামিম।সবার আগে ক্রিকেটের বাইবেল খ্যাত উইজডেনের পচ্ছদে পেয়েছেন তামিম জায়গা। কী টেস্ট, কী ওয়ানডে-৪ হাজার থেকে শুরু করে প্রতিটি মাইলস্টোনে প্রথম তামিম ওডিআই ক্রিকেটে ৬ হাজার রান পূর্ণ করে আমার সংগ্রহে থাকা স্কোরকার্ডে লিখেছিলেন-‘হ্যাপি টু গেট মোর রানস।’ প্লেয়ার অব দ্য ম্যাচের ট্রফি হাতে নিয়ে আমাকে পাশে দাঁড়িয়ে রেখে তুলেছিলেন ছবি। অথচ, ওয়ানডেতে ৮,৩১৩,টেস্টে ৫১৩৪ এবং টি-টোয়েন্টিতে ১৭৫৮ এবং ২৫টি সেঞ্চুরিতে থেমে গেলো এই বাঁ হাতির আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ার।
লেখক: সিনিয়র সাংবাদিক ও ক্রিকেট বিশ্লেষক
মন্তব্য করুন # খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, আপন দেশ ডটকম- এর দায়ভার নেবে না।